মূল্যবোধের ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বিপুল অর্থসম্পদ অর্জন করে সমাজে প্রতিপত্তিশালী হওয়াটাই সাধারণ চোখে আমরা জীবনের সফলতা বলে গণ্য করি। ফলে জীবনের জন্য প্রয়োজনাতিরিক্ত এবং সীমাহীন ধনসম্পদ আহরণের বেপরোয়া এবং নিরন্তর প্রয়াসে মানুষ উপেক্ষা করে হিতাহিত এবং ন্যায়-অন্যায় বোধকে। সম্পদ আহরণের এই সহজাত মানসিকতা চলমান অনাদিকাল ধরে। এই প্রবণতায় এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে অর্থ বা মুদ্রা আবিষ্কারের পর। কারণ, মুদ্রা আবিষ্কার ছিল মানবসভ্যতার অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে এক বিরাট সাফল্য।
অথচ মীর মশাররফ হোসেন এটিকে বলেছেন ‘পাতকী অর্থ’। বলেছেন, এই অর্থই ‘জগতের সকল অনর্থের মূল’। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অর্থ আমাদের জীবনের সবকিছু নয়, কিন্তু অনেক কিছু। কারণ, অর্থ মানুষকে অনেক কিছুই দিতে পারে, করতে পারে অনেক সমস্যার সমাধান। অর্থ মানুষকে দেয় গতি ও স্বাচ্ছন্দ্য, সহজতর করে লেনদেন।
মানুষের দক্ষতা ও মেধা মূল্যায়নেও অর্থ পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অথচ সেই অর্থই আবার হয়ে ওঠে মানুষের দুষ্কর্ম এবং অপরাধপ্রবণতার মূল চালিকাশক্তি। কারণ, সম্পদ আহরণের দুর্নিবার লোভ মানুষকে প্ররোচিত করে যেকোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনে সক্রিয় হতে। এই প্রবণতা যখন নেশায় রূপান্তরিত হয় তখন মানুষ তাদের অনৈতিক পন্থায় উপার্জিত অর্থের একাংশ দিয়ে কিনে নেয় প্রভাব ও পেশিশক্তি। কারণ, তাদের অবৈধ আয়ের অর্থ-সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় ক্ষমতা ও প্রভাব।
সম্ভাব্য সব ধরনের অনৈতিক পথে অর্থ উপার্জন এবং তার সুরক্ষার জন্য ক্ষমতা আহরণের এই চক্রবৃদ্ধিতে মানুষ আরও বেশি অনৈতিক ও অবৈধ পন্থায় জড়িয়ে পড়ে। যেসব দেশে ও সমাজে আইনের বাহুগুলো দুর্বল এবং নিয়ন্ত্রক তথা আমলাতন্ত্র দুর্নীতিপরায়ণ, সেসব দেশে অবৈধ অর্থ আয়, তার সুরক্ষা এবং আইন ভেঙে পার পেয়ে যাওয়া তত সহজ। এই বাস্তব সত্যটি আমাদের দেশের বেলায় প্রবলভাবে প্রযোজ্য। সম্প্রতি দি ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন (৩ সেপ্টেম্বর ২০১৩) এক নিবন্ধে বাংলাদেশের দুর্নীতি সম্পর্কে একটা খোঁচা দেওয়া নিবন্ধ ছেপেছে। পর পর পাঁচ বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি তালিকার শীর্ষে থাকার পর পরিস্থিতির উন্নতি ঘটার কথা স্বীকার করেও আবার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিলের কথাটা।
শাসক দলের মদদপুষ্ট ব্যবসা (ক্রোনি ক্যাপিটালিজম) প্রবণতা রোধ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করার একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট যে বাংলাদেশের উদাহরণ টেনে এনে দুর্নীতির প্রমাণ সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষের ‘অপর্যাপ্ত প্রতিক্রিয়া’র কথা বলেছিলেন, সে-কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। দি ইকোনমিস্ট-এর প্রতিবেদনটি মূলত লেখা হয়েছে বাংলাদেশের অনেকের মধ্যে আরেক ‘ওপেন সিক্রেট’ আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকি প্রসঙ্গে। এতে সবচেয়ে বড় এই দুর্নীতিটির প্রতি দাতা সংস্থার সীমিত মনোযোগের প্রতি ইঙ্গিতের মাধ্যমে কটাক্ষ করা হয়েছে ভাষার মারপ্যাঁচে। বলা হয়েছে, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে যে পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়, সেটা রোধ করা গেলে সরকারের খরচ করার সক্ষমতা দ্বিগুণ হতো, যাতে প্রতি দুই বছরে পদ্মা সেতুর মতো একটা করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব। পত্রিকাটি আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি উদাহরণসহ বিশদ বর্ণনা করেছে, যা সাধারণ পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা উচিত।
ধরা যাক, একটি পণ্যের প্রকৃত দাম ১০০ ডলার। কিন্তু বাংলাদেশের আমদানিকারক বিদেশি বিক্রেতাকে অনুরোধ করে, যাতে সেই পণ্যটির দাম ইনভয়েসে উল্লেখ করা হয় ৫০ ডলার। যেহেতু ইনভয়েস মূল্যের ওপর ভিত্তি করে আমদানি শুল্ক নির্ধারিত হয়, সেই পণ্যটি বাংলাদেশে ঢোকার সময় শুল্ক নির্ধারিত হয় ৫০ ডলারের ওপর। ঋণপত্রের শর্ত মোতাবেক পণ্যটির মূল্য বৈধ চ্যানেলে পরিশোধ করা হয় ৫০ ডলার, বাকি ৫০ ডলার পরিশোধ করা হয় হুন্ডির মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্য ঘোষণার কারণে ৫০ শতাংশ শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হলো।
নিবন্ধটিতে আমেরিকান অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশের আর্থবাজার উপদেষ্টা ফরেস্ট কুকসনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের এই দৌরাত্ম্য বন্ধ করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত ১ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো যেত। অথচ গত এক দশকে আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চার গুণ বাড়লেও কর-জিডিপির অনুপাত এখনো বিশ্বের নিম্নতম পর্যায়ে রয়ে গেছে। নিবন্ধটিতে মন্তব্য করা হয়েছে, এভাবে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয় বলে বাংলাদেশি আমদানিকারকেরা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য পণ্যও কম খরচে দেশে আনতে পারেন। আরও বলা হয়েছে যে ২০০২ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি-বাণিজ্য বেড়েছে সাত গুণ এবং এই বৃদ্ধির ফলে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের পরিমাণও বেড়েছে সমভাবে, যার পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। আমাদের শুল্ক আইনে সব ধরনের বিধান ও আইন থাকা সত্ত্বেও কেবল দুর্নীতিপূর্ণ মানসিকতার কারণে শুল্ক ফাঁকির এই প্রবণতা রোধ করা যায়নি।
আন্ডার ইনভয়েসিং করা ঘোষিত মূল্য বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার বিধানসংবলিত বাধ্যতামূলক প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শনের নিয়মটি সম্প্রতি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, এই নিয়ম করেও প্রবণতাটি সম্পূর্ণ বন্ধ করা যায়নি।
বিদেশি পত্রিকায় নিবন্ধ আকারে প্রকাশিত হলেও বিষয়টি বাংলাদেশের বাস্তবতায় নতুন বা গোপন কিছু নয়। এটি সম্ভব হয় কারণ এ-জাতীয় কাজ করে পার পেয়ে যাওয়ার উপায় আছে এবং রপ্তানিকারক দেশেও আন্ডার ইনভয়েসিংজাত অবৈধ রেমিট্যান্স নেওয়া সম্ভব হয় বলে। বর্তমান প্রচলিত আইনে এ ধরনের লেনদেন মানি লন্ডারিংয়ের আওতায় পড়ে, যদিও কোনো কোনো দেশে কর ফাঁকির অর্থকে এই সংজ্ঞার আওতায় আনা হয় না।
দি ইকোনমিস্ট পত্রিকার নিবন্ধে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে চীনা রপ্তানিকারকদের মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত হওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে সরাসরি। উল্লেখ্য, টাকা ধোলাইয়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা যায়, এমনকি খ্রিষ্টপূর্ব সময়েও চীন দেশে এই প্রবণতা চালু ছিল। সে সময় সরকারের কাছ থেকে সম্পদ লুকিয়ে রেখে দূরবর্তী কোনো প্রদেশে কিংবা দেশের বাইরে কোথাও বিনিয়োগ করার প্রক্রিয়া থেকেই চালু হয় অফ শোর বা বহির্দেশীয় বিনিয়োগ এবং রাজস্ব ফাঁকির প্রবণতা। বস্তুত, সত্তরের দশক থেকেই যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশে অবৈধ অর্থ গোপন রাখার বিরুদ্ধে আইন করা হলেও আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে টাকা ধোলাইবিরোধী আইন জারি করা হয়। তবে সেটি আমাদের এতদঞ্চলে কার্যকর হতে সময় লাগে আরও প্রায় দেড় দশক।
২০০১ সালে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর জঙ্গি কার্যকলাপে অর্থায়ন বন্ধ করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই আইন বাধ্যতামূলকভাবে বলবৎ করার উদ্যোগ নেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট’ জারি হওয়ার পর। সংগত কারণেই ব্যাংকগুলোর ওপর এই আইনটি বাস্তবায়ন করার ভার পড়ে। কারণ, আর্থিক অপরাধলব্ধ আয় ধোলাই এবং উদ্ঘাটন বা রোধ—উভয় ব্যাপারেই ব্যাংকের ভূমিকা মুখ্য। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে বর্তমানের জটিল এবং উন্নততর পন্থার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য ব্যাংকারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে গেছে। নব্বইয়ের দশকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আর্থ-কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া বিসিসিআইয়ের উত্থান ও পতনের ইতিহাস বিবেচনা করলেই আমরা টাকা ধোলাইয়ে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের দুই বিপরীতমুখী ভূমিকার বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করতে পারি।
মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী, এমনকি দুর্নীতিপরায়ণ একনায়ক শাসকদের সঙ্গে ব্যাংকটির দহরম-মহরম এবং তাদের টাকা ধোলাইয়ের কাজে ব্যবহূত হওয়ার কারণে ত্যক্ত বিরক্ত মার্কিন প্রশাসন এবং সিআইএর কেউ কেউ নাকি এটিকে বলতেন ‘ব্যাংক অব ক্রুকস অ্যান্ড ক্রিমিনালস ইন্টারন্যাশনাল’। টাকা ধোলাইয়ের কাজে সুবিধার জন্য অবৈধ সম্পদধারীরা বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে থাকে। তাদের থাকে হোটেল ব্যবসা, চিত্র প্রযোজনা, আইনপ্রতিষ্ঠান, পরিবহনব্যবসা, এমনকি ব্যাংক-ব্যবসাও। লক্ষণীয় এসব ছদ্মবেশী প্রতিষ্ঠানের চরিত্র এমনই যে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ যেমন এসবের মাধ্যমে ধোলাই করে নেওয়া যায়, আবার এসব প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় অবৈধ অর্থ উপার্জন অব্যাহত রাখা যায়। যেমন পরিবহনব্যবসা ব্যবহার করা যায় চোরাচালানের কাজে।
শিপিং ব্যবসার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ বা অস্ত্র চোরাচালান, অভ্যন্তরীণ পরিবহনব্যবসার মাধ্যমে মাদক চোরাচালান—এসবের বহু প্রমাণ-অযোগ্য উদাহরণ আমাদের দেশের মধ্যেই রয়েছে। এই একই উদ্দেশ্যে খুব বড় মাপের অবৈধ অর্থ আয়কারীরা এমনকি ব্যাংক-ব্যবসায়ও নেমে পড়ে। এই ব্যবসার ধারণাটি চিহ্নিত করা হয় সমান্তরাল ব্যাংকিং বা প্যারালাল ব্যাংকিং বলে। ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টস (বিস) এ ধরনের ব্যাংক মালিকানার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালাও প্রণয়ন করেছে। উল্লেখ্য, বিস-এর এই নীতিমালার পটভূমি হিসেবেও উত্থাপন করা হয়েছে বিসিসিআইয়ের উদাহরণ।
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে অবস্থান, দুর্বল কাঠামোর কারখানা ভবন ধসে বিশ্বের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যু, বসবাসের অযোগ্য নগর হিসেবে ঢাকার সর্বনিম্ন স্থান লাভ—এ রকম বিপর্যস্ত ভাবমূর্তির কলঙ্কতিলক ধারণ করে আমাদের আর কত কাল মাথা নিচু করে চলতে হবে জানা নেই। তাই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বান করেও আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখতে হয় দেশ ও জনগণের জন্য চরম অবমাননাকর এ-জাতীয় সব ঘটনার দিকে। এসব দুর্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কেবল আইনই যথেষ্ট নয়, আইনের যথাযথ প্রয়োগ সব সময় হয়তো সমাধান নয়, এমনকি ধর্মচর্চাও দমন করতে পারে না মানুষের এসব কীর্তিকলাপ। মানসিকতার পরিবর্তন, মূল্যবোধের উন্নতি এবং বিবেকের কাছে জবাবদিহি ছাড়া সর্বনাশা এসব প্রবণতা রোধে কার্যকর কিছু করা আদৌ সম্ভব কি না, সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ নিয়েই ভাবতে হয় দেশ, জাতি ও সমাজের কথা।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।