মঈন চৌধুরী কবিতা লেখেন, প্রবন্ধ লেখেন, ছবি আঁকেন কিন্তু পেশায় একজন প্রকৌশলী। মঈন চৌধুরীর আরেকটি পরিচয় তিনি পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর মূল চিত্রকর্ম ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অনেক এন্টিক ও স্কাল্পচারের মূল কপি নিজের বাসায় সংগ্রহ করে রীতিমত এক অভুতপূর্ব গ্যালারি তৈরি করেছেন। এক সময় তিনি 'প্রান্ত' নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সম্পূর্ণ প্রচারবিমুখ কবিতায় মগ্ন নিভৃতচারী এই জ্ঞানতাপষ দেশি-বিদেশি সাহিত্য ও দর্শন পাঠে প্রচুর সময় দেন। পৃথিবীর অনেক দেশের স্থাপত্য-নিদর্শন পরিদর্শন ও প্রত্যক্ষ করায় তাঁর রয়েছে বিস্তর অভিজ্ঞতা ও নেশা।
সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, দেকার্ত, লাইবনিৎস, হেগেল, হাইডেগার, জাক দেরিদা, মিশেল ফুকো, ভিটগেনেস্টাইন সহ অনেক পৃথিবী বিখ্যাত দার্শনিকদের দর্শন তত্ত্বের উপর মঈন চৌধুরী রীতিমত গবেষণা করেছেন। তাঁর 'প্রবন্ধ সংগ্রহ' গ্রন্থটি দর্শন শাস্ত্রের বিভিন্ন প্যারাডাইম, জীবন-দর্শন আর নন্দনতত্ত্বের এক চমৎকার মিশেলে পরিনত হয়েছে।
এখন পর্যন্ত মঈন চৌধুরীর মোট দশটি প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো হল- 'সৃস্টির সিঁড়ি', 'বাঙাল জাতীয়তাবাদ', 'ফুকোর মানব', 'ভিটগেস্টাইনের দর্শন', 'ইহা শব্দ', 'অল্প স্বল্প হলুদ গল্প', 'শব্দের সম্ভবনা', 'বাংলাভাষার বানান সংস্কার', 'ভাষা, মনস্তত্ত্ব ও বাঙাল/বাঙালি সংস্কৃতি' ও 'প্রবন্ধ সংগ্রহ'। এর মধ্যে 'প্রবন্ধ সংগ্রহ' গ্রন্থে 'সৃস্টির সিঁড়ি', 'ইহা শব্দ', 'শব্দের সম্ভাবনা', মনস্তত্ত্ব, ভাষা ও বাঙাল সংস্কৃতি', 'বাংলাভাষার বানান সংস্কার', 'মঈন চৌধুরী-সলিমুল্লাহ খান আলাপ' ও 'মঈন চৌধুরী-আনু মুহাম্মদ আলাপ' বিষয়গুলো সংকলিত হয়েছে।
মঈন চৌধুরীর এ পর্যন্ত মোট আটটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো হল- 'এ কেমন ভালোবাসা', 'ইন্দ্রজালে আপেক্ষিক', 'জীবন শব্দ রেখা', 'কবিতা ও ড্রইং', 'প্লাবন ও অন্তবৃক্ষের গান', 'কমলার ফুল, জলপাই চাই', 'শব্দের পদ্মফুল' ও 'কবিতা সংগ্রহ'। এর মধ্যে 'কবিতা সংগ্রহ' গ্রন্থে কবি নিজের পছন্দের নতুন-পুরাতন ১৫২টি কবিতা নিয়ে সাজিয়েছেন।
মঈন চৌধুরীর কবিতায় নির্লিপ্ততা যেমন আছে, তেমনি আছে জীবনের গভীর হাট বাস্তবতার সারমর্ম। প্রলম্বিত যাদু বাস্তবতার আড়ালে কবি এক সুনিপুন তীর ছুড়ে জগতের অন্ধকারে যেনো এক আগুনের পরশমণির আর্তনাদ করেন।
সমসাময়িক জীবন বাস্তবতায় কবি শব্দ আর বাক্যের জাদুতে যেনো মনন ও নন্দনের মধ্যেই এক ভালোবাসার কুঁড়েঘর নির্মাণ করেন। সব ভুলে গেছি, জোৎস্নার অনুপাত, ত্রিশূল, দ্রোহের সাঁতার, তীরন্দাজ, চিহ্নের সুখ, জ্যামিতি, শেকড়, নিহত বাগান, কোয়ান্টাম, কবিতার মার্কেটিং, অশ্বারোহী প্রভৃতি কবিতায় কবি আমাদের জীবন ও জগতের নানান অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে এক যুথবদ্ধ প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেন।
মঈন চৌধুরীর কবিতার ভাষা সহজ, সরল, নির্মেদ, ব্যঞ্জনা, রূপক আর ঐন্দ্রজালিক জাদুবাস্তবতায় ভরপুর। খুব সহজ সরল ভাবে কবি কুঠার হাতে বেশ দক্ষতার সঙ্গেই যেনো চন্দ্র কুপিয়ে ভূপৃষ্টে জোৎস্না নামিয়ে ছাড়েন। তারপর চুপচাপ বলে দেন- 'চিনি না তোমাকে'।
কবিতার চেয়ে মঈন চৌধুরীর প্রবন্ধ যেনো আরো সবাক, হৃদ্ধ আর পরিপুষ্টতায় ভরপুর। জীবনের ও সৃস্টির অনেক গভীর ও কঠিন সব দার্শনিক আলোচনায় মঈন চৌধুরী খুব মুন্সীয়ানার সঙ্গেই বিচার বিশ্লেষণ করেন। শেষে সবার উদ্দেশ্য এক তীব্র প্রশ্ন ছুঁড়ে ভূ-মণ্ডল কাঁপিয়ে দেন। বাঙালির চিরায়ত খাসিলত নিয়ে মঈন চৌধুরী খুব সহজ-সরল অথচ তীব্র ভাষায় খোঁচা মারেন, ব্যঙ্গ করেন আর জীবনের রহস্য উন্মোচনে এক নতুন দ্বারের সন্ধান দেন।
নিভৃতচারী ও প্রচারবিমুখ মঈন চৌধুরীর এমন সোনার খনির রচনাগুলো সত্যি সত্যিই আলোচনা আর প্রচারের অভাবে পাঠকের অজান্তেই থেকে গেল।
বাংলা সাহিত্য ও দর্শন চর্চায় যারা অাগ্রহী ও পরিশ্রমী তাদের মঈন চৌধুরীর এই রহস্যপুরীর রচনাসমগ্রে সচেতনভাবেই একদিন গভীর আগ্রহ তৈরি হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।