সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কতটা শক্তিশালী –ফেসবুকের নতুন করে এটা প্রমাণের আর কিছু বাকি নেই। টুইটার_ফুইটার, লিংকড ইন_ফিংকড ইন; ফেসবুকের ধারে কাছেও কেউ নেই। কিন্তু এই সামাজিক যোগাযোগ ছাড়াও ফেসবুক অনেক ‘অতিওয়েবসাইটিয়’ কাজ করে যাচ্ছে, যেগুলোর খবর অনেকেই হয়তো জানেন না।
Pennsylvania -র Stephanie Phillips তাঁর মাকে হারিয়ে ফেলেছিলেন ৫০ বছর আগে, খুঁজে পেয়েছেন ফেসবুকের মাধ্যমে। Oregon-এর Don Gibson তাঁর ছেলে ও স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলেছিলেন ২১ বছর আগে, খুঁজে পেয়েছেন ফেসবুকের মাধ্যমে।
Indonesia -র Nurlianti Dehi তাঁর ভাইকে হারিয়ে ফেলেছিলেন ৩৫ বছর আগে, পাইয়ে দিয়েছে ফেসবুক। খুঁজলে এরম হয়তো আরও অনেক পাওয়া যাবে।
মজার ব্যাপার হলো… ফেসবুকের মাধ্যমে হারানো প্রিয়জনকে খুঁজে পাওয়াদের তালিকায় আমারও নামটা যুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু নীরবে, নিভৃতে।
সময়টা ’৯৭-’৯৮ সালের দিকে, আজ থেকে ১৫-১৬ বছর আগে।
তখন আমি ক্লাস সিক্সে। অজ পাড়াগাঁয়ের এক স্কুলে প্রাইমারী শেষ করা এই আমি হাইস্কুলে উঠে পরলাম মহাফ্যাঁসাদে। চারপাশে সব চটপট কথাবলা মহা স্মার্ট ছেলে। আর আমি? স্মার্টনেস তো অনেক দূর... তখন শুদ্ধকরে বাংলা বলতেই আমার নাভিশ্বাস্য উঠে যেত। বন্ধুহীন আমি ক্লাসের এককোনার চুপচাপ বসে আমার স্মার্ট ক্লাসমেটদের চটপটে শুদ্ধ বাংলা মুগ্ধ হয়ে শুনে থাকতাম।
তারা কেউ আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে আসতো না আর আমি তো তাদের সাথে কথা বলার-ই সাহস পেতাম না। সেই সময় আত্মবিশ্বাসহীন-একা, ১১-১২ বছর বয়েসী একটা ছেলের জন্য খুব সম্ভবত ঈশ্বরেরও মন গলে গিয়েছিল। তা না হলে একসাথে দু’দুজন চটপটে-শুদ্ধ বাংলাভাষী বন্ধু পেয়ে গিয়েছিলাম কেমন করে? ক্লাসে আমি একসাথে দু’দুজন বন্ধু পেয়ে গেলাম। ওরা ছিল দুই ভাই। জমজ ভাই।
একই রকম উচ্চতার এবং প্রায় একই রকম দেখতে। আর “siblings are the best friends” আপ্তবাক্যটা সত্য প্রমাণ করে ওরা দুইভাই ক্লাসে সবসময় বসতো এক ব্রেঞ্চে, একসাথে। আমার মত প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসহীন একটা ছেলে শুদ্ধকরে বাংলা বলার আত্মবিশ্বাসটুকু অর্জন করতে পেরেছিল ওই দুই ভাইয়ের সাথে মিশে। অজ পাড়াগাঁয়ের ‘আনকালচার্ড’ এই আমাকে ওরা দু’জন খুব সহজে বন্ধু করে নিয়েছিল।
ওই দুইভাইয়ের প্রতি আমার ভালোবাসা আরও অনেক পরিমাণে বেড়ে গেল যখন শুনলাম ওরা দু’জন পুলিশের ছেলে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে- ছোটবেলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলনা ছিল বন্দুক। কান্তজীমেলা বাড়ির কাছে সবচেয়ে বড় মেলা। ভাল ভাল বন্দুক গুলো শুধু সেখানেই পাওয়া যেত। এই মেলার জন্য আমি সারা বছর ধরে অধীর অপেক্ষায় থাকতাম। মনে আছে একবার কান্তজী মেলার ভিড়ে রেগেমেগে হারিয়ে গিয়েছিলাম বাবা বন্দুক কিনে দিতে চাননি বলে।
ছোটবেলায় মারণাস্ত্রের প্রতি ছিল আমার এমন-ই প্যাশন । ক্লাস সিক্স পড়ুয়া একটা ছেলের বন্দুক নিয়ে খেলার বয়েস থাকে না সত্যি কিন্তু বাল্যপ্রেমের মত বাল্যকালের প্রিয় খেলাটাও কখনো ভুলা যায় না বলে বন্দুকের প্রতি ভালোবাসাটা আমার তখনও অটুট ছিল। খুব সম্ভবত এইজন্যই-একজন অরিজিনাল বন্দুকঅলার দুইছেলে আমার বন্ধু এই ভেবে নিজেকে নিয়ে আমি খুব গর্ব বোধ করতাম। কিন্তু আমার গর্ববোধ খুব বেশিদিন স্থায়ী হল না। একসময় ওরা দু’জন স্কুলে আসা ছেড়ে দিল।
দিন যায় মাস যায় ওদের দু'জনের কারওই দেখা নেই। পরে জানলাম ওদের পুলিশ বাবা অন্যখানে বদলী হয়ে গেছেন। আমাকে ক্লাসের অন্য স্মার্ট ছেলেদের সাথে শুদ্ধবাংলা বলার আত্মবিশ্বাস যোগাড় করে দিয়ে ওরা দু’জন কোথায় যেন হারিয়ে গেল। এরপর আমিও আর কাউকে ওদের কথা জিজ্ঞেস করি নি। জিজ্ঞেস করি নি কারণ ওদের দু’জনের খবর কেউ বলতে পারবে এই আশা-ই আমি কখনও করি নি।
আমার সবচেয়ে বড় ‘গাধামীটা’ ছিল সেখানেই। সপ্তাহখানেক আগে [১৫-১৬ বছর পর] ওদের কথা প্রথম বললাম রতনকে। ওদের নামগুলো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু মহাকার্যকর Hints একটা ছিল-“পুলিশের ছেলে”। আমাদের ক্লাসমেটদের মধ্যে আর কোন পুলিশের ছেলে ছিল না।
ওদের দু’জনের কথা রতনকে বলা মাত্র আমাকে মহাবিষ্মিত করে দিয়ে রতন বলে উঠল, ‘হুম… মাসুম আর মিজান। মাসুমের সাথে মাঝে মধ্যেই কথা হয়। দিনাজপুর সরকারী কলেজ থেকে এবার মাস্টার্স পরিক্ষা দিল। ’ আমি বিষ্ময়ে চোখ বিস্ফারিত করে বললাম, কী বলিস সত্যি!!! দিনাজপুরেই থাকে? আরেক জনের খবর কী?
রতন বলল, ‘মিজান এখন বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চাকুরীরত’। রতন এরপর আমাকে মাসুমের ফেসবুক লিংকটা দিল।
আমি ১৫ বছর আগে হারিয়ে ফেলা বন্ধুটাকে ‘বন্ধু রিকুয়েষ্ট’ পাঠালাম। সে আমার বন্ধু রিকুয়েষ্ট গ্রহণও করলো। দেখলাম মাসুম ফেসবুক প্রোফাইলে ওর মোবাইল নাম্বারটারও রেখেছে। ‘কে তুমি, চিনতে পারলাম না?’ -যদিও বন্ধু রিকুয়েষ্ট পেয়ে এরম কোন প্রশ্ন সে আমায় জিজ্ঞেস করে নি কিন্তু আমি নিশ্চিত সে আমায় চিনতে পারে নি। মেচুয়াল বন্ধু তালিকায় কিছু বন্ধু ছিল- আমার বন্ধু রিকুয়েষ্ট গ্রহন করার একমাত্র কারণ হয়তো সেটাই।
আমি এখন চাইলেই ওর ইনবক্সে বার্তা পাঠাতে পারি, ওর ফোনে কলও দিতে পারি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি ওগুলোর কিছুই করি নি। কারণ আমি নিশ্চিত ও আমাকে চিনতে পারবে না। পারার কথাও নয়। ফরহাদ, রনি, লাবু-দের টেক্কা দিয়ে আমি কখনোই ক্লাসের সেরা ছাত্র ছিলাম না।
অন্তর্মুখী আমি কখনো ক্লাসের বখাটে ছাত্রদের দলেও ছিলাম না। অন্যদিকে বন্ধুবাৎসল্য ওরা দু’জন গত ১৫ বছরে হয়তো ১৫ লক্ষ বন্ধু পেয়ে গেছে। আমার মত অন্তসার শূন্য একটা ছেলেকে মনে রাখার কোন কারণ নেই। মাসুম এখন আমার হোমটাউনেই আছে, মিজান চট্রগামে। মাসুমের সাথে আমি যখন তখন দেখা করতে পারি কিন্তু আমায় বেশী টানছে নৌবাহিনীতে কর্মরত মিজান।
কারণ আমি নিশ্চিত নৌবাহিনীওলাদের নিশ্চই অনেক বড় বড় বন্দুক আছে।
সুত্রঃ ১
২
৩।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।