আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পথহারা বিএনপি...



৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে যতটা চাপের মধ্যে ছিল, উপজেলা নির্বাচনের পর তাদের সেটা থাকবে না বলেই মনে হচ্ছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রথম দফা উপজেলা নির্বাচনে মোট ৯৬টির মধ্যে ৪৩টিতে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি। ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনেও তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। পরবর্তী নির্বাচনগুলোতেও যদি বিএনপির এই
জয়ের ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ নিয়ে দলের মধ্যে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছে তা অনেকাংশে দূর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপির আন্দোলন সফল না হওয়ায় দলের মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যে, পেশাদার গবেষকদের নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে বিএনপি কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের বাইরে আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। ১৮ দলের বাইরে ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ এবং আসম আবদুর রবের জেএসডি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন চেয়েছে। এর বাইরে সিপিবি এবং বাসদও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু এই দলগুলো ১৮ দলীয় জোটের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি।

কেন এই দলগুলো দাবির সঙ্গে একাত্ম পোষণ করেও আন্দোলনে শামিল হয়নি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে বিএনপি। এছাড়া নাগরিক সমাজের বড় অংশই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে থাকার পরও কেন বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়নি, সেটাও বিএনপির অনুসন্ধানের বিষয়। বিদেশি কূটনীতিকরা রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছেন। বিএনপির সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করেছেন। কিন্তু তারা দাবি মানার জন্য সরকারের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করেছেন বলে বিএনপি মনে করছে না।

বিদেশিরা কেন কার্যকর ভূমিকা রাখলেন না এটাও বিএনপি বুঝতে পারছে না। সর্বশেষ বিএনপির প্রশ্ন, ঢাকা শহরে আন্দোলন কেন জমাট বাঁধল না। সারাদেশে আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়লেও রাজধানী ঢাকা ছিল তুলনামূলকভাবে শান্ত। ঢাকায় আন্দোলন প্রবল না হওয়ায় সারাদেশের আগুনে বস্তুত পানি ঢালা হয়েছে।
বিএনপি যে আয়নায় মুখ দেখতে চাচ্ছে, নিজেদের ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা খুঁজে বের করতে চাচ্ছে এটা ভালো লক্ষণ।

তবে শাকের পোকা বাছতে গিয়ে পোকা রেখে শাক ফেলে না দিলেই ভালো। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেছেন, যেসব প্রশ্নের জবাব খোঁজা হচ্ছে তার জবাব আমরা কম-বেশি সবাই জানি। গবেষণার খুব বেশি প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তারপরও দল যদি গবেষণা করে তাতে ক্ষতি কিছু নেই।
বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন কেন সফল হয়নি তার কারণ বিএনপি নেতারা যেমন কম-বেশি জানেন, দেশের মানুষেরও এটা সম্পূর্ণ অজানা কোনো বিষয় নয়।

বিএনপি একটি জনপ্রিয় ইস্যুতে আন্দোলন করতে গিয়ে আন্দোলনের নামে যে বাড়াবাড়ি করেছে দেশের মানুষ তা পছন্দ করেনি। আন্দোলনের নামে সারাদেশে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে তাতে মানুষ বিরক্ত বোধ করেছে। তাছাড়া জামায়াতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতাও বিএনপির জন্য সুবিধা বয়ে আনেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করাটা জামায়াতের মূল বিষয় ছিল না। জামায়াতের মূল টার্গেট ছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও মানবতাবিরোধী বিচারের কার্যক্রম বন্ধ করা।

এই জন্যই তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। এটা ছিল তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মারমুখী অভিযান অথচ বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তাদের আন্দোলনটিও জামায়াতের হাতে তুলে দিয়েছিল।
তাদের জামায়াত নির্ভরতার কারণেই ১৮ দলীয় জোটের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আন্দোলনের সঙ্গে
একাত্ম হতে পারেনি। আন্দোলনের প্রশ্নে দেশের মানুষের প্রকৃত মনোভাবও বিএনপি নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি। মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর নানা কারণে ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট ছিল ঠিকই কিন্তু ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের মাধ্যমে ওই সরকারের পতন বা ক্ষমতাচ্যুতি চায়নি।

আওয়ামী লীগকে সরিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করার গরজ বোধ করেনি কোনো রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষ। কারণ বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে দেশবাসীকে যে শাসন উপহার দিয়েছিল সেটাও মানুষ পছন্দ করেনি। যেসব কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের নিন্দা-সমালোচনা করা হয় তার সবকিছুই বিএনপিও করেছে। ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলে বিএনপি সেসবের পুনরাবৃত্তি করবে না এমন কোনো অঙ্গীকার তারা করেনি এবং মানুষও মনে করেনি যে, আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো কিছু বিএনপি করবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নেও বিএনপির অবস্থান ছিল অস্পষ্ট।

তারা একদিকে বলেছে বিচার চায়, অন্যদিকে জামায়াতের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছে যাতে মানুষ মনে করেছে বিএনপিও জামায়াতের মতো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে।
বিএনপিকে যদি আত্মসমালোচনা করতে হয় তাহলে তাদের অনেক বিষয়েই রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। না হলে তাদের বর্তমান যে অবস্থা তা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে না। বিএনপি তার দৃষ্টিশক্তি প্রসারিত করবে, সত্য উদ্ঘাটনের পথে বেশি দূর অগ্রসর হবে নাকি ঘুরেফিরে পুরনো বৃত্তেই ঘুরপাক খাবেÑ তার ওপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যতে এই দলের প্রতি মানুষের আস্থা কতটুকু বাড়বে বা কমবে।
দুই. আইন মেনে চলা ঠিক কি ভুল? সবাই এক বাক্যে বলবেন, ঠিক।

কিন্তু আইনের থাবায় যদি রাস্তার আশপাশে ঝুপড়ি বানিয়ে যারা মাথা গুঁজে বসবাস করেন, যখন তাদের উচ্ছেদ করা হয়, তখন সেটা সমর্থন করেন না অনেকেই। মিথ্যে বলা খারাপ অথচ আমরা কি এটা দাবি করতে পারি যে, জীবনে, কখনো, কোনো সময় আমরা একটিও মিথ্যা বলিনি। মিথ্যা বলা কারো কারো স্বভাব হলেও জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন সত্য এড়িয়ে না গিয়ে উপায় থাকে না। যেমন বিপন্ন বন্ধুকে বিপদ থেকে বাঁচাতে অথবা মরণাপন্ন রোগীকে সান্ত্বনা দিতে যখন মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় তখন সেটাকে কি আমরা খারাপ বলে ধরে নেব? এমন নানা প্রশ্ন বা চিন্তা রোজ আমাদের ভাবিয়ে তোলে। ঠিক-ভুল, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করতে হয় নানাভাবে।

কখনো ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে, কখনো বাবা-মা-শিক্ষক-বিশিষ্টজনদের শেখানো কথা থেকে, কখনো নিজের বুদ্ধি দিয়ে আমরা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। এই উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দর্শনের একটা শাখাই গড়ে উঠেছে। তার নাম এথিকস বা নীতিবিদ্যা। যখন থেকে ঠিক করতে হয়েছে মানুষকে কী কী আইন মেনে চলতে হবে, না মানলে পেতে হবে কী কী শাস্তি, তখন থেকেই নীতির প্রশ্নে তর্ক জমে উঠেছে। যেমন ধরা যাক, প্রাচীন গ্রিসে সক্রেটিসের বন্ধু সিফেলাস বলেছেন, মানুষের টাকা-পয়সা থাকা ভালো, তাহলে সে অন্যকে ঠকায় না।

যার যা প্রাপ্য, তাকে তা দিতে পারে। সক্রেটিস বলেছেন, তাহলে তুমি ন্যায় (জাস্টিস) বলতে বোঝ, যার যা প্রাপ্য তাকে তা দেওয়া? ধরা যাক, তোমার বন্ধু তোমার কাছে কিছু অস্ত্র জমা রেখেছে। তারপর সে পাগল হয়ে গেল। এই অবস্থায় তোমার কাছে অস্ত্র ফেরত চাইলে তুমি কি তাকে ফেরত দেবে? অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ন্যায়ের সঙ্গে যুক্তির প্রশ্নও সামনে আসছে। আর এক সঙ্গী উত্তর দিচ্ছেন, তা কেন? যার যা প্রাপ্য তাকে তাই দেওয়াই হলো ন্যায়।

বন্ধুর প্রাপ্য সহায়তা, আর শত্রুর প্রাপ্য শত্রুতা। আবার আরেক সঙ্গী বলেন, ছেঁদো কথা ছাড়ো। আসলে, যার হাতে ক্ষমতা, সেই ঠিক করে কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়। অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায় বোধটাও সময় সময় বদলে যায়। জীবনের নানা ক্ষেত্রে বারবার এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় প্রতিদিন।

ডাক্তারকে ভাবতে হয়, মরণাপন্ন রোগীকে কি স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার দেওয়া যেতে পারে? বিজ্ঞানীকে চিন্তা করতে হয়, ক্লোনিং করে নতুন জীবন সৃষ্টি করা কি ঠিক? আইনজীবীকে ভাবতে হয়, আইন মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা রাখলেও, সত্যিই তার প্রয়োগ করা সমাজের পক্ষে কি ভালো? শিল্পপতি যখন কারখানা গড়ে তুলতে চান, পরিবেশবিদ আপত্তি করেন, তখন সেটা নীতির প্রশ্নই বটে, যার পোশাকি নাম ‘ইকোলজিক্যাল এথিকস। ’ পুলিশ বা সব রাষ্ট্রের বৈধ অন্য সব সশস্ত্র সংস্থার সদস্যকে মানবাধিকারের কথা নিয়ত মাথায় রাখতে হয়, তাও কিন্তু নীতির কারণেই।
তার মানে ভুল-ঠিক, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় নিয়ে বিতর্ক সমাজের একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর শেষ নেই। এখন একজন যেটাকে ভালো বা যুক্তিপূর্ণ বলে মনে করছেন, অন্য সময় তিনিই যে তার অবস্থান পরিবর্তন করবেন না তা-ও জোর দিয়ে বলা যায় না।

যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের ন্যায়নীতি বোধের সঙ্গে যারা বিরোধী দলে থাকেন তাদের ন্যায়নীতি বোধের পার্থক্য সহজেই লক্ষ্য করা যায়। এ বিরোধ যেন শেষ হওয়ার নয়, বিশেষ করে আমাদের দেশে যেখানে গণতন্ত্র এখনো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। বিরোধী দলে থাকলে যারা সরকারি দমন-পীড়ন-অত্যাচারের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ থাকেন, ক্ষমতায় গিয়ে তারাও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন পরমানন্দে। স্ববিরোধিতা কোথায় নেই? গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে যাদের মুখে ফেনা তুলতে দেখা যায় তাদের মধ্যেই দেখা যায় পরমতসহিষ্ণুতার বড় অভাব। কারো প্রতি কারো শ্রদ্ধাবোধ নেই।

গণতন্ত্রের কথা যেসব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে বেশি শোনা যায় সেই দলগুলোর মধ্যেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতি চর্চার অভাব সবচেয়ে বেশি। রাজনৈতিক দলের শীর্ষপদে একবার কেউ বসলে তিনি আমৃত্যু সে পদ আঁকড়ে থাকেন। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকাতেই দেশে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না, গণতন্ত্রও বিকশিত হচ্ছে না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.