ক্রিকেট নামের খেলাটি বাংলাদেশকে সব সময় সুখের করে রাখে। দেশে ক্রিকেট উৎসবকে বরণ করে নেওয়ার জন্য বড় একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ বিভিন্ন বয়সের মানুষ ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ক্রিকেটের উৎসব অনেকের এই দিন প্রতিদিনের ছকে অাঁটা জীবনকে এলোমেলো করে দেয়। আমাদের সমাজে লক্ষ্য করি উত্তেজনাময়, আনন্দঘন, পাশাপাশি অনিশ্চয়তায় ভরপুর ক্রিকেটের উৎসবের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড উৎসাহ এবং উদ্দীপনা! হয়তো জীবনের সঙ্গে ক্রিকেটের এক অদ্ভুত মিলের একটা কারণ!
ক্রিকেট আমাদের সমাজে অনেক গভীরতার মধ্যে তার স্থান করে নিয়েছে। পরিণত হয়েছে একটা সংস্কৃতিতে।
সামাজিক জীবনে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ক্রিকেট এখন একটা ফ্যাক্টর।
আমাদের দেশে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মহোৎসব। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট হলো চরম উত্তেজনা আর বিনোদনে ঠাসা। স্বল্প সময়ের মধ্যে অধিক বিনোদন লাভের ক্রিকেট। রক্তে আগুন ধরানোর ক্রিকেট।
চুটিয়ে খেলার এই ক্রিকেটে তাৎক্ষণিক উত্তেজনার স্বাদ মেলে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট তার অনুরাগীদের জাগিয়ে রাখে, প্রজ্বলিত করে রাখে! ক্রিকেট দর্শকরা নগদ সওদার খরিদদার। তাদের একমাত্র লক্ষ্য উত্তেজনা। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট এটা উজাড় করে দেয়। আনন্দের আস্বাদ কি জিনিস তা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট উপভোগ করলে বোঝা যায়।
অঘটন আর অপ্রত্যাশিত ফলাফল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে করেছে আকর্ষণীয় এবং প্রাণবন্ত। এই খেলার মাঠে বড় রাজা এবং ছোট রাজার মধ্যে পার্থক্য নেই। দিনের খেলায় সবাই রাজা! যে কেউ নিজের দিনে খেলে মাঠ জয় করতে পারে। প্রত্যেকেরই সম্ভাবনা আছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। ক্রিকেটের এই নতুন সংস্করণ ঝিমিয়ে পড়া ক্রিকেট চত্বরে শুধু প্রাণের সঞ্চার সৃষ্টি করেনি, চেহারাও পাল্টে দিয়েছে।
ক্রিকেট বিশ্বের দৃষ্টি এখন আমাদের বাংলাদেশে নিবদ্ধ। ১৬টি দেশকে নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পুরুষদের। এরপর পাশাপাশি ১০টি দেশ নিয়ে (শুরু হবে ২৩ মার্চ) মেয়েদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ক্রিকেট বিশ্বের এই জমকালো উৎসব সাঙ্গ হবে আগামী ৬ এপ্রিল। ক্রিকেটের টান টান উত্তেজনার জ্বরে ভুগবেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ! তিন সপ্তাহ ধরে ক্রিকেটের আলোচনা সবার উপরে স্থান পাবে।
পুরুষদের প্রাথমিক পর্বের পর ১০টি দেশ নিয়ে শুরু হবে সুপার টেনের খেলা। এ পর্বে ক্রিকেট হবে সত্যি রোমাঞ্চকর এবং ক্লাইমেঙ্ েভরপুর।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের উদ্ভাবন হয়েছে সময়ের দাবি, প্রয়োজনের তাগিদ, খেলাটিকে এক ধরনের মহামন্দার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ক্রিকেটকে আকর্ষণীয় এবং উত্তেজনাময় করার জন্য। পাশাপাশি গরম গরম বিনোদনের মাধ্যমে বাণিজ্য।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্মের পেছনে যে বিশেষজ্ঞের নামটি ক্রিকেট ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে তিনি হলেন স্টুয়ার্ড রবার্টসন।
তিনি ছিলেন ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের মার্কেটিং ম্যানেজার। খোদ ইংল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেট মাঠে দর্শক ক্রমেই কমছিল। পাঁচ দিনের খেলায় কিছু বুড়োবুড়ি ছাড়া তরুণ দর্শকের উপস্থিতি তেমনভাবে লক্ষণীয় হচ্ছিল না। কাউন্টি ক্রিকেট এবং ওয়ানডে ক্রিকেটেও একই অবস্থা। ব্যস্তময় জীবনে এত সময় ধরে ক্রিকেট উপভোগের সুযোগ কোথায়।
এর ফলে টিকিট বিক্রি কমতে শুরু করে। স্পন্সররা উৎসাহ হারিয়ে ফেলছিল। টিভি স্বত্ব থেকে আয় ক্রমেই কমে যাচ্ছিল। দর্শক মাঠে না এলে তো কিসের ক্রিকেট! খেলা চালানোর জন্য খরচ নিয়ে ভাবা শুরু হয়েছিল। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্টুয়ার্ড বরার্টসন দীর্ঘদিন ধরে তার টিম নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন।
ব্যাপকভাবে মার্কেটিং সার্ভে এবং রিসার্চ ওয়ার্ক করার পর নতুন ফরম্যাটের ক্রিকেটের প্রস্তাব দেন। ইসিবির সভায় এই প্রস্তাব ১১-৭ ভোটে পাস হয়। এর পর প্রথম টোয়েন্টি টোয়েন্টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ২০০৩ সালের ১৩ জুন ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটনে। প্রথম ম্যাচে হ্যাম্পশায়ার সাসেঙ্কে ৫ রানে পরাজিত করে। প্রথম ম্যাচে দর্শক বেশি ছিল ১৬ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে।
মাত্র এক দশকের মধ্যেই ক্রিকেট মাঠে প্রাণ ফিরে এসেছে। যারা ক্রিকেট থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন তারা ফিরে এসেছেন। ক্রিকেটকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে উন্মাদনা, ক্রিকেটে আবেগ এবং উচ্ছ্বাসকে কাজে লাগিয়ে শতভাগ বাণিজ্যিকীকরণ, ক্রিকেটারদের অকল্পনীয় আয়ের সুযোগ, টিভিতে ক্রিকেট বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে বুঁদ, বহুজাতিক ব্যবসায়ীদের ক্রিকেট ব্যবসা থেকে লাভ করার ক্ষেত্রে নেশায় চুর করে রাখা- এসব কাজ বড় সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছে স্বল্প সময়ের খেলা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লীগ এখন ক্রিকেট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। বিশ্ব ক্রিকেট সমাজের দৃষ্টিতে আগামী দিনের ক্রিকেট- টি-টোয়েন্টি।
প্রথম দিকে যারা এই ক্রিকেট নিয়ে নাক সিটকিয়েছেন। বলেছেন এটা আবার একটা ক্রিকেট হলো। বিরুদ্ধাচরণ করেছেন তারাও এই ক্রিকেটের মিছিলে এসে যোগ দিয়েছেন।
অনেকের ধারণা কুড়ি কুড়ি ক্রিকেট মানেই বলে বলে চার বা ছক্কা হাঁকানো। তারপর আউট হয়ে যাওয়া।
মাঠে বোলার আর ফিল্ডারদের উল্লাস। ব্যাপারটা অত সহজ নয়। পুরো বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আস্কিং রেট, বোলারদের মাথা খাটিয়ে ডট বল আদায় করে নেওয়া, উইকেট হাতিয়ে নেওয়া এবং ত্বরিতগতিতে ফিল্ডিং। খেলাটা পুরোপুরি বিজ্ঞান এবং অঙ্কের। পরিকল্পনার মোড়কে মোড়ানো।
হিসাবে ভুল করলেই সব শেষ। এক দুই ওভারের রান বা উইকেটের পতন খেলার রঙ পাল্টে দিতে পারে।
ক্রিকেটের সেই ব্যাকরণ হয়তো সব সময় মাঠে দেখা যায় না। কিন্তু মাথা খাটিয়ে আনা হয়েছে এই ক্রিকেটে নতুনতর প্রকরণ। ইমপ্রোভাইজেশনের বদৌলতে এখন সব খবর দেখতে পাচ্ছি- যা আগে কখনো দেখিনি।
বোলারদের ভূমিকায় এসেছে পরিবর্তন। তারা মাথা খাটিয়ে বল করছেন। কেউ ছাড় দিতে রাজি নন। বোলারদের হিসাব কষেই বল করতে হচ্ছে। ফিল্ডিংয়ে এসেছে গতি।
তড়িতায়িত ফিল্ডিং। সাংঘাতিক শারীরিক সক্ষমতা সবার। সবাই ফিজিক্যালি ফিট।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সব সময়ই নতুন উদ্ভাবন লক্ষণীয় হচ্ছে। এতে বাড়ছে ক্রিকেটের আকর্ষণ।
বাড়ছে বিনোদন। ক্রিকেটে বাড়ছে পেশাদারি দক্ষতা। আমাদের দেশে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মাঠে আরও নতুন নতুন উদ্ভাবন দেখার আশায় আছি। যা ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করবে। খেলার আকর্ষণকে আরও বাড়িয়ে দেবে।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।