অবশ্য জানালিহাট স্টেশনের কাছে ‘বাহির সিগন্যাল’ নামে পরিচিত ওই ‘লেভেল ক্রসিং’ রেলওয়ের অনুমোদিত হলেও সেখানে গত তিন বছর ধরে কোনো ‘গেইটম্যান’ নেই।
মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও এলাকায় ওই ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মিনিবাসটির আরো ছয় শ্রমিক আহত হন।
হতাহতরা সবাই কালুরঘাট শিল্প এলাকার বেইজ টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক। তারা সকালে কাজের জন্য অফিসের ভাড়া করা ওই মিনিবাসে করে কারখানায় যাচ্ছিলেন।
ঘটনার পরপরই পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে স্থানীয় জনতার হাতে ধরা পড়েন মিনিবাসের চালক দিদারুল আলম (৩২)।
পূর্ব রেলের প্রধান প্রকৌশলী মাহাবুব-উল আলম প্রধান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চালক অসতর্ক ছিল। তার কানে এয়ারফোন ছিল এবং সে বাসটি লাইনের ওপর রেখে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ”
এ ঘটনায় রেল কর্তৃপক্ষ যে দুটি তদন্ত কমিটি করেছে তার মধ্যে বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির নেতৃত্ব দেবেন মাহাবুব-উল আলম। আগামী তিন দিনের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দেয়ার কথা রয়েছে।
এছাড়া দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে জানালিহাটের স্টেশন মাস্টার নেজাম উদ্দিন ও পয়েন্টসম্যান টিটু কান্তি পালকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তারা দুজনই দুর্ঘটনার সময় স্টেশনে অনুপস্থিত ছিলেন।
পূর্ব রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, দোহাজারী থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ট্রেনটি দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ আগে জানালিহাট স্টেশন ছেড়ে আসায় গতি ছিল ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটারেরও কম। তা না হলে নিহতের সংখ্যা আরো অনেক বাড়তে পারত।
দুর্ঘটনায় আহত পোশাক কর্মী নমিতা রুদ্র (১৮) হাসপাতালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সিঅ্যান্ডবি এলাকা থেকে কারখানার শ্রমিকদের নিয়ে বাসটি কারখানায় যাচ্ছিল। নারী-পুরুষ মিলিয়ে ২৫ জনের মতো যাত্রী ছিলেন তারা।
সকাল ৮টা ১০ এ মিনিবাসটি ‘বাহির সিগন্যাল’- এ পৌঁছালে ঘটে দুর্ঘটনা।
“ড্রাইভার খুব জোরে চালাচ্ছিল। ট্রেন আসতে দেখে আমরা ক্রসিং পার হতে নিষেধ করলাম। তারপরও সে লাইনে উঠে পড়ল। ”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মিনিবাস চালক দ্রুত ওই ক্রসিং পার হওয়ার চেষ্টা করলেও লাইনে ওঠার পরপরই তার গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়।
এ সময় মিনিবাসের সামনের ডান দিকে ট্রেনের ইঞ্জিনের ধাক্কা লাগে এবং বাসটিকে কিছুদূর ছেঁচড়ে নিয়ে থেমে যায় ট্রেন।
এ ঘটনায় বেইজ টেক্সটাইলের কর্মী ইয়াসমিন আক্তার (২২), রিয়া আক্তার (২০), জুলি আক্তার (৩০) এবং লাকী দেবনাথ (২৫) ঘটনাস্থলেই নিহত হন। স্থানীয়রা দ্রুত এগিয়ে এসে মিনিবাসের পেছনের কাচ ভেঙে অন্য যাত্রীদের বের করে আনেন।
এদিকে চালক দিদারুল সংঘর্ষের আগেই মিনিবাসের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালানোর চেষ্টা করে স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়েন। পরে তাকে পুলিশে সোপর্দ করা হয় বলে চান্দগাঁও থানার এএসআই আলাউদ্দিন জানান।
প্রত্যক্ষদর্শীরাও বলেছেন, দুর্ঘটনার সময় বাস চালকের কানে এয়ারফোন ছিল।
এ ঘটনায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা ফিরোজ ইফতেখারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের আরেকটি কমিটি করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।
অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং
রেল কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম বিভাগের ৪৯৯টির লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ৩৬৫টিরই অনুমোদন নেই। ‘বাহির সিগন্যাল’ এর অনুমোদন থাকলেও সেখানে কোনো ‘গেইটম্যান’ নেই।
পূর্ব রেলের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মাহবুব-উল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বৈধ ১৩৪টি ক্রসিংয়ের ৮২টিতে গেইটম্যান থাকলেও বাকি ৫২টিতে রেলওয়ের কোন জনবল নেই।
”
আর এ জন্য লোকবল সঙ্কটকে দায়ী করেছেন পূর্ব রেলের কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, রেলের অনুমোদন নেই এমন ক্রসিংয়ের অধিকাংশই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের তৈরি। এলজিইডি, সওজ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ‘নিজেদের প্রয়োজনে’ এসব লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করলেও এগুলোতে কোনো গেইটম্যান থাকে না।
এসব ক্রসিংয়ের অনেকগুলোই জনবসতিপূর্ণ এলাকায় হওয়ায় প্রায়ই দুর্ঘটনায় প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটছে।
প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব বলেন, “ক্রসিং পার হওয়ার সময় চালকের সচেতনতার অভাবই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কারণ।
চাঁদগাঁওয়ের ঘটনায় পোশাক শ্রমিকদের বহনকারী মিনিবাসের চালকও সতর্ক ছিলেন না। ক্রসিং পার হবার আগে সতর্কতামূলক চিহ্ন ও সাবধান বাণী লেখা থাকে। ”
বৈধ ক্রসিংয়েও জনবল কম থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যারা আছে তাদের অনেকেই অস্থায়ী চাকরিজীবী। ”
রেল কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগ মিলিয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ১২৪৫ টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৪৩৪টি বৈধ।
এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে এলজিইডির ২৫৩টি, সিটি করপোরেশনের ১৯টি, জেলা পরিষদের ১৩টি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ৬টি এবং চট্টগ্রাম বন্দরের তিনটি লেভেল ক্রসিং রয়েছে।
এর বাইরে বিভিন্ন পৌরসভা এলাকায় ৬৫ ও ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় ৩২৪ এবং বেসরকারি সংস্থার তিনটি অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিং রয়েছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।