হাউস অব পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষে আওয়ামীলীগ-বিএনপির মুখোমুখি প্রাণবন্ত বিতর্
বাংলাদেশ ভালো চলছে- এইচ টি ইমাম
বাংলাদেশ ভালো নেই- সাবিহ উদ্দিন চৌধুরী
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ-লন্ডন থেকে
দেশে দুই দলের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান এবং মারমুখী অবস্থা থাকলেও আজকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ নিয়ে সেমিনারে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির নেতা, তার্কিক ও থিংক ট্যাংক সকলেই মারমুখী-যুদ্ধংদেহী অবস্থার বিপরীতে এক প্রাণবন্ত বিতর্ক উপহার দিলেন।
বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি ও আগামী দিনের রাজনৈতিক গতিপথ কোনদিকে, কেমন করে প্রবাহিত হবে-দুই দলের অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বিতার্কিকেরা হাউস অব পার্লামেন্ট থেকে জাতিকে জানিয়ে দিলেন।
আজ বেলা ১১ টায় ব্রিটেনের হাউস অব পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষে “বাংলাদেশের ভবিষ্যতঃ শান্তি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসন” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ গ্রহণ করেন বাংলাদেশ থেকে আগত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্ঠা এইচ টি ইমাম, অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ডঃ মশিউর রহমান, সংসদ সদস্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এডভোকেট তারানা হালিম ও আওয়ামীলীগের সাংসদ বীর বাহাদুর এমপি। আর যথারীতি বিএনপির পক্ষে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন বিরোধীদলীয় নেত্রীর উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন চৌধুরী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ পিয়াস করিম, সাংসদ আসাদুজ্জামান এডভোকেট।
সেমিনারে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ার লর্ড এভিভ্যুরিও বিশেষ সারগর্ব বক্তব্য উপস্থাপন করে বলেন, “বাংলাদেশের প্রয়োজন হলো সকল দলের কাছে এবং প্রধান দুই বড় দলের কাছে গ্রহণীয় ও অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, যাতে সকলের অংশগ্রহণও( তার ভাষায় inclusive) নিশ্চিত হয়। আর তা করার জন্য তিনি মনের সংলাপ চালিয়ে যাওয়া দরকার”। লর্ড এভিভ্যুরি বলেন, “ডায়ালগের মাধ্যমে সকল দলের কাছে গ্রহণ যোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে”।
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্যে এইচ টি ইমাম বলেন, আওয়ামীলীগের অধীনে ফ্রি ও অবাধ নির্বাচন যে সম্ভব, সেটা উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অধিক হারে আসন এবং অংশগ্রহণই তার প্রমাণ বহন করে।
এইচ টি ইমাম সেমিনারে আরো বলেন, বিগত দশম নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে নির্বাচন নিয়ে সংলাপ ও সমঝোতার আহবান জানিয়েছিলেন।
আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকও নীতি নির্ধারক সকলেই একই আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি নেত্রী নির্বাচন বয়কট করে আওয়ামীলীগের অধীনে নির্বাচনে না এসে সেই নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দিয়ে বসেন। ঐ সময় বিরোধীদল দেশে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালাতে থাকে। বাসে আগুন, পেট্রল বোমা, গাছ কেটে রাস্তা অবরোধ, পাকা রাস্তা কেটে দিয়ে জনগণকে এক অস্বস্তিকর অবস্থায় ও জিম্মি করে রাখে। “আওয়ামীলীগ সভানেত্রী সংবিধানে বর্ণিত ধারা মোতাবেক গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার জন্যে এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার জন্যে দৃঢ়তর সাথে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে সংবিধান অক্ষুন্ন ও গণতন্ত্রের যাত্রা অব্যাহত রাখেন”।
এইচ টি ইমাম আরো বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাদের কার্যক্রমের উপর সরকারের কোন প্রভাব নেই।
এইচ টি ইমাম বলেন, আওয়ামীলীগের সরকার বলেই দেশে শত প্রতিকূলতা সত্যেও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে এবং আওয়ামীলীগের সরকার জনগণের জান মালের নিরাপত্তা বিধানের লক্ষে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার ফলে দেশ এখন সুন্দর ভাবে চলছে। বাসে যারা বোমাবাজি করে, রাস্তা ঘাটে ট্রেনে পেট্রল বোমা ঢেলে দিয়ে মানুষ খুন করার উৎসবে মেতে উঠেছিলেন, রেল লাইন উপড়ে ফেলে জনসম্পদের ক্ষতি করেছিলেন, শেখ হাসিনার সরকার সেসব দমন করে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছেন।
ডঃ মশিউর রহমান বলেন, সারা বিশ্ব যখন রিসেশনের কবলে পড়ে মুখ থুবরে পড়েছিলো, গরীব দেশ হয়েও বাংলাদেশ শেখ হাসিনার সরকার অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছিলেন, প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়েছে, আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
যার কারনে অনেকের ঈর্ষার কারণ এখন শেখ হাসিনার সরকার।
ডঃ মশিউর রহমান বলেন, মানবাধিকার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর যে বক্তব্য সেমিনারে উত্থাপিত হয়েছে, সেদিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি বলেন, এটা আদৌ ঠিক নয়। বরং তিনি অভিযোগ করে বলেন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের প্রতিবেদন প্রকাশের আগে গণতান্ত্রিক পন্থায় উভয়ের বা উভয় সংগঠনের বক্তব্য নিতেন বা নিয়ে প্রকাশ করতেন, তাহলেই তাদের প্রতিবেদনে আসল চিত্র প্রকাশিত হতো।
টিভি ব্যক্তিত্ব, সাংসদ ও মানবাধিকার নেত্রী এডভোকেট তারানা হালিম বলেন, সরকারি দল হওয়া সত্যেও বহু যায়গায় বিরোধীদলের হাতে অনেক নেতা কর্মী হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ, র্যা বের লোকজন আহত হচ্ছেন, মার খাচ্ছেন, অথচ মানবাধিকারের সংগঠনগুলো সেই সব কথা তাদের রিপোর্টে কখনো তুলে ধরছেন না।
সেমিনারে বিএনপির বক্তব্য-
আওয়ামীলীগের এইচ টি ইমামের বক্তব্যের জবাবে সেমিনারের বিএনপির সাবিহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে আওয়ামীলীগ বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হয়েই বসে। এর পরে যে আসন গুলোতে নির্বাচন হয়, তার মধ্যে ৪১টি আসনে কোন ভোটই পড়েনি। আর বাকি যেগুলোতে ভোট পড়ে তাতে শতকরা হিসেবে খুবই সামান্য এবং এর মধ্যেও একতরফা নির্বাচনে কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ সংবাদ পত্র ও মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।
সাবিহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, নির্বাচন কমিশন সরকারের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে। এটা আজ সরকারের আজ্ঞাবহ এক প্রতিষ্ঠান।
তিনি বলেন, বিরোধীদলকে সরকার দমন পীড়ন করেছে, এমনকি ঐ সময়ে বিএনপির দলীয় অফিস পর্যন্ত পুলিশ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে রাখে, কাউকে দলীয় অফিসে যেতে দেয়া হয়নি। ২৯ ডিসেম্বরের কর্মসূচী পালনের জন্য খালেদা জিয়া দেশবাসীকে আহবান জানানোর পরে বিরোধী দলীয় নেত্রীকে কার্যত বন্দী করে রাখা হয়েছিলো, কোথাও বের হতে দেয়া হয়নি, কোন নেতাকর্মীদের সাথে দেখা করতেও দেয়া হয়নি। রাস্তা বালুর ট্রাক রেখে নেত্রীর বাসা বাড়ীতে অবরুদ্ধ করে রাখার সংবাদ বিশ্ব মিডিয়ায় এসেছে।
সাবিহ উদ্দিন চৌধুরী আরো বলেন, বিরোধী মত ও পথকে দমন পীড়ন, হত্যা, গুম, নির্যাতন এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সহ রাষ্ট্রের নাগরিকদের মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করা হচ্ছে। যখন তখন নেতা কর্মীদের গুম করে ফেলা হচ্ছে।
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী সহ অনেক নেতা কর্মী এই সরকারের সময় গুম হয়ে আছেন, যাদের হদীস এখনো মিলেনি। র্যাইব এখন ক্রস ফায়ারের জন্য জনগণের কাছে এক আতংকের নাম।
সাবিহ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, কোন প্রকারের সঠিক তদন্ত ছাড়াই বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের বোমাবাজির জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
ডঃ পিয়াস করিম বলেন, সরকারি দলের নেতারা দাবী করেছেন দেশ ঠিক ভাবে চলছে, উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে- এমন বক্তব্যের বিরোধিতা করে ডঃ করিম বলেন, এটা সঠিক খবর নয়। তিনি আরো যোগ করেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সকল দলের অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপর জোর দেন।
ডঃ পিয়াস করিম আরো বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধ করতে হবে। নাগরিকদের মানবাধিকার ও জান মালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। তিনি বলেন, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যে ভয়াবহ অত্যাচার ও নির্যাতন ও ধ্বংস সাধিত হয়েছে, এই সব বন্ধ করতে হবে আর সেজন্যে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আর এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।
অন্যান্য যারা সেমিনারে আলোকপাত করেন-
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ফিটজপ্যাট্রিক এমপি, সংখ্যা লঘু আন্দোলন অধিকারের নেতা মিহির সরকারে, বেসরকারি চ্যারিটির আব্বাস ফয়েজ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ব্রাড এডাম।
ফিটজপ্যাট্রিক এমপি বলেন, বাংলাদেশ কিভাবে চলবে সেটা সম্পূর্ণ বাংলাদেশের জনগণ এবং রাজনৈতিকদলগুলো ঠিক করবে।
তবে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক, আইনের শাসন, মানবাধিকারের সুরক্ষা হউক, রাজনৈতিক সংঘাত এবং সহিংসতা বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ডায়ালগ চালু করা জরুরী। আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার লক্ষে সকলে দলের মধ্যে ডায়ালগ চালু করার পরামর্শ তিনি তুলে ধরেন।
দুই ঘন্টাব্যাপী চলা এই সেমিনারে আওয়ামীলীগের সাধারণ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজিদুর রহমান ফারুক, যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি জালাল উদ্দিন, যুগ্ম-সাধারন সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এবং বিএনপির পক্ষে কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহিদুর রহমান, যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি শায়েস্তা চৌধুরী কুদ্দুস, সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ সহ যুক্তরাজ্যের বাংলা মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক ও প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
salim932@googlemail.com
০১লা এপ্রিল ২০১৪, লন্ডন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।