আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাইকেল! সাইকেল!!


“এই যে! এই যে! বললাম না? প্রতিদিনই যায়!”
মাথার উপরে আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে দেখি তিনতলা বাসার দোতলার দুই ফ্ল্যাটের দুই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে এক, দুই, তিন – তিনজন বছর ৩-৮এর খুকী। ডানের ব্যলকনিতে দাঁড়ানো পিচ্চি সাথীদেরকে নিজের পূর্বোক্ত কোন কথার হাতেনাতে প্রমাণ দিতে পেরে মহা ভাব নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। আর বামের বারান্দায় দাঁড়ানো অপর দুই পিচ্চি চোখ গোল গোল করে আমাকে দেখছে।
আমি হেসে প্যাডেল করতে থাকি, থেমে গেলে যদি প্রথম পিচ্চির ভাব অন্যদের কাছে একটু কমে টমে যায়, সেই রিস্ক না নিয়ে।

আমাদের আবাসিক এলাকার কাছেই আর একটা এলাকা আছে, সেটা ঠিক বস্তি নয়, দিনমজুর-গেরস্ত নানারকম মানুষ থাকেন।

কেউ কেউ মোটামুটি ভালোই জীবনযাপন করেন, গরু-ছাগল পোষেন। গত বছর নতুন সাইকেল কেনার পরপরই ঐদিকে গিয়েছিলাম রাস্তা এক্সপ্লোর করতে। বার দুয়েক চক্কর দেয়ার পরে তৃতীয়বার দেখি টিন-ছনের ঘরগুলোর কাছে একটা ছোটখাটো জটলা। সেখানে ছোট-বড়-বুড়ো অনেকেই আছেন। আমি কাছে যেতেই হাসি দিলো কয়েকজন, কোনরকম ঠাট্টা নয়, উৎসাহজনক হাসি রীতিমতো।

জটলা পার হয়ে যাওয়ার পরে বেশ হই-হুল্লোড় উঠলো একটা, সেদিন শার্ট আর জিনস পরে ছিলাম, ভাবলাম এটা নিয়েই কিছু একটা বলছে হয়তো সকলে। কানে এলো একটা মেয়ে বলছে, “ বললাম না? মেয়ে!”


এই আবাসিক এলাকাটার পিচ্চিরা বাবা-মা-শিক্ষককূলের কোচিংসেন্টার প্রীতির মুখে ছাই দিয়ে এলাকার যত ফাঁকা প্লট, সেগুলোতে ক্রিকেট-ফুটবল-ব্যাডমিন্টন এসব খেলে প্রতিদিন বিকালে। খুব বেশি পিচ্চিরাও বসে থাকে না, যারা হাঁটি হাঁটি শিখেছে কেবল, বাবা-মার হাত ধরে বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করেন তারা, নিজেদেরকে একদম ‘বড়দের মতো’ ভেবে নিয়ে তাদের মুখে-চোখে খুশি আর ধরে না! আর আছে আরেকটু বড়রা, তারা দুই চাকায় না পৌঁছালেও তিনচাকার সাইকেল বা ব্যালান্স-হুইলওয়ালা দুই চাকা নিয়ে বেরিয়ে যান। সেদিন বাবার ঘাড়ে চড়ে পেছনে সাইকেল চালিয়ে আসা আমাকে দেখে চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকা একজনকে জিভ ভেঙচে দেয়ায় হকচকিয়ে গেছিলেন বেচারা (বলা বাহুল্য ওনার বাবা-মা দেখেন নাই)!
আর এই তো গত সপ্তাহেই আমাকে দেখে ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে তিন চাকা নিয়ে পাল্লা দিতে আসছিলেন আরেকজন খুকী।


বড় রাস্তায় সাইকেল চালাতে গিয়ে ট্রাক বা বাস গায়ের উপরে উঠে যাবে সেই ভয় করে।

তবে পথে বেরিয়ে অভিজ্ঞতা খারাপ হয়নি এখনো। আমার এই বুড়া বয়সে সাইকেল কেনায় আমার সহকর্মীরা উৎসাহ দিয়েছেন। এমনকি ঢাকায় একটা কনফারেন্সে গিয়ে আমি একদিন সেখান বেরিয়ে আরও কিছু মেয়ের সাথে সাইকেল চালাতে যাবো শুনে আমার বুড়া বুড়া শিক্ষকরাও প্রশংসাই করেছেন। তবে কর্মস্থলে সাইকেল নিয়ে হাজির হওয়া হয়নি আগে। আমাদের দেশের আবহাওয়া ঠিক সাইকেল চালিয়ে কাজে যাবার উপযুক্ত থাকে না সবসময়ে, বিশেষ করে রাজশাহীতে আর্দ্রতা বেশি থাকে, ৪০-৪৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের তাপটাও অসহনীয় হয়ে পরে গ্রীষ্মে।

তার উপরে আমাদের অফিসে এসি-টেসি নাই।

কর্মচারী যারা সাইকেলে যাতায়াত করেন, তারা সিঁড়ির নিচে একটা খাঁচা মতো তালা দেয়া জায়গায় সাইকেল রেখে দেন। ঠাণ্ডা আবহাওয়া দেখে কাজের চাপ কম ছিলো, এমন একদিন সাইকেল নিয়ে হাজির হলাম। ফোন করে অনুরোধ করায় আমাদের ল্যাব-অ্যাসিট্যান্ট সাত্তার ভাই নিজেই নিজের চাবি নিয়ে হাজির আমার সাইকেল নিরাপদে তুলে রাখতে। ফেরার সময়ে পিয়নদের একজন নিজেই বের করে দিলেন সাইকেল, এটা একটা ব্যাপার, কারও কাছ থেকে অসহযোগিতা পেয়েছি এ পর্যন্ত, তা তো নয়ই, বরং সবাই যেন একটু বেশিই আগ্রহী থাকেন আমার কাছ থেকে সাইকেল নিয়ে নিজেরাই তুলে রাখা, বের করে দেয়া, এরকম কাজে সাহায্য করতে।

আমি যে ছোট থেকে সাইকেল ধরেছি, নিজেই পারবো, এটা বলে তাদেরকে উৎসাহে পানি ঢেলে দিতে খারাপ লাগে মাঝেমাঝে।


আমি সাইকেল চালানো শিখেছিলাম ৭ বা ৮ বছর বয়সে। আমার দাদাবাড়ির পাশে বিশাল মাঠ ছিলো সেই সময়ে। পাড়ার বড় ভাইরা ফুটবল খেলতো (ক্রিকেট এত জনপ্রিয় ছিলো না সে সময়ে), মহিলারা গরমের বিকালে বের হয়ে সৌজন্যমূলক গল্প করতেন মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা হাওয়ায়। সেসব মেলাআআআআ আগের কথা।

তখন বাক্স-বাড়ির নগর জীবন ছিলো না, প্রতিবেশীদের সাথে আলাপের সময় ছিলো সবারই।
র‍্যাট রেইসে অংশ নেবেন না, বরং ছেলে-মেয়েকে বেশি সময় দিবেন, এই উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকা থেকে নিজেদের বেশি বেতনের চাকরি বিদায় জানিয়ে আমার বাবা-মা ফিরে এসেছিলেন নিজেদের ছোট শহরে। আমার ছোট ভাই সেই প্রথম ফাঁকা বড় মাঠ দেখলো। যতদূর মনে পড়ে, রাজশাহী ফেরার কয়েকদিনের মাঝেই সাইকেল আর আমাকে নিয়ে আব্বু মাঠে হাজির হলো। আমার বাবার প্রায় সমবয়সী BMW সাইকেলটা পরিচিত একজন বাবাকে দিয়েছিলেন আমার শেখার জন্যে।

ঐ সাইকেলটা খোদ ইংল্যান্ড থেকে আনানো হয়েছিলো তার ছেলের জন্যে সম্ভবত। কিন্তু ঢাকায় থাকতে শেখার সুযোগ হয়নি।

সাইকেলসহ মাঠে হাজির হয়ে আমি খুবই উত্তেজিত ছিলাম। আমি সাইকেলে বসে প্যাডেল করি, আব্বু সাইকেল পেছন থেকে ধরে রাখে ব্যালান্স করে। কিন্তু একসময়ে আবিষ্কার করলাম সাইকেল ধরে থাকবে বললেও ছেড়ে দিচ্ছে আব্বু।

মুশকিল হলো যেই না আমি খেয়াল করছি যে সাইকেল ধরে নাই কেউ, অমনি ব্যালান্স হারিয়ে পপাত ধরণীতল, অথচ বোঝার আগে পর্যন্ত ঠিকই ব্যালান্স রেখে চালিয়ে যাচ্ছি! বড় ভাইরা ফুটবল খেলা থামিয়ে আমার জন্যে জায়গা করে দিলেন। পরদিন আব্বু আর গেলো না, বড় ভাইরাও আর আমাকে জায়গা ছেড়ে দিলো না। আমি একা একাই বাসার সামনে বড় রাস্তার পাশে সাইকেল নিয়ে এগুনোর চেষ্টা করলাম, আর কী আশ্চর্য! পারলামও!

গতবছর অনেকটা শখের বশে সাইকেল কিনলাম, Laux-এর মেয়েদের সাইকেল, ৭ হাজার মতো পড়লো। আসলে এই এলাকায় রাস্তাগুলো বেশ ভালো, সাইকেল চালাবার জন্যে আরামদায়ক, হেভি ট্রাফিকও নাই। বিকালে বা সন্ধ্যায় ভালোই লাগবে চালাতে ভেবে, দোকানে খোঁজ করলাম।

মেয়েদের ২টা সাইকেল আছে দেখে আমার প্রিয় লাল রঙেরটা নিয়ে ফেললাম নিজের জন্যে। আমার সাইকেলটার বোন আরেকটা Laux সাইকেল আমার এক ছোট বোন নিয়েছিলো রাজশাহীরই দোকানটা থেকে, এখান থেকে সে সেটা জাহাঙ্গীরনগরে তার ক্যাম্পাসে নিয়ে চলে গিয়েছিলো।

সাইকেলের মজাটা হলো, চালাবার সময়ে আমার নিজেকে পুরা পাখি পাখি লাগে! মনে হয় উড়ছিইইইইইইই!


“কিন্তু সাইকেলটা পাবো কই?”
“দেখি দাঁড়া! আমারটার হাইড্রলিক ব্রেক তুই সামলাতে পারবি না। প্র্যাক্টিস লাগবে। “
“হ!”
“ভাইয়ারটা পারবি মনে হয়, তাও প্র্যাক্টিস লাগবে।


“ভাইয়ারটা নিলে উনি অফিসে যাবেন কেম্নে?”
“ব্যাপার না, বলে রেখেছি আমি হালকা, ভাইয়ার অসুবিধা নাই। তোকে সাইকেলটা পৌঁছায়ে দিয়ে ভাইয়া রিকশা নিয়ে বাকিটা চলে যাবে। তারপরে আমি খানিকক্ষণ সাথে থাকবোনি, দেখলাম তুই পারিস কিনা ঠিকঠাক ঐটার গিয়ারটিয়ার ম্যানেজ করতে। আর আমি ঐদিকেই একটা মিটিং-টিটিং ফেলবোনি, তাহলে বাকি সময়টা কাটানো যাবে অনায়াসেই। “
“কী বলিস! এতো মহা পেইন দেয়া হবে তোদের দুইজনকেই।

আমার একটা বাতিকের জন্যে এত ঝামেলা করবি?”
“দেখ, এটা কোন ঝামেলা না। আর বড় কথা হলো বাতিকটাও সেরকমের কিছু হতে হবে – তোর বাতিকটা ভালো, মেয়েরা সাইকেল চালাবে নারী দিবসের র‍্যালিতে, তুই রাজশাহী থেকে এসে সেই র‍্যালিতে অংশ নিবি। এরকম বাতিক সবার থাকে না, তোর আছে, এটাই বড় কথা। “

নিয়মিত সাইকেল চালাতে চালাতে আসলে শখ বেড়ে গেছে, সেদিন যেই দেখলাম মার্চের শুরুতে শুধুমাত্র মেয়ে সাইক্লিস্টদের জন্যে একটা সাইকেল রাইডের আয়োজন করেছে BDCyclists গ্রুপ, বন্ধুদের কয়েকজনের নাম দেখেই হাত তুলে ফেললাম। যদিও সমস্যা হলো - সেই সময়ে আমি নিজে ঢাকায় থাকলেও, ঢাকায় তো আমার সাইকেল নাই!
তাতে কী! বন্ধুবান্ধব তো আছে! তাদের অনেকেই আবার নিয়মিত সাইকেল চালিয়েই কাজে যায় ইদানীং।


Go green!


[একেবারে বাংলাদেশের সংবাদপত্রদের ইশটাইলে বলছি: ইহার সূত্রঃ ইন্টারনেট, বিশদ জানা নাই]

কলেজের বন্ধু তৌহীদ আর মুঈদ ভাইয়ার সৌজন্যে সাইকেলের ব্যবস্থা হলো। আগেরদিন iferry.com থেকে অর্ডার দেয়া হেলমেটও হাতে পৌঁছে গেছে। পরদিন সকালে সাইকেল পৌঁছেনি তখনো, রঁদেভ্যু বাড়ির কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে, ঐটুকু হেঁটে চলে যেতে বাড়ি থেকে বের হতেই দেখি উল্টোদিকের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সাইকেল নিয়ে বেরুচ্ছে আরেকটা মেয়ে। কী মনে হতে হাত নেড়ে কাছে গিয়ে বললাম, “আপনি কি মেয়েদের সাইকেল রাইডে অংশ নিতে বেরুচ্ছেন?”
আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটা বললো, “ আরে আপু! আমাকে চেনেন তো আপনি!”
চিনতে পেরে হেসে ফেললাম দুইজনেই। আমাদের বুনোহাঁসের বন্ধু, এর আগে একবার আলাপ হয়েছিলো।

গুলশান-১ এর Nando's –এ পৌঁছে কাওকে না দেখে একটু ভড়কে গেলাম। পরে আমাকে পেছনের দিকে Barista-য় যেতে বললে আরেকটা পরিচিত মুখ দেখে মন খুশি হয়ে গেল। আলাপ হলো আরও কয়েকজনের সাথে।
বারিস্তায় কফি আর একটা কাপ-কেক অর্ডার দিয়ে বসতে বসতেই বাকিরা হাজির। বুনোহাঁস কল্যানপুর এলাকা থেকে ডানায় ঢেকে নিয়ে এসেছে আরও কয়েকজন বলাকা।

BDcyclist-দের ভলান্টিয়ার আর বাকি সাইক্লিস্টদের সাথে আলাপ চলতে চলতেই আমার বরাদ্দ সাইকেল নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন মুঈদ ভাই আর তৌহীদ। সাইকেলের সিট অ্যাডজাস্ট করা হলো, গিয়ারে তেল-তুল দিয়ে আমার উপযোগী গিয়ার সেট করে আমাকে রেডি করে দিলেন দুইজনে। গ্রুপ ফটো তোলা হলো সবার।

আমি এদিকে গিয়ার-ওয়ালা চার চাকার বাহন ছাড়া আর কিছু চালাই নাই কখনো, বেশ ভয় লাগছিলো ঢাকায় বড় রাস্তায় চালাবো ভেবে। যদিও শনিবার, আর যাবো আমরা তেজগাঁ, তবুও ট্রাফিক মন্দ না।

নান্দো'স-এর সৌজন্যে চা-বিস্কুট খাওয়া, গ্রুপ ফটো-টোটো তোলা শেষ হলে আমরা সকলে রওনা হলাম গুলশান থেকে তেজগাঁর পথে। নান্দোস বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষ্যে বিডি-সাইক্লিস্ট গ্রুপের সাথে মিলে আয়োজন করেছিলো এই রাইডের।

Inspiring Change -8 March 2014

BDCyclist-দলের ছেলে ভলান্টিয়াররা বাদে অংশ নিয়েছেন প্রায় ৩০ জন নারী। Nando's-এর সৌজন্যে সেদিন দুপুরে তেজগাঁর একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির নারী কর্মীদেরকে দুপুরের খাবার সরবরাহ করা হয়েছে। সাইক্লিস্টরা খাবার বহনকারী ভ্যানের সাথে সাইকেল চালিয়ে গুলশান-১ থেকে তেজগাঁর প্রিন্স গার্মেন্টস-এ গিয়ে খাবার বিতরণ ও কর্মীদের সাথে সময় কাটিয়ে ফেরত এসেছিলেন নান্দোস-এই।

সেখানে তাদের জন্যেও দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত ছিলো।

পুরো উদ্যোগই আমার কাছে প্রশংসনীয় মনে হয়েছে। শুধু ভালো লাগেনি স্পন্সরকৃত একই-রকমের টি-শার্টে মেয়েদের জন্যে নির্ধারিত ‘গোলাপি’ রঙ। এই রং-টা বহির্বিশ্বে মেয়েদের সাথে প্রায় সিলগালা করে ব্র্যান্ডিং করে ফেলা হয়েছে বিগত কয়েক দশকে, কোন বিচিত্র কারণে! বাংলাদেশেই বরং এই রঙের ছাপ মারার ব্যাপারটা অপ্রচলিত ছিলো, একটা কেউ শুরু করলে বাকিরাও করবে, এই আশঙ্কা করি। নারীদের সাথে কোন কিছুর ছিল-ছাপ্পর মেরে দেয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ বিরক্তিকর মনে হয়।

ছেলে ভলান্টিয়ার আর মেয়ে সাইক্লিস্টদেরকে আলাদা রাখতেই যদি টি-শার্টের রঙ আলাদা করতে হয়, তবে নান্দো'স চাইলেই তাদের নিজেদের চিকেন-মাসকটের লাল-কালো কম্বিনেশন ব্যবহার করতে পারতো।

কিন্তু যেমনটা বললাম, এইটা বাদে, বাকি সবকিছুই ভালো লেগেছে। সবথেকে ভালো ব্যাপার ছিলো সাইকেল চালাতে আগ্রহী এতগুলো মেয়ের সাথে পরিচয় হওয়া। ভালো লেগেছে গার্মেন্টসকর্মীদের সাথে আলাপ করে।

নিচে কিছু ছবি দিলাম সেই দিনের।

i. গুলশান-১ এর Nando's ছেড়ে রওনা হচ্ছে সাইকেলারোহীদের দল

ii. গুলশান থেকে তেজগাঁ'র পথে... বাঁয়ে ঐ যে হাতিরঝিলের ব্রিজগুলো দেখা যায়

iii.

iv. গার্মেন্টেস-এর বাইরে রাখা আমাদের সারিবদ্ধ সাইকেলের একাংশ

v. গার্মেন্টস-এ ব্যস্ত কর্মীবৃন্দ। এখানে দেখলাম পুরুষকর্মীর সংখ্যা বেশ ভালোই।

vi. আঞ্জুমান, বাড়ি নেত্রকোণা। কাজে ব্যস্ত কর্মীরা কথা বলতে খুব বেশি ইচ্ছুক নন, আঞ্জুমানের ক্ষেত্রে অবশ্য অনাগ্রহের থেকে মনে হলো বেশি লাজুক।

vii. খাবার বিতরণ করছে নান্দোস-এর মাসকট

viii. ফটোগ্রাফারদের একাংশ

ix. ফিরতি পথে মেয়েদের উচ্ছ্বাস

x. বুনোহাঁসের স্বহস্তে প্রস্তুতকৃত চেইন-তালার পোশাক!

xi. সাইক্লিস্টদের দুপুরের খাবার - সৌজন্যে নান্দোস

xii. বিদায় নেবার আগে স্মমিলিত সাইক্লিস্টদের কয়েকজন।

এই ছবিতে সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নারী উপস্থিত আছেন।


নারী দিবস, মা-দিবস আলাদা করে বিশেষ দিবস পালনের যৌক্তিকতা আমার নিজের কাছে কম। নজরুলের কথাটা ঠিক - “পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী অর্ধেক তার নর। “

প্রতিটা দিনই মায়ের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ, আপনার মেয়ের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। দিবস আলাদা করে পালনের আগে জরুরি মেয়েদেরকে সাহসী করে বড় করা, উৎসাহ দেয়া যে তারাও ছেলেদের মতোই সবকিছুই পারে।

একটি পরিবারে ছেলেটিও যখন দেখবে তার বোনকে একই কাজ করতে দেয়া হয়, পরিবারের বাইরের অন্য আরেকটি মেয়ে সম্পর্কে তার সম্মান বাড়বে বই কমবে না।

আমাদের দেশে মেয়েদেরকে সেভাবে কোন কাজে উৎসাহ দেয়া হয় না। ‘লোকে’ কী বলবে, এইটা আমরা বেশি ভয় পাই। যতটা না মেয়েরা বড় হতে হতে নিজেরা ভয় পায়, বড়রা বিশেষ করে নিজের সবথেকে আপনজনেরা – বাবা-মা, ভাইবোন, পরিবারের অন্যরা, তাদের মনে ভয়টা জোর করে ঢুকিয়ে দেয় – তুমি তো পারবা না! তুমি করলে সবাই ছি ছি করবে! তোমাকে বিরক্ত করবে, তোমাকে মন্দ বলবে। - ইত্যাদি, ইত্যাদি।

হ্যাঁ-এর আগেই না!

কিন্তু রাজপথে সাইকেল চালাতে গিয়ে আমি সেভাবে বিব্রতকর কোন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন এখনো হইনি। আজ থেকে প্রায় দশ-বারো বছর আগে নওগাঁর আত্রাই-এর একটা গ্রামে নিজে দেখেছি স্কুলের মেয়েরা সাইকেল চালানো শিখছে, বাবা-বড় ভাইয়ের কাছে, শখ করে। চালাচ্ছে না হয়তো রাস্তায়, কিন্তু শিখছে তো! যে কোন বিদ্যাই কখনো না কখনো কাজে লাগতে পারে। আর সাইকেল চালাতে ব্যালান্স করা শিখতে হয়, পড়ে গেলে ব্যথা লাগবে সেটা মেনে নিয়ে মাইন্ডসেট করতে হয়। সাহস লাগে পুরা ব্যাপারটায়।

শিখে গেলে আনন্দও হয় দারুণ! আমার মজা লাগে যখন আমি সাইকেল নিয়ে বের হলে ছোট-বড় মেয়েরা আড় চোখে তাকিয়ে দেখে কেমন করে সাইকেল চালিয়ে এদিক সেদিক যাচ্ছি আমি।

লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা উপজেলায় একটি NGO-তে কর্মরত পরিচিতা একজনের সাথে আলাপে সেদিন জানলাম ঐ এলাকায়, বিশেষ করে বর্ডার বেল্ট রিজিয়নে গ্রাম-গঞ্জেও মেয়েদের সাইকেল চালানো খুবই স্বাভাবিক। সেখানে নারীরা এটা প্রয়োজনের তাগিদে শিখে নিয়েছেন। সামাজিক বা পারিবারিক কোন বাধা তো নাইই, বরং সব মেয়েই শিখছে সাইকেল চালানো এবং চালাচ্ছে। তাকে বলেছি সময় করে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত লিখতে।

১০
ঢাকায় ইদানীং ছেলেরা অনেকেই সাইকেল চালাচ্ছেন। সাইক্লিস্টদের গ্রুপ, সাইকেল অ্যাক্সেসরিজ-এর দোকান, ক্যাফে বা আড্ডা দেবার জায়গা, নানান কিছু হয়েছে। শুধু ঢাকা না, সাইক্লিস্টদের গ্রুপ অন্য শহরগুলোতেও ছড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। রাজশাহীতে কিছু স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে সাইকেল নিয়ে নানানরকমের কসরতের একটা গ্রুপ খুলেছে ফেসবুকে দেখলাম। আর সচক্ষে সেদিন টিটি কলেজের মাঠে দেখলাম দুইজন ক্লাস 9-10 পড়ুয়াকে সাইকেলে দাঁড়িয়ে ব্যালান্স করে এগুতে।

একটু ভয়ই লাগলো কোনরকমের হেলমেট বা knee-elbow-guard ছাড়া ভর দুপুরে জনবিরল মাঠে দুইটা ছোট ছেলেকে একা একা প্র্যাক্টিস করতে দেখে। সাইকেল যেমন স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্যে ভালো, নিরাপত্তার ব্যাপারটাও যে জরুরি, সেটা এই ছোটদেরকে বোঝাতে পারলে ভালো হতো। আর অফিসগুলোতে যদি শাওয়ার নেয়ার, কাপড় পাল্টাবার সুব্যবস্থা থাকতো, তাহলে হয়তো সাইকেল চালিয়ে অফিস করতে ঢাকার আরও অনেক বেশি তরুণ-তরুণীকে উদ্বুদ্ধ করা যেত। সাইকেল এবং খুব ভালো পাবলিক বাস ঢাকার যানজট নিরসনের অন্যতম উপায় হতে পারে।

বিডিসাইক্লিস্টস দল নিয়মিত অন্যান্য সাইকেল রাইডের আয়োজন করে চলেছে, বিশেষ করে ছুটির বা বিশেষ দিনগুলোতে।

২৬ মার্চ ২০১৪, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যেই হয়ে গেল আরেকটি চমৎকার রাইড। সেভেন-সামিটখ্যাত বাংলাদেশী নারী পর্বতারোহী ওয়াসফিয়া নাজরীনও আজকে অংশ নিয়েছেন। বেগম রোকেয়া জীবিত থাকলে নিঃসন্দেহে এই মেয়েটা আর এভারেস্টজয়ী আরেক বাংলাদেশী নারী নিশাতকে নিয়ে গর্বিত হতেন।

সেদিন পরে সাইকেল ফেরত দিতে যাবার পথে বনানী আর বারিধারা হয়ে বেশ ভালো রকমের সাইকেল চালানো হয়েছিলো। সকালের প্রায় পাঁচ, পাঁচ – দশ কিলোমিটার, আর পরে আরও ১২ কিলোমিটারের মতো চালিয়ে বিকালে হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম।

রাস্তায় তো আর এত কায়দা করে চালানোর অভ্যাস নেই। আমার মতো আনাড়ির হাতে কলেজের বন্ধুর বড় ভাই নিজের ৫০ হাজার টাকা দামের Trek DS 8.3 সাইকেল ছেড়ে দেয়ায় আবেগাপ্লুত হয়েছি। (সত্যি বলছি, সাইকেলের দাম এত তা জানলে আমি আরও বেশি ভাব নিয়ে চালাতাম! রাস্তার মাঝ দিয়ে চলা লোককে গুঁতা দিয়ে বলতাম, “পঞ্চাশ হাজার টেকা দামের ছাইকেল দিয়া গুঁতা দিছি, এখন আমারে ৫০টেকা দেন!” )

ভাবছি এবার নিজেই একটা গিয়ার-ওয়ালা দামী সাইকেল কিনে ফেলবো!


পাদটীকা

  • ১. i, ii, iii, vii, ix নম্বর ছবি বিডিসাইক্লিস্ট দলের আরিফুর রহমান খানের সৌজন্যে।

  • ২. আমার নিজের তোলা ছবিগুলোতে উপস্থিত নারীদের অনুমতি সাপেক্ষে এখানে ব্যবহৃত হয়েছে।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.