আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পথহারা বিএনপি, সরকারে তলিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ

কৌশল নির্ধারণে বারবার ব্যর্থতা, তৃণমূল জাগলেও ঢাকার সাংগঠনিক বিপর্যয়, দলের অভ্যন্তরে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস সব মিলিয়ে আন্দোলনের ব্যর্থতার পথে সরকারবিরোধী প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি রীতিমতো পথহারা। বিভ্রান্ত। অন্যদিকে শাসক আওয়ামী লীগ তলিয়ে যাচ্ছে সরকারে। দল ও সরকার একাকার হয়ে যাচ্ছে। সাংগঠনিক অবস্থা লেজে-গোবরে।

সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ইতিবাচক হলেও মাঠকর্মীদের উন্মাসিকতায় আর দুর্নীতি সুশাসনকে করছে বাধাগ্রস্ত। অতি আত্মবিশ্বাসে পথ হাঁটছেন নেতা-কর্মীরা। জেলায় জেলায় সম্মেলন নেই, কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে নেই সাংগঠনিক তৎপরতা। নির্বাচন বর্জন আর অংশগ্রহণের নাটকের মধ্য দিয়ে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় পতিত তৃতীয় রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির মাঠের শক্তি ও জনপ্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্নবিদ্ধ কিন্তু বৈধ নির্বাচনে গঠিত সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসলেও রাজনীতির মাঠে পার্টির শক্তি ক্ষয়িষ্ণু।

সরকারেও আছে, বিরোধী দলেও আছে। জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে তৈরি হওয়া দুটি স্রোতধারা এখনো এক মোহনায় মিলতে পারেনি। এরশাদের নির্বাচন বর্জনের ঘোষণার কারণে জাতীয় পার্টি যেমন সংসদে প্রায় শতাধিক আসন নিয়ে বিরোধী দলের কাতারে বসে মাঠে-ময়দানে শক্তি নিয়ে ছুটে বেড়ানোর সুযোগ হারিয়েছে, তেমনি এরশাদ হারিয়েছেন তার একচ্ছত্র ক্ষমতা। পার্টির চেয়ারম্যান হওয়া সত্ত্বেও, নেতা-কর্মী-সমর্থকরা তার প্রতি দুর্বল থাকলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি অনেককে বিভ্রান্তের পথে ঠেলে দিয়েছে, অনেককে দিয়েছে ক্ষমতাসীন শিবিরের দিকে আসক্তি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত নেতৃত্ব ও দল জামায়াতে ইসলামীর বড় নেতাদের গলায় কারা অন্ধকারে ফাঁসির রশি ঝুললেও, নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হলেও, সরকারের দমন-পীড়নের মুখে পতিত হলেও উপজেলা নির্বাচনে আলাদাভাবে ভোট লড়াই করে দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছে তারা ভালোই আছে।

উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ত্রিশের অধিক আসন লাভ করেছে। শতাধিক ভাইস চেয়ারম্যানে জিতেছে। ক্ষমতার কামড়াকামড়ি আর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত আওয়ামী লীগ-বিএনপির কর্মীরা যখন এলাকায় এলাকায় নিজ নিজ ক্ষমতার ছায়ায় সিন্ডিকেট গঠন করে জনবিচ্ছিন্ন হয়েছেন তখন গোপন সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে ধর্মের ইস্যু সামনে এনে অর্থের শক্তিতে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে জামায়াত। জানিয়ে দিয়েছে তৃণমূলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি থেকে তাদের সেই দূরত্ব অনেক কমে আসছে। উপমহাদেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াইয়ের মাধ্যমে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছিল।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই এ দলটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এ দলটির পরতে পরতে, নেতা-কর্মীদের শরীরে শরীরে জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামের জেল-জুলুমের গৌরবচিহ্ন লুকিয়ে আছে। ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ বৈধ জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে যে উপজেলা নির্বাচন দিয়েছিল শুরুতে ছিল তা প্রশংসিত। জাতীয় নির্বাচনের আগে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার প্রতিটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের করুণ পরাজয় গ্রহণ করে নিয়েছিল সেখানে প্রথম দফা অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে বৈরী ফলাফল দেখে অতি উৎসাহী নেতা-কর্মীদের কারণে, নির্বাচন কমিশনের চরম ব্যর্থতা আর মাঠ প্রশাসনের নির্লজ্জ চাটুকারিতার সুবাদে তৃণমূলের ভোটযুদ্ধের পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। শেষ দফার নির্বাচনে প্রকাশ্য দিবালোকে মাঠকর্মীদের উন্মাসিকতায় ব্যালট বাঙ্ েসিল মেরে জয় ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণে যে বিএনপি চারদিকে ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, ঘরে বাইরে ছিল সমালোচনার মুখে সেই তারাও এখন বলছে উপজেলায় সরকার যা দেখিয়েছে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলে এ ফলাফলই দেখতে হতো। তাই তারা সেদিন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যায়নি। আওয়ামী লীগ জোটের মিত্ররা যাদের প্রায় সবারই গণভিত্তি নেই বললে চলে, মুজিবকন্যার অাঁচল ধরে নৌকায় চড়ে জীবনে প্রথম সংসদ ও ক্ষমতার স্বাদ নিয়ে অতিমাত্রায় আওয়ামীবন্দনা করছেন, তাদের হিসাব বাদ দিলেও আওয়ামী লীগ নামের তৃণমূলবিস্তৃত দলটিকে জনগণ নিয়েই যে রাজনীতির পথ চলতে হবে তা কি ভুলে যাচ্ছে- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে? সরকার, প্রশাসন আর দল একাকার হয়ে পড়ছে। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলীয় কার্যালয়ে বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম।

ধানমন্ডির কার্যালয় আলো করে আছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং ১৪ দলের সমন্বয়ক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। ১৪ দলটাকে আনুষ্ঠানিকতার ধারায় মোহাম্মদ নাসিম তবুও ধরে রেখেছেন। না হয় ১৪ দল টেলিভিশনেও অদৃশ্য থেকে যেত। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আছেন, আশরাফুল ইসলাম নেই- এমন অবস্থায় অতীতে কোনো সাধারণ সম্পাদকনির্ভর সাংগঠনিক তৎপরতা চলেনি। সাংগঠনিক তৎপরতায় কী কেন্দ্রে, কী তৃণমূলে- তাকে ছুটে বেড়াতে হয় না, মাঠকর্মীদেরও দর্শন দিতে হয় না।

শেষ পর্যন্ত শেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচন গাজীপুরের ভরাডুবির মাত্রা কমিয়ে এনেছিলেন ওবায়দুল কাদের জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজমদের সঙ্গে নিয়ে। ধানমন্ডির কার্যালয়ে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে শেষের দুজন ছাড়া দক্ষতার সঙ্গে নিয়মিত বসে দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন আবদুস সোবহান গোলাপ। এখানে আহমদ হোসেন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এনামুল হক শামীম, মৃণালকান্তি দাস, এস এম কামাল হোসেনরা নিয়মিত বসছেন। মাঠকর্মীরা এমপি-মন্ত্রী সিন্ডিকেট নিয়েই আগের সরকারে যেভাবে ভেসেছিলেন সেখান থেকে এখনো উঠে আসতে পারেননি। উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ছড়াছড়ি বন্ধ করতে আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড ব্যর্থ হয়েছে।

দলীয়ভাবে ভোটযুদ্ধ নিলেও সর্বত্র দলীয়ভাবে প্রার্থী দিতে পারেনি। অনেক জায়গায় দলের করুণ পরাজয় দেখতে হয়েছে। যেখানে সিল মেরে প্রার্থী বিজয়ী করা হয়েছে সেখানে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও মানুষের ভোটাধিকার আদায়ের সংগ্রামের বর্ণাঢ্য অতীত ধূসর হয়েছে। আওয়ামী লীগ নামের দলটিতে হাইব্রিডদের আস্ফালন বিগত শাসনামলে যেমন রোধ করা যায়নি তেমনি এবারের হানিমুন পিরিয়ডেও আলাদা করা যায়নি। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত গণতান্ত্রিকভাবে কর্মীবান্ধব আদর্শবান গণমুখী সক্রিয় নেতৃত্ব নির্বাচনের সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠানের প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি।

একেক জেলায় দেড় যুগ ধরে সম্মেলন নেই। সেসব কমিটির অনেকেই কবরে শায়িত। অনেক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বয়স ৪০-৫০ বছর পার করেও জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঠাঁই পাচ্ছেন না। আত্দপরিচয়ের সন্ধানে অপেক্ষায় থাকতে থাকতে হতাশ। চোখের সামনে তাদের সতীর্থ বন্ধুরা বিএনপির জেলা পর্যায়ের বড় নেতা।

যুবলীগ-ছাত্রলীগ হাট-মাঠ-ঘাট টেন্ডারবাজি আর এমপি সিন্ডিকেটে থেকে সামাজিক প্রকল্প থেকে কামিয়ে নেওয়ার ফন্দি-ফিকিরে ব্যস্ত। এলাকায় এলাকায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন। অসুস্থ রাজনীতির প্রতিযোগিতার রাজপথে হাঁটতে না পেরে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন আদর্শবানরা ঘরে উঠে গেছেন। কমিটি বাণিজ্য, পদ বাণিজ্য রমরমা। এসব সংগঠনেও সম্মেলন নেই।

আহবায়ক কমিটি, আংশিক কমিটির নামে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সংগঠন। ছাত্ররা নেই ছাত্রলীগে। জেলা পর্যায়ে, উপজেলা পর্যায়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সম্মেলন নেই। তদবির বাণিজ্যে ছুটছেন আওয়ামী লীগ থেকে অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের মাঠকর্মীরা। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে নেই সাংগঠনিক সফরসূচি।

জনসভা, পথসভা নির্বাসিত। কর্মিসভাও কালেভদ্রে হয়। অধিকাংশ জেলা নেতৃত্ব কী আওয়ামী লীগ, কী যুবলীগ, কী অন্য সহযোগী সংগঠন- বেশির ভাগ সময় থাকেন ঢাকায়। বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত, সুবর্ণ সময়ে কামিয়ে নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া না করার জন্য ভাগ্যবদলের চেষ্টায় এতই ব্যতিব্যস্ত যে সংগঠন হয়ে পড়েছে স্থবির, নড়বড়ে। বিপর্যয় এলে রাজপথে নামার বা রাজনৈতিকভাবে মানুষ দূরে থাক কর্মীদের নিয়ে নামবার শক্তিও থাকবে না বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।

সরকারের অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, সামাজিক কর্মসূচি স্বচ্ছতার সঙ্গে হচ্ছে কি না তা নিয়ে বিরোধীদের প্রচার থাকলেও সরকারি দলের কর্মীদের সেই অপপ্রচারের জবাব দিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চিত্র জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কোনো চেষ্টা নেই। আওয়ামী লীগ নামের দলটি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সাফল্য অর্জন না করায় এ অবস্থা। রীতিমতো সরকারের আশ্রয়ে চলছে আওয়ামী লীগ। শনিবার দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসছে। উপজেলা নির্বাচনের দোহাই দিয়ে জেলা সম্মেলন স্থগিত রাখা হলেও এ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সাংগঠনিক কর্মসূচি ও জেলা সম্মেলন আর মাঠ পর্যায়ের ছাত্রলীগ-যুবলীগকে পথ দেখানোর কর্মসূচি নেওয়া হবে কি না সে প্রশ্ন রয়েছে।

দীর্ঘদিন পর ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে সমন্বয় করে দলের সহ-সম্পাদক পদ পূরণ করায় সাবেক ছাত্রলীগের অনেক নেতাই ঠাঁই পেয়েছেন। এ কমিটি দেওয়ায় তাদের উপস্থিতিতে ধানমন্ডির কার্যালয় সন্ধ্যাবেলায় সরগরম হচ্ছে। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষিত না হওয়ায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কার্যালয়ে নীরবতা। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগকে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা একসময় দলের হৃৎপিণ্ড বললেও সেটিতে এখন ঠিকমতো হার্টবিট খুঁজে পাওয়া যায় না। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে দলের মন্ত্রীদের নিয়মিত বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর কার্যালয়ে বসে কর্মীদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিলেন।

বিগত সরকার থেকে তারও পুনরাবৃত্তি ঘটছে না। ঢাকার পরেই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শক্তির উৎস ছিল নারায়ণগঞ্জ। ডাক পাঠালেই নেতা-কর্মীরা ছুটে এসে পল্টন উত্তাল করে দিতেন। সেই নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের কমিটি নেই! ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিএনপির একমাত্র রাজনৈতিক ইস্যু ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সেই বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঘাম ঝরিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে দেওয়া দাবার চালে।

একের পর এক ইস্যু ঠেলে দিয়েছেন আর বিএনপি নেত্রী গোলপোস্ট খুঁজতে খুঁজতে তার দল নিয়ে ক্লান্ত হয়েছেন। দফায় দফায় আলটিমেটাম, কখনো বা হেফাজতে ইসলাম, মাঝেমধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবি বিতর্কের চোরাবালিতে ডুবেছে বিএনপি। অন্যদিকে মানি লন্ডারিং ও দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার রায় বিএনপির জন্য নেতিবাচক বিতর্কের সৃষ্টিই করেনি একটিতে নির্বাসিত জিয়া পরিবারের উত্তরাধিকার তারেক রহমানকে বিতর্কিত করেছে। দেশি-বিদেশি সব মহলের আপত্তির মুখে লাগাতার সংসদ বর্জন, অন্যদিকে সরকারের দমননীতির মুখে রাজপথে আন্দোলন দাঁড় করাতে না পারলেও বিএনপি সিটি নির্বাচনে ঈর্ষণীয় ভিক্টরি দেখিয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব মহলের মনোভাব ধারণ না করে প্রধানমন্ত্রীর গণভবনের দাওয়াত কবুল না করে ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে শেষ ভুলটি করেছে।

যে সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে যাবে না বলেছে, যে সরকারকে অসাংবিধানিক অবৈধ বলেছে সেই সরকারের অধীনে উপজেলা নির্বাচনে গিয়ে স্বীকৃতিই দেয়নি, মানুষ হাসিয়েছে, কর্মীদের হতাশ করেছে। বারবার পথহারা বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রশ্নে তাদের অবস্থান অনড় রাখতে পারেনি। নির্বাচনের আগে ২৯ ডিসেম্বরের মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিতে শত বাধা অতিক্রম করে মাঠের বিএনপি নেতা-কর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে পথে পথে তল্লাশি ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় এলেও ঢাকার নেতৃত্ব ও সংগঠন বিশ্বাসঘাতকতার চোরাবালিতে দলের গোটা আন্দোলন ডুবিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে সরকারের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে নির্বাচনের বাইরে থেকে বিএনপি নামের দলটি সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজনীতিতে সাংবিধানিক বিরোধী দলের মর্যাদাটিও হারিয়ে ফেলেছে। নির্বাচনের আগে দলের নেতা-কর্মীদের যখন ইস্পাতকঠিন ঐক্য জরুর সে সময়ে লন্ডন থেকে তারেক রহমানের বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে দলের ক্লিনম্যান ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্পর্কে কথোপকথন দলীয় নেতৃত্বের দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করেছে।

কর্মীদের হতাশ করেছে। সরকারি দলকে উৎফুল্ল করেছে। বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে তার অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। সরকারের ছুড়ে দেওয়া উপজেলা নির্বাচনের গোলপোস্টে ছুটে গেছে। এখন বলছে উপজেলা নির্বাচনে সরকার কারচুপি করেছে।

যেন জাতীয় নির্বাচন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠেছে। মাঝখানে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে বেফাঁস বলে বসলেন, 'বঙ্গবন্ধু নয়, জিয়াউর রহমানই দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক'। তার বক্তব্য যখন বিতর্কের ঝড় তুলল তখন সাংবিধানিকভাবে তিনবার ও গণরায়ে দুবার নির্বাচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলে বসলেন, 'জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক ও বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি'। ইতিহাসের মীমাংসিত সত্য অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে যুদ্ধে অংশ নেওয়া সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান যিনি স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকারের কাছ থেকে বীরউত্তম খেতাব পেয়েছিলেন এবং ওই সরকার তাকে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ পদে নিয়োগ দিয়েছিল, সেই বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকেও খাটো করেছেন। নিজেকেও প্রশ্নের মুখে পতিত করেছেন।

রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ও ব্যর্থতার হতাশাগ্রস্ত নেতৃত্বের করুণ আর্তনাদ বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে উচ্চারিত হয়েছে। দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি কখনো পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান যে হয় না এ সত্য শিশুরাও জানে। ফালতু বিতর্ক আর ইস্যুর মধ্যে নিজেদের ডুবিয়ে রাখতে গিয়ে বিএনপি রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। নেতা-কর্মীরা জেল খাটছেন, মামলা গুনছেন, আর হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছেন কর্মীরা। দেশের রাজনীতি প্রাণহীন হচ্ছে।

সরকার বিএনপির ব্যর্থতার কারণে অতি আত্দবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে আর নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবে ৫ জানুয়ারির ট্রেনে না চড়তে পেরেছে, না ট্রেনটিকে আটকাতে পেরেছে। ভবিষ্যতে আন্দোলন করবে সেই শক্তি কোথায় এ প্রশ্ন এখন বিএনপির সর্বস্তরে। ঢাকা মহানগরে নেতৃত্বের সন্ধানে খালেদা জিয়া যখন আলোর ইশারা দেখছেন না তখন রমজানের পর আগামী শীতে শক্ত আন্দোলন দাঁড় করাবেন সে সম্ভাবনা পর্যবেক্ষকদের খাতায়ও নেই। দলের অভ্যন্তরে না আছে গণতন্ত্র, না আছে মাঠের নেতা-কর্মীদের কদর।

গুলশান কার্যালয়ে একসময়ের বিএনপির মাঠের প্রাণ খালেদা জিয়া একদল সাবেক সরকারি কর্মকর্তার তুলে দেওয়া কালো কাচের ঘরে পড়ে আছেন। ছাত্রদল-যুবদল প্রাণহীন। বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দুনিয়ার আস্থা হারিয়ে পশ্চিমাদের হাত যেভাবে ধরেছিলেন ৫ জানুয়ারির পর বুঝেছেন তা কত পিচ্ছিল। এখন বিএনপি জিগির করছে উপজেলা নির্বাচনের ভোট ডাকাতি নিয়ে। সামনে হাঁটতে হবে পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচন নিয়ে।

বিগত বছরের শেষ দিকে হরতাল, সহিংস অবরোধের রাজনীতি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে যে স্থবিরতা ও ক্ষতি এনে দিয়েছে তাতে আন্দোলনের পক্ষে কোনো মহলই সায় দেবে না। এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে তৃণমূল নেতৃত্বকে মামলায় মামলায় আদালতপাড়ায় ঘুরতে হবে। পর্যবেক্ষকদের মতে, কাউন্সিল আর সম্মেলনে গণতান্ত্রিকভাবে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দলের নেতৃত্ব ঢেলে সাজিয়ে, পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস পেছনে ফেলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কর্মীনির্ভর দল নিয়েই বিএনপি নেত্রীকে দেশজুড়ে জনসংযোগে নামতে হবে। মানুষের মাঝে এখনো বিএনপির শেষ শাসনামলের কলঙ্ক মুছে যায়নি। সিটি ও উপজেলা নির্বাচনের সুফল আওয়ামী লীগ শাসনের ব্যর্থতারই অর্জন।

আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করলে তাদের হারানো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে আরও বেকায়দায় পড়তে হবে।

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.