আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাষ্ট্র যন্ত্র কি অন্ধ? -মীর আব্দুল আলীম

মীর আব্দুল আলীম :
রাষ্ট্র যন্ত্র কি অন্ধ? রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী কি এসব দেখেন না? দেশে একই ঘটনা প্রতিনিয়ত কেন ঘটছে? যখন এ লিখাটি লিখছি (১১মার্চ) সেদিন চট্টগ্রামে ট্রেনের ধাক্কায় মিনিবাসের ৪ যাত্রী, গাজীপুরের কালীগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীতে ট্রলারডুবিতে ১ শ্রমিক, ৬ জেলায় পৃথক সড়কদুর্ঘটনায় ৯ জন এবং বিভিন্ন উপজেলা ও প্রানিত্মক জনপদে আরও ৬ জন নিহত হন। দুর্ঘটনায় অহরহ মানুষ মরছে। সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যু এখন যেন ছেলের হাতের মোয়া। প্রতিবাদ হচ্ছে; কারন উৎঘাটিত হচ্ছে, আইনও হচ্ছে। প্রতিকার হচ্ছে না।

কিন' কেন? দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি র‌্যাব বাহিনী গঠন করা যায়, দুর্ঘটনা রোধে এ জাতিয় বাহিনী নয় কেন? এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশে সন্ত্রাসীদের হাতে শতকরা ৩০ জন লোক মারা গেলে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ৭০ জন। ৩০ জনের জীবনসহ অপরাপর জানমাল রড়্গায় সরকারের একটি বাহিনী থাকলে শতকরা ৭০ জনের জীবনসহ অসংখ্য অহত ও ডলারে কেনা পরিবহন রড়্গায় সরকার সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বাহিনী গঠন করছে না কেন? দেশের মানুষের জানমাল রড়্গা রাষ্ট্রেও দায়িত্ব। দুর্ঘটনা রোধে চরমভাবে ব্যর্থ সরকারকে দেশের মানুষের স্বার্থে যতসম্ভব দ্রম্নত ভাবতে হবে।
আমরা জেনেছি, কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়ই দেশে গড়ে প্রতিদিন ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটছে। এ হিসাবে মাসে ৯শ’ জন এবং বছরে ১০ হাজার ৮ শ জন মারা যাচ্ছে।

তবে বিআরটিএ-এর পরিসংখ্যানমতে এ সংখ্যা দিনে ১৬ এবং বছরে ৫ হাজার ৭ শ’ ৬০ জন। আইন না মানাই হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারন। এ ড়্গেত্রে সকলকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশসহ চলমান প্রশাসন এ আইন প্রযোগে ব্যর্থ হলে প্রযোজনে তাদেও ঢেলে সাজাতে হবে অন্যথা দুর্ঘটনা রোধে নতুন করে র‌্যাবের মত দুর্ঘটনা রোথেধ বিশেষ বাহিনী গঠন করতে হবে। দুর্ঘটনার অন্যতম কারন গুলোর মধ্যে (১) ত্রম্নটিপূর্ন যানবাহন চলাচল (২) মোবাইল ফোন ব্যবহার (৩) অতিরিক্ত যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন (৪) ট্রাফিক আইন না মান (৫) নিয়োজিতদের দায়িত্বে অবহেলা (৬) চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা ও অসতর্কতা (৭) অরক্ষিত রেল লাইন।

আর এসব কারনে প্রতিদিনই ঘটছে হতাহতের ঘটনা।
দেশে রেললাইনগুলো একে বারেই অরড়্গিত। রেলওয়ে সূত্র মতে, গত ২৬ মাসে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৭৮ জন। এর মধ্যে রেলের সাথে বিভিন্ন পরিবহনের ৪৬ টি সংঘর্ষে ৩১ জন মারা। এছাড়া রেল সংশিস্নষ্ট অন্যান্য দুর্ঘটনায় মারা যান ১৪৫ জন।

রেললাইনের পাশ ঘেষে অবৈধভাবে বসতি স'াপনসহ রেল লাইনের নিরাপত্তা ব্যবস'া জোরদার না করাকেই এ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তাছাড়া পথচারীরা মর্জিমাফিক রেল লাইন দিয়ে হাঁটা, আড্ডা দেয়া, কানে মোবাইলের হেডফোন দিয়ে অসতর্কভাবে গান শুনা এবং অভিমান করে রেল লাইনের নিচে ঝাপিয়ে পড়েও দুর্ঘটনা ঘটছে। একইসাথে ট্রেন চলাচলের সময় লেভেল ক্রসিংগুলোতে সিগন্যাল না মানাকেও দায়ী করা হচ্ছে। কেবল পূর্বাঞ্চল রেলের ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে গত তিন বছর ২ মাসে সিএনজি, পিকআপভ্যান, বাস ও মোটর সাইকেলের সাথে চলনত্ম ট্রেনের মুখোমুখি সংর্ঘষের ঘটনায় মোট ৪৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মহিলাসহ ৩১জন নিহত হয়েছেন।

এর মধ্যে ২০১১ সালে ১৫টি ট্রেন দুঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২জন, ২০১২ সালে ১৬টি দুর্ঘটনায় ৭জন নিহত, ২০১৩ সালে ১৪টি দুর্ঘটনায় ৮জন নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে রেল দুর্ঘটনায় (ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু) ২০১২ সালে ৬৫ জন, ২০১৩ সালে ৬৪ জন এবং চলতি বছরে জানুয়ারিতে ৫ জন, ফেরম্নয়ারি ৫ জন এবং গতকালের দুর্ঘটনাসহ ৬ জন মারা গেছে। এ ছাড়া গত বছরের জানুয়ারিতে ৭ জন, ফেরম্নয়ারি ৪ জন, মার্চে ১ জন, এপ্রিলে ৬ জন, মে মাসে ৪ জন, জুন মাসে ৯ জন, আগস্ট মাসে ৮ জন, সেপ্টেম্বর মাসে ৮ জন, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ৫ জন করে এবং ডিসেম্বর মাসে জন মারা যান।
দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে; ঘটবেও। কেন তা রোধ করা যাচ্ছে না? আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

এসব রম্নখতে হবে? যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। সে মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয়, তবে তা মেনে নেয়া আরো কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিসি'তিও মোকাবেলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারো কাছেই কাম্য নয়। কয়েক মাস আগে খোদ জাতীয় সংসদে অনভিজ্ঞ ও অল্পবয়স্ক হেলপার বাস-মিনিবাস চালানোর ফলে দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানালেন যোগাযোগমন্ত্রী। তিনি বলেন গাড়ির সংখ্যা যে হারে বাড়ছে সে হারে দক্ষ চালক বাড়ছে না।

ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক অমূল্য প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক, শিশু, নববধূ-বরসহ পুরো বরযাত্রী, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা এমনকি সাবেক মন্ত্রীও এ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নিহত হওয়ার খবর আমরা পত্রিকার পাতায় প্রত্যক্ষ করেছি। যার একটিও সহজভাবে মেনে নেয়া যায় না। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর ঘটনা যেমন আমাদের ব্যথিত করে, তেমনিভাবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চরম অরাজক পরিসি'তির উদ্ভবও আমাদের মর্মাহত ও সত্মম্ভিত করে। আমরা এর আগেও বহুবার লক্ষ্য করেছি, সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি নিহত বা আহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিহতের ঘনিষ্ঠজন এবং সংশিস্নষ্ট এলাকার কিছু লোক রাসত্মায় নেমে রাসত্মা অবরোধ, হামলা, গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে এক বিশৃঙ্খল অবস'ার সৃষ্টি করেন।

এতে কার কী উপকার হচ্ছে তা আমাদের জানা নেই। তবে এর ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ ও নির্দোষ জনগণ যারা কোনোভাবেই এ দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। যে কোনো হত্যার বিচার আমরা চাই, তবে কোনো হত্যা বা দুর্ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশের জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়াকথ তা আমরা চাই না।
বিশ্ব স্বাস'্য সংস'ার মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা না গেলে আগামী ১০ বছরে এর পরিমাণ হবে দ্বিগুণ। সরকার আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

এর আগে ২০১৫ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা শতকরা ২৫ ভাগে নামিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। বিআরটিএ-এর মতে অবৈধ যানবাহন এবং অদক্ষ চালক দিয়ে গাড়ি চালানোর কারণেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। ১১ হাজার ৮শ' কিলোমিটার মহাসড়কের মধ্যে প্রায় সবটাই দুর্ঘটনা প্রতিরোধের দিক থেকে কার্যকর নয়। এ ছাড়া মহাসড়কে নিরাপদ চলাচলে ২০০৫ সালে গঠন করা হয় হাইওয়ে পুলিশ। বর্তমানে লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি দিয়ে চলছে হাইওয়ে পুলিশের কার্যক্রম।

হাইওয়ে কিছু কিছু পুলিশের ভূমিকা নিয়েও আছে প্রশ্ন। এক গবেষণায় দেখা যায়, নানা কারণে দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরযানে ১০০টি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটছে। উন্নত দেশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক হাজার মোটরযানে দুই দশমিক পাঁচ ভাগ থেকে তিন দশমিক পাঁচ ভাগ। অন্যদিকে আমাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার যানবাহনে ১৬৩ জন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। বুয়েটের এঙিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউট (আইআরআই) পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর ১২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হচ্ছে।

নিহতের ৮০ শতাংশের বয়স পাঁচ থেকে ৪৫ বছর। নিহতদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ পথচারী। যাদের ২১ শতাংশের বয়স ১৬ বছরের নিচে। দুর্ঘটনায় আহত ১৫ শতাংশ লোক মারা যায় ঘটনার ১৫ মিনিটের মধ্যে। দেশে ১৬ লাখ রেজিস্টার্ড গাড়ি রয়েছে আর লাইসেন্স পাওয়া ড্রাইভার রয়েছে মাত্র ১০ লাখ।

৪ লাখ ড্রাইভারের ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং ড্রাইভিং ট্রেনিং দেয়া ও তাদের জন্য লাইন্সেসের দরকার আছে। তা নাহলে প্রতিনিয়তই এভাবে অকাতরে ঝরবে আমাদের প্রাণ।
নিয়ম ভেঙে সামনের গাড়িকে ওভারটেক করতে যাওয়া, অদক্ষ ড্রাইভারের হাতে গাড়ি চালানোর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া, ড্রাইভারের অনুপসি'তিতে হেলপারের গাড়ি চালানোর উদ্যোগ গ্রহণ, গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা না করেই রাসত্মায় গাড়ি নামানো, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শাসিত্মর আওতায় না আনা এবং সর্বোপরি ট্রাফিক আইন না মানার কারণেই একের পর এক মর্মানিত্মক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সমন্বিত আনত্মরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আমরা আশা করি।


লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.