কখনো মধ্যরাতে জেগে উঠে দেখেছেন সঙ্গীনির স্পন্দিত বুকের নিয়ত ওঠানামা ? আলাপ করেছেন, তার চিবুকের তলে একাকি দিন-রাত্রি কাটানো তিলকটির সঙ্গে ? নিভৃতে ? নিরালায় ? সঙ্গোপনে ? এতটুকু টের না পাইয়ে কখনো ঝাঁপ দিয়েছেন তার উঞ্চ গলার পেলব গিরিখাতে ? চুপিসারে সময়কে থামিয়ে অন্তত তার অধরে একটা চুমু তো এঁকেছেন ? নাকি ফুরিয়ে এসেছে মনতুলির যত রং ?
একটু আগেই চুরি করে ওকে চুমু খেয়েছি। এখন মাথায় ঘুরছে ডাকাতির ফন্দি। সব দোষ ওই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাস্নাহেনার। অন্ধকার নামলেই তার গন্ধ বিলানো চাই। এদিকে মন্দ্রিত গন্ধে অনুভূতিপ্রবন জীবদের সংবেদনশীলন মনে যে আকুলি-বিকুলি শুরু হয়ে গেছে,হাস্নাহেনা তার কতটুকু বোঝে ? উদাসী হাওয়ায় রাতটাও ভিজে জবজবে।
বালিশের তলা থেকে বাঁশিটা তুলে নিলাম। ফুঁ দিয়ে রাতটাকে শুকোতে চাই। কিন্তু পোষমানা পরীটা তার সময় দিল কই ? নিদ্রা মুলুক থেকে ঘুরে এসে সে তাকিয়ে আছে মিটিমিটি চোখে। দেখলে উষারও লজ্জাচুরি যাবে ! বিছানা ছেড়ে নিটোল পদক্ষেপে সে উঠে গেল শার্সির কাছে। ওর কটিদেশে এক চিলতে রতি বিহ্বলা নীলচে বিকিনি।
নাজুক ঢাকনায় হাতা গুটানো টি-শার্ট বুকের নিচের সমতল সরোবরকে আগলে রাখলেও পেছনের নিন্দেকে বাগে আনতে পারেনি। এই গোলাপি রাতে বিহ্বলতার ক্ষনে জানিনা এ কিসের কৌতুক ! চিরকালের ভদ্র চোখদুটো বারবার প্রথা ভেঙ্গে চলে যাচ্ছে ওর মাখনরঙা উরুর জন্মদাগে !
মেয়েদের এজন্যই এত ভাল লাগে। প্রতিদিনই নতুন। আলাদা, আলাদা। পুর্ণেন্দু পত্রী তার রমনীর ঘাড়ের কাছে ঝুঁকে পড়া সবুজ শাড়ীকে দেখেছিলেন লতানো জুঁইয়ের ডাল-এর মতো।
প্রেয়সী তার হাত ধরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ঝাউবনের গোপন আঁধারে। আগুনের উল্কি এঁকে দিয়েছিল হাতে-বুকে। দাঁতে চিবোতে দিয়েছিল লাল লবঙ্গ। কসম খোদার, ওকেও ওভাবে আবিষ্কার করতে ইচ্ছে হচ্ছে ! বুকের খোন্দলে সাঁই সাঁই করে বইছে সুমদ্রঝড়। থামানোর চেষ্টা বৃথা, ভেবে বললাম-চিবোতে দেবে?
-কী ?
-একটা রঙ্গীন প্রজাপতি, যার ফিনফিনে শরীরে মধুকুঞ্জের সুর-লহরী।
-বিনিময়ে ?
-যা চাইবে, এই চম্পা রাত,হাস্নাহেনার গন্ধ,বেশরম ভালবাসার দ্যোতনা, সব, সব তোমার। বিনিময়ে আমি এই শুক্লা চর্তুদশীর চাঁদকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তোমার দু চোখে ভ্রমন করবো, তুমি পাটভাঙ্গা শাড়ী পরে লিপিষ্টিকে ঠোঁট ছোঁয়ালেই আকাশ বৃষ্টিতে ভেঙ্গে পড়ে। তোমার চিঠির খাম খুললেই সুর্য ডুবে যায়।
-তাই বুঝি ?
-নয়তো আর কি, তোর ঠোঁট চুইয়ে রাত বেড়েই চলছে। থেমে থেমে ডেকে তাই স্মরন করিয়ে দিচ্ছে ডানামেলা মেঘমালা।
ঝিলমিল উৎসবের এই রজনীবিলাসে তোমার সঙ্গে মেতে উঠতে চাই গোপনে, অতি ধীরে আলতুশি স্পর্শে,হাস্নাহেনার গন্ধবিলাসকে সাক্ষী রেখে।
-মন চায় হেসে গলে পড়ি। এতসব বাহারি ইচ্ছে কোত্থেকে আসে, শুনি ?
-স্বর্গ ব্যাপারটা কি, আমি কিন্তু জানি। তবুও কল্পনার রংয়ে মনকে খুশি করে চলি। আর দুচোখ দিয়ে শুধু দেখি, আমার জীবনপ্রদীপ পিলসুজে আলোর মতো যুগ-যুগান্তের ধূপগন্ধ সেজে জ্বলছে তোমার অন্তরে।
কিন্তু নিঃস্ব আর হলাম কই ? অনন্তকাল ধরে নিংড়ে দেয়ার পরও নৈবেদ্য সাজানো থালাবাটি এখনো পড়ে আছে।
-থাম ! চুপ করো !
-এইসব জেনে-বুঝেই তো অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করেছি এই রাত্রির। রবীঠাকুরের মতো বলতে ইচ্ছে করছে,'চিরকাল রবে মোর প্রেমের কাঙ্গাল/ এ কথা বলিতে চাও বোলো/ এই ক্ষনটুকু হোক সেই চিরকাল, তার পরে যদি তুমি ভোল। '
-এখানে হাওয়ার হল্লা। হাস্না'র শরীর থেকে আইবুড়ো ফুলগুলো ঝড়ে পড়ছে।
আচ্ছা, খুব নিশীথে বনপুকুরের ডাঙ্গায় বসে ঘাতক এস্রাজে তুমি কখনো নজরুলকে শুনেছ ? জলতরঙ্গের ধ্বনি এবং সুরের আশ্চর্য এক খেলা চলে। মনে হয়, সোনার পৃথীবিটা আমার ওপর গলে পড়ছে। আর আমি, খেয়া ধরতে না পেরে নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নর্তকি, যার ঘুঙুর আচমকাই খসে গেছে !
-পাঁজরের ক'খানা হাড় দিয়ে নাহয় আরেকটা গড়ে দেব। শুধু একবার বল-আমার চোখে তোমার জীবনপথের সুদূর।
-সামনের পথটা যে আমি এখনি দেখতে পাই, ঠাকুর।
চাইনা আর নৈবেদ্য, শুধু বলো কখন শেষ হবে এই খুনে রাত্তির ?
হাতের অজান্তেই কোথায় যেন টুপ করে খসে পড়লো লাল গোলাপ। শুয়ে ছিলাম পাশাপাশি। সবেমাত্র ঘুমিয়েছ তুমি। হঠাৎ দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম আমি। শশব্যস্ত চোখে তোমায় শুধাই-ভালবাস ? আর তুমি কিনা পাশ ফিরে শুচ্ছো ! কখনো ভেবেছ, শিয়রের মাঝখানে এই সীমান্ত কাঁটাতার বরাবর পৃথীবিটা হঠাৎ দু'ভাগ হয়ে গেলে আমায় আর কখনো ফিরে পাবে কি ?
-সময়বিলাসি আমি ছিলাম না কোনকালেই।
আর পৃথীবিটাও আস্ত নেই। ফেটে চৌচির। এক পাড়ে তুমি, আরেকপাড়ি আমি। কেবল রাত হলেই মাঝনদীতে দুজন নেমে পড়ি। উথাল-পাথাল ঢেউয়ের অক্ষরে তুমি লিখে চলো কাব্য, আমার ক্যানভাসে।
কিন্তু আলো ফুটলেই অন্ধকার চলে যায়। দিনের আলোয় রাতের জোনাকিকে কেউ চিনতে পারেনা। তাই আকাশভরা ছাতে মেঘের পাশে সরে বসে লাভ কি ?
-তারার ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখবো। আমার অসীম অন্ধকারে রাজত্ব সঁপে দেব তোমার হাতে।
- আর,দিন হলেই ছুটে যাবে মানুষের কাছে ?
-প্রয়োজন আইন মানেনা।
স্বর্ণলতিকা হয়ে রসালের কাঁধে চেপে জীবন পারি দেয়ার দীক্ষাই তো আজন্ম অবধি পেয়ে এসেছি ?
-তাই বুঝি গ্রহন করছো আমায় ? দুই ঠোঁট ছিঁড়ে, চোখের কোটর থেকে নীলপদ্ম তুলে, নিষিদ্ধ দেরাজ থেকে টেনে নিচ্ছ বক্র ছুরি-ছররা-কার্তুজ ? কিন্তু প্রহর ফুরোলেই নিকট অতীত মুছে যামিনী পটে সাজানো স্মৃতিগুলো ভেসে উঠবে। তুমিও গিয়ে ভিড়বে জন-অরণ্যে।
-আগামি রাত্তিরে ফিরে আসার তরে ?
-মেঘের পাখোয়াজে ভর করে উড়ুক্কু কথা বলো না। মাটিতে আমার বাস। অত উঁচুতে ঠাঁই পাইনা।
ছুটে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়াই। উফ ! স্বর্গের গন্ধও কি এর চেয়ে বেশি মিষ্টি ! আরো বেশি সম্মোহনী ? ওর চাহনি বিলাসে গন্ধবিধুর হাওয়ায় বুঁকে কাঁপন ধরে। কিছুটা ঢাকা-আঢাকা শরীরকে নিবিড় করে টেনে নিয়ে, ওর উৎসব চোখে যতবার চোখ রাখি,মনে হয় ইন্দ্রিয়ে আঁচ ধরাতে ওরা রাঙ্গা ঠোঁটে ইচ্ছেপ্রদীপ জ্বেলে মুখ-মালাই চুমু খাই। ইচ্ছে হয় ভালবাসার কষ চুঁইয়ে পড়া ঠোঁট খুবলে খেয়ে নির্মলেন্দু গুণের মতো করে বলি-
'...শুধু চোখে নয় চোখে চোখে চোখ
বাহু দিয়ে বাহু,নাভি দিয়ে নাভি;
চাবি দিয়ে তালা খোলা দেখিয়াছি,
তালা দিয়ে খোল দেখি চাবি। '
-অসভ্য !
-সভ্যতার শুরুই তো ওই শব্দটার প্রসববেদনা থেকে।
চারিপাশে চেয়ে দেখ,সভ্য হওয়ার একঘেয়েমি থেকে বাঁচতে এই পিরিতকুসুম রাতকে সবাই উপভোগ করছে যে যার মতো করে।
-এখন রাত কত গড়ালো ?
-সে হিসেব ঈশ্বরের। আমি শুধু দেখছি,সন্ধ্যে হলো বুঝি, দেখছি চেয়ে প্রথম তারা। চেয়ে আছ আমার চোখে। তোমার দুখানি নয়নতারা।
আবার শুরু হলো কথা। মাখামাখি চন্দনবনে। শ্রুশ্ষার হাত ধরে জীবনের ক্ষতস্থানে। নির্বাক ভাষাগুলি স্বপ্নের কাছাকাছি হাঁটে।
-এত হেঁয়ালি করছো কেন ?তোমার অসভ্য প্রয়োজনের ঝুলি তো পুর্ণ হলো।
এবার আমায় সভ্য করে চৌকাঠের বাইরে রেখে দরজায় খিল দাও। কাক ডাকছে,আমি যাই।
-যাবে ? নিয়নের নিচে বিলোল বণিতার নয়ন-ঠার, শহুরে রাখালের যামীনিতে মধু ভাঙ্গে। রতি-রাত আর পাপী চাঁদ, তাই তাকিয়ে দেখে। ওদের মধুযামিনী এখনই ভেঙ্গে দিওনা ?
-কাল আবার আসবো।
লাল শাড়ী পড়ে। কোমরের ঢাল গলে উঁকি মারবে বৈকাল। ছাপা শাড়ীতে দিব্যি টের পাবে এই সেই বাঘীনি, মোলায়েম উরুর উপর শুইয়ে যে তোমাকে চেটে-পুটে খাবে এখনি।
-তোমাকে যে কেন ভালবাসি ? সে কথা জানার আগে মিলনের মুহুর্ত ফুরালো।
-তুমি সত্যিই আমাকে ডোবাবে একদিন।
লাল ঠোঁট নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলে, লাল ঠোঁট নিয়েই বাড়ি ফেরা উচিত।
-কিন্তু সেই সন্ধ্যেবেলাগুলোতে তো তুমি ঘরে ফিরতে চাইতে। যখন দুজনের জ্বর আসতো একসঙ্গে। পৃথীবির সব আলো নিভে গেলে আবছা সিড়ির নিচে এ ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতাম....।
-অদৃশ্য থার্মোমিটারে পারা এখন নেমে গেছে।
জীবন এখন দিন আর রাতের মতোই সত্য। ভ্রম জাগানিয়া নয়। আজ আসি,অপেক্ষার বালুঘড়ি যত্নে রেখ।
- আমি তো তোমায় বহুদিন চিনি। তুমি জানবে না আছি।
তোমার হাওয়ায় শ্বাস টেনে কাছাকাছি। ভালবাসি শুধু তোমাকেই ভালবাসি। মেঘের মতো এলোকেশি চুল যার, তার মনে আমার, ইচ্ছে হয় দুয়ার খুলে নামার।
-কিন্তু আমার দুই চোখে তো শীতের বন। ভীষন অসময়ে বাতাসে বৈশাখি মাতম।
ভীষন অসময়ে এই শুভক্ষন !
আমি ওর চিবুকের তিলটার দিকে তাকিয়ে প্রেমেন মিত্তিরের মতো শুধু বিড়বিড় করে আওড়ালাম-তোমাকে লিখিনি চিঠি, খাম ছিঁড়লে চাপা ঠোঁট খুলে যাবে, ছোট্ট তিল কেঁপে উঠবে ক্ষতিগ্রস্থ এলাচের ঘ্রান।
বোধহয় শুনতে পেল। চৌকাঠ মাড়ানোর আগে একবার ফিরে তাকিয়ে শুধু বললো-প্রেম শুধু থাকে ভিক্ষুক হয়ে মনে। তবুও তোমাকে চাই। তোমাকে ছাড়া শান্তি নাই।
রক্তকিংশুক জ্বালিয়ে দাও আমার বাঁকে বাঁকে, কিনারে-মোহনায়।
আমি কিছু বলিনি। বিছানায় আলগোছে শুয়ে ভেংচি কাটছে টাকার বান্ডিলটা। এবারও রেখে গেল ! জানালার ফাঁক গলে চুঁইয়ে পড়ছে উষার আলো। চারিদিকে ফিসফিস হাওয়ায় পাতার মর্মর শব্দ।
জলের শব্দ। পাখির শব্দ। জীবনের কোলাহলে সয়লাব চারিপাশ। শুধু এখানে, এই গহন মনের অন্দরে সব একাকার হয়েও নির্জন !
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।