জয়বাংলা মানে কী:
মো. রহমত উল্লাহ্
ভোরের কাগজ: ২৬/০৩/২০১৪
বাংলা একাডেমির অভিধান অনুসারে 'জয়' শব্দের অর্থ হচ্ছে- 'সাফল্য, বিজয়, যুদ্ধাদি দ্বারা অধিকার, পরাভূত করা, দমন, শত্রু দমন' । বিজয় অর্থ- 'জয়, জিত, প্রতিপক্ষকে দমিত বা পরাজিত করা'। জয় এর বিপরীতার্থক শব্দ পরাজয়, পরাভব, হার' । গুণবাচক বিশেষ্য হিসেবে জয় শব্দটি অন্যান্য দু'একটি শব্দের সাথে যুক্ত হয়ে খুবই সুন্দর অর্থ প্রকাশ করে। যেমন: জয়কেতু- জয়পতাকা/ বিজয়ের নিশান, জয়ধ্বনি- জয়জয়কার / বিজয়ের আওয়াজ, জয়তু- জয় হোক, জয়তি- জয়যুক্ত হয়, জয়পত্রÑ জয় লাভের সনদ, জয়মাল্য- বিজয়ের মালা, জয়বাংলা- বাংলার জয়।
সংসদ্ বাঙ্গালা অভিধান এবং জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট এর ব্যবহারিক বাংলা উচ্চারণ অভিধান অনুসারে বাঙলা (বাংলা) শব্দটির অর্থ বঙ্গদেশ বা তত্রত্য অধিবাসীদের ভাষা। বাঙালি অর্থ বঙ্গদেশের অধিবাসী, বাংলাদেশের নাগরিক, বাংলাভাষী। জয়+বাংলা= জয়বাংলা অর্থ বাংলাদেশ ও বাংলাভাষার জয়। আমাদের অস্তিত্বে এই জয়বাংলা শব্দের/ স্লোগানের ব্যবহার ও কার্যকরিতা আরো অনেক ব্যাপক ভাবে বিস্তৃত।
১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা গঠনে সোহরাওয়ার্দির আহ্বান।
'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'- ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মি. জিন্নাহ্ এই ঘোষণার প্রতিবাদে উচ্চারিত 'না'! ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঘোষণা- 'আমরা বাঙালি'। এসব কিছুরই মূল ধ্বনি ছিল জয়বাংলা/ বাংলার জয়। বাংলার জয়ের জন্য লড়াই করতে করতে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে এ বাংলার মানুষ। আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে প্রকাশ করতে শুরু করে নিজেদের আত্মপরিচয়। প্রয়োজনীয়তা দেখাদেয় স্বতন্ত্র সাংগঠনিক কাঠামোর।
১৯৪৭ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠন করা হয় 'পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ' এবং ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় 'আওয়ামী মুসলিম লীগ'। আরো চাঙ্গা হতে থাকে বাঙালির বাঙালিত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন। এই আন্দোলন ঠেকানোর জন্য পাকিস্তান সরকার শুরু করে গ্রেপ্তার অভিযান। ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয় মাওলানা ভাসানীকে এবং ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেই সাথে গ্রেপ্তার করা হয় আরো অনেককেই।
এসব গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে আপামর জনতা। ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো। জয়বাংলা, জয় শেখ মুজিব। শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। জয়বাংলা, জয় শেখ মুজিব।
" স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে রাজপথ। বাঙালির বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্মগত অধিকার অস্বীকার কারার ব্যর্থ প্রয়াসে পাকবাহিনী ব্যবহার করে মারণাস্ত্রের ভাষা। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ হন রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত ও অহিউল্লাহ্। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার! সূচিত হয় বাংলা ও বাঙালির প্রাথমিক জয়। এই বিজয়ের সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চলে স্বাধিকার তথা স্বাধীনতা লাভের আন্দোলন।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে শেখ মুজিবুর রহমান উত্থাপন করেন বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা দাবি। শেখ মুজিব হয়ে উঠেন স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্রপথিক।
১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সংগঠিত হয় গণঅভ্যুত্থান। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রদান করা হয় 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি। 'জয়বাংলা' স্লোগানের সাথে যুক্ত হয় 'জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগান।
রেইসকোর্স ময়দান থেকে ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' প্রতিধ্বনিত হয় সারা বাংলায়। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের নামকরণ করেন 'বাংলাদেশ'! যেন পিতার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় অনাগত সন্তানের নাম। আওয়ামী লীগের গণ্ডী অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু মুজিব ও তার 'জয়বাংলা' স্লোগান হয়ে যায় সকল মুক্তিকামী মানুষের। ১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন- 'ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ মারা গেছে, স্বাধিকার অর্জনের জন্য বাংলার আরো ১০ লাখ প্রাণ দিবে'। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মোট ১৬৯ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে 'জয়বাংলা' ধ্বনিতে আওয়ামী লীগ জয় করে ১৬৭ আসন।
প্রমাণিত হয় বাঙালি জাতির বজ্রকঠিন ঐক্য। আরো অপরিসীম হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু মুজিবের মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্র 'জয়বাংলা'র শক্তি! যা ছিল বাংলার মানুষের বুকের গভীরে বাঙালিত্ব জাগানোর সফল হাতিয়ার, অতি সাধারণ বাঙালিকে বিশ্বসেরা বীর বাঙালিতে পরিণত করার কার্যকর দাওয়াই এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবার মূলমন্ত্র।
১৯৭১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক বক্তব্যে বলেন- "বিশ্বের কোনো শক্তিই আর বাঙালিদের দাসত্ব-শৃঙ্খলে আটকে রাখতে পারবে না। শহীদদের রক্ত আমরা বৃথা যেতে দিব না। জয়বাংলা"।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ গঠিত হয় 'স্বাধীনবাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'। স্লোগানে স্লোগানে আন্দোলিত হয় ঢাকাসহ সারা দেশ। 'জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু', "বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো", "তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা" "জাগো জাগো বাঙালি জাগো"। "জয়বাংলা, জয়বাংলা, জয়বাংলা"।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা।
ভঙ্গ করা হয় কারফিউ। "জয়বাংলা জয়বাংলা" ধ্বনিতে উদ্বেলিত বাঙালি। পাকিবাহিনীর হামলায় রাজপথে হতাহত হয় অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষ! ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ- পল্টন ময়দানে পরিবেশন করা হয় আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ জাতীয় সংঙ্গীত। উত্তোলন করা হয় আমাদের জাতীয় পতাকা। প্রচার করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র।
প্রতিদিন ৬টা-২টা হরতাল পালনের জন্য আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। সবার কণ্ঠে একই আওয়াজ "জয়বাংলা জয়বাংলা"। ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিবের কণ্ঠে ফুটে উঠে পিতার ভাষা- সাফল্যজনকভাবে পূর্ণ হরতাল পালনের জন্য আমি বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। যে কোনো মূল্যে অধিকার আদায়ের জন্য জনতাকে সংগ্রাম অব্যাহত রাখার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি এই মর্মে নির্দেশ দান করছি যে, হরতালজনিত পরিস্থিতির জন্য যেসকল সরকারি ও বেসকারি অফিসে এখনো পর্যন্ত মাসিক বেতন হয়নি, সেসব অফিস শুধুমাত্র বেতন দেওয়ার জন্য আগামী দুইদিনের হরতালকালে বেলা ২টা ৩০মিনিট থেকে বিকেল ৪টা ৩০মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকবে।
সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা পর্যন্ত চেক ভাঙ্গাবার ও শুধু বাংলাদেশের মধ্যে লেনদেনের জন্য ব্যাংকগুলোর প্রতিও একই নির্দেশ প্রযোজ্য হবে। অক্ষরে অক্ষরে পালিত হতে থাকে তার আদেশ-নির্দেশ। সাত কোটি প্রাণ এক করে তিনি হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির পিতা। তার প্রিয় ‘জয়বাংলা’ স্লোগান হয়ে উঠে বাঙালি জাতির 'মটো' (MOTTO – A short sentence or phrase used as a guiding principle)। মুক্তি ও বিজয়ের মূলমন্ত্র 'জয়বাংলা' মটোকে বুকের গভীরে ধারন করে, সমস্বরে উচ্চারণ করে, মরনের ভয়কে জয় করে, মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠে সমগ্র জাতি।
১৯৭১ সালের ৬ মার্চ- ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙ্গে বেরিয়ে অসেন ৩২৫ জন বাঙালি। সবাই প্রহর গুনতে থাকে উর্ধ্বে উঠার ইঙ্গিতবহ পিতার তর্জনি নির্দেশের অপেক্ষায়! ৭ মার্চ- রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সর্বকালের সর্ববৃহৎ জনসভায় বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদান করেন আমাদের ইতিহাসের সর্ব শ্রেষ্ঠ ভাষণ: "আমি প্রধান মন্ত্রীত্ব চাই না। দেশের অধিকার চাই। " এরপর যদি একটা গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়ৃ আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলুন। আমাদের যা-কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন।
রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইন্শাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা। মূলত এরপর আর অবশিষ্ট থাকে না বাংলাকে জয় করার ঘোষণা ও পরিকল্পনা।
সেদিন পিতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয় আরো ১০টি আদেশ: ১. সরকারি খাজনা বন্ধ। ২. সরকারি ও বেসরকারি অফিস এবং কোর্ট-কাচারি বন্ধ। ৩. রেলওয়ে ও বন্দরের কাজ চালু থাকবে। তবে সামরিক বাহিনী ও যুদ্ধাস্ত্র বহন চলবে না। ৪. বেতার ও টিভিতে সংবাদ ও বিবৃতি প্রচার হবে।
৫. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কেবলমাত্র আন্তঃজেলা ট্রাঙ্কল চালু থাকবে। ৬. সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ৭. স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনোভাবে কোনো ব্যাংক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা পাঠানো যাবে না। ৮. প্রতিদিন সমস্ত অট্টালিকায় কালো পতাকা উত্তোলিত হবে। ৯. হরতাল প্রত্যাহার করা হলেও পরিস্থিতির মোকাবেলায় আংশিক অথবা পূর্ণ হরতাল আহ্বান করা হবে।
১০. স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতি মহল্লা, ইউনিয়ন, থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হবে। তখন জাতির পিতা যেন অলিখিত সরকার প্রধান। শুধু সাধারণ মানুষ নয়; তার সফল নেতৃত্বের প্রতি আস্থালীল, শ্রদ্ধাশীল হয়ে আনুগত্য স্বীকার করেন দল-মত নির্বিশেষে (জামায়েতে ইসলামীসহ অনুরূপ কয়েকটি ছোট দল ব্যতীত) ছোট-বড় নবীণ-প্রবীণ সকল নেতাকর্মী ও সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ। ১৯৭১ সালের ০৯ মার্চ- মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন- 'আমার তিনটি ছেলে, তার মধ্যে একটি মুজিব’! ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ- ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা চলে নব্বই মিনিট। 'জয়বাংলা' স্লোগানের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময়েও তিনি কালেমা পাঠের সাথে 'জয়বাংলা' উচ্চারণ করবেন'।
তিনি জানতেন, তার প্রিয় 'জয়বাংলা' স্লোগান মুক্তিকামী মানুষের রক্তের স্পন্দন, মুক্তির মন্ত্র। তখন তার সম্পর্কে দি 'নিউজ উইক' পত্রিকার মন্তব্য- 'উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি এ তিনটি ভষাতেই সাবলীল মুজিব নিজেকে নিয়ে মৌলিক চিন্তাবিদ হিসেবে ভান করতেন না। তিনি প্রকৌশলী নন, রাজনীতির কবি। বাঙালিদের প্রযুক্তির চেয়ে শিল্পকলার প্রতি প্রবণতা বেশি। আর তাই তার শৈলীই যথার্থ সেই অঞ্চলের সকল শ্রেণী ও মতাদর্শকে একাত্ববদ্ধ করার প্রয়োজনে'।
বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বিশ্বনন্দিত নেতা। তার জয়বাংলা ধ্বনিতেই সর্বত্র পরিচিত আমাদের এই বাংলা।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী শুরু করে গণহত্যা। রাত ১২টার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন বাংলাদেশ এখন থেকে স্বাধীন। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।
রণাঙ্গনে পরিণত হয় এই বাংলার প্রতি ইঞ্চি মাটি। জনককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। থেকে যায় জনকের আদেশ। ৭ মার্চে দেয়া জনকের দিক নির্দেশনা অনুসারে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে দেশের সকল মানুষ এই বাংলাকে জয় করার জন্য, শত্রুমুক্ত করার জন্য, 'জয়বাংলা' বলে ঝাঁপিয়ে পড়েন মরণপণ যুদ্ধে। সবার বুকে স্পন্দিত ও মুখে উচ্চারিত আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত 'জয়বাংলা' স্লোগান ছিল এই যুদ্ধেরও প্রধান হাতিয়ার।
২৬ মার্চ রাত ৮টায় এক বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া বলেন- 'শেখ মুজিব পাকিস্তানের শত্রু'। বাংলার সর্বাধিনায়ক বিশ্বনন্দিত অবিসংবাদিত নেতা জয়বাংলার প্রবক্তা বাংলাদেশের একমাত্র নিয়ন্ত্রক বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ২৭ মার্চ স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র কালুরঘাট থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পড়েন – “…On behalf of our great leader, the supreme commander of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman; I hereby proclaim the independence of Bangladesh. …May Allah help us, Joybangla.” ঔড়ুনধহমষধ.” যুদ্ধ চলাকালে মারতে মারতে এবং মরতে মরতে মুক্তিকামী মানুষ বার বার উচ্চারণ করেন 'জয়বাংলা' স্লোগান। জয়বাংলা নামে রণাঙ্গন থেকে তখন প্রকাশিত হতো একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা।
৯ মাসের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ১৬ ডিসেম্বর- ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে বিকেল ৫টায় ভারত ও বাংলাদেশের মিত্রবাহিনীর কছে পাকিস্তানি সৈন্যরা করে শর্তহীন আত্মসমর্পণ। ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণের মূল্যে ও রক্তের বিনিময়ে আমরা জয় করি 'বাংলা', অর্জন করি 'জয়বাংলা' মটো।
'জয়বাংলা' আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সফল হাতিয়ার! মূলত এই হাতিয়ারের বলেই আমরা পরাভূত করেছি পাহাড় সমান প্রতিপক্ষ, জয় করেছি আমাদের আসল পরিচয় বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মায়ের মুখের বাংলাভাষা ও মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
জয়বাংলা মানে- সেই সকল মানুষের জয়, যারা এই বাংলার মাটি ও মানুষকে শোষণ-নির্যাতনমুক্ত করার প্রত্যয়ে যুগে যুগে লড়াই করে হটিয়ে দিয়েছে আর্য, সুলতান, মুঘল, পাঠান, মারাঠা, বগির্, ইংরেজ, নীলকর, কাবুলিওয়ালা, জমিদার, পাকবাহিনীসহ নানা অপশক্তিকে। বুঝিয়ে দিতে হবে কেন 'জয়বাংলা' আমাদের জাতীয় 'মটো'। বলতে হবে, আমাদের আন্দোলনে-সংগ্রামে-যুদ্ধে কোথাও কোনোদিন বাঙালিরা বলেননি ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ(?)/ 'বাংলাদেশ চিরজীবি হোক'(?)। এহেন কথা কোনোদিন উচ্চারণ করেননি বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তেলাপোকার মতো, কচ্ছপের মতো বেঁচে থাকতে চাননি তিনি। আমাদেরকে দেননি কেবল জিন্দা থাকার মতবাদ। দিয়েছেন সার্বিক জয় ও মুক্তির মন্ত্র- 'জয়বাংলা'। শিখিয়েছেন সব ভালোতে জয়ী হওয়ার কৌশল। শুধু আমাদেরকেই নয় সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন- একটি ব্যাপক অর্থবোধক শক্তিশালী 'মটো'কে বুকে ধারণ ও মুখে উচ্চারণ করে জাগ্রত করা যায় বিবেক, শাণিত করা যায় চেতনা; বৃদ্ধি করা যায়- রক্তের গতি, হৃদয়ের স্পন্দন, সৎসাহস; জয় করা যায় না পারার ভয়; থাকা যায় ঐক্যবদ্ধ; পরাস্ত করাযায় শত্রু; অতিক্রম করা যায় প্রতিকূলতা; সুনিশ্চিত করাযায় অগ্রগতি; সুপ্রতিষ্ঠিত করা যায় সত্য; সম্পাদন করা যায় সকল ভালো।
এজন্যই একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পরও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবার তর্জনি উর্ধ্বমুখি করে বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করতেন 'জয়বাংলা'। শুধু দেশে নয় বিদেশে গিয়েও প্রকাশ করতেন আমাদের ‘জয়বাংলা’ মটো। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গ সফর কালে কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দান করেন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানেও তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ‘জয়বাংলা’। তার বজ্র কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বারবার ‘জয়বাংলা’ উচ্চারণ করেছিল সে দেশের উপস্থিত জনতা! কী উচ্চারণ করেছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটবিদ্ধ পিতার অসীম সাহসী বুক থেকে ফিন্কি দিয়ে বেরিয়ে আসা অপরাভব রক্তের প্রতিটি বিন্দু? যিনি বলেছিলেন, শেষনিশ্বাস ত্যাগের সময়েও তিনি কালেমা পাঠের সাথে 'জয়বাংলা' উচ্চারণ করবেন’।
খুনিরা জানতো না ‘শেখ মুজিব’ যেমন অমর পুরুষ, 'জয়বাংলা' তেমনি অমর বাণী। কিন্তু আমরা কি তেমন করে বুকে ধরে রাখতে পেরেছি, মুখে উচ্চারণ করতে পেরেছি, কাজে পরিণত করতে পেরেছি অমর পুরুষের সেই অমর বাণী? পারিনি বলেই আজ আমরা হারাতে বসেছি আমাদের জাতীয় ঐক্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অগ্রগতির পন্থা। তাইতো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার মনে নিত্য ঘুরপাক খায় নানান কথা, নানান প্রশ্ন! 'জয়' কি আমাদের কথা নয়? 'রাজ্য জয় করেন। বাংলা জয় করেন। এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করেন।
বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা জয় লাভ করেন। অমুককে কাস্তে / নৌকা/ দাঁড়িপাল্লা / ধানের শীষ / লাঙ্গল / বটগাছ মার্কায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করুন। ' যুগ যুগ ধরে এমন হাজারো ক্ষেত্রে আমরা গর্বসহকারে ব্যবহার করছি 'জয়' শব্দটি। এই শব্দ যোগে রয়েছে আমাদের অনেক নাম। যেমন: আলহাজ্ব মো. জয়নাল আবেদিন, জয়নগর, জয়পুরহাট, জয়ন্তিকা,।
এতে কোনো সমালোচনা নেই, বিতর্ক নেই। অথচ বিতর্কিত করার ব্যর্থ প্রয়াস চলে জয়ের সঙ্গে বাংলা যুক্ত করে জয়বাংলা বলতে গেলেই! বলা হয়, জয় হিন্দু শব্দ! জয়বাংলা ডেড স্লোগান! মূলত জয়বাংলার ঐক্যের কাছে যে পরাজিত, জয়বাংলা স্লোগানকে এখনো যে ভয় পায়, বাংলা ভাষাকে যে নিজের ভাষা মনে করে না, বাংলাদেশকে যে স্বাধীন ভাবতে কষ্ট পায়, যে মানতে পারে না বাঙালি জাতির অস্তিত্ব, সর্বোপরি ‘বাংলা’র মাটি ও মানুষের জয় যার কাছে প্রত্যাশিত নয় এবং 'বাংলা'র মাটি ও মানুষের জয়ের আনন্দ যার কাছে বেদনাময়; কেবল তার কাছেই বিতর্কিত 'জয়বাংলা'! তার জন্য আমরা কি ত্যাগ করবো আমাদের জয়বাংলা মটো? অপ্রিয় লোকে মধু খায় বলে আমরা কি খাবো না মধু?
দিনাজপুর জেলা ভারতেও আছে বলে আমরা কি ভারত বলবো আমাদের দিনাজপুরকে? বাঙালিরা ভারত, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিক আছে বলে আমরা কি হীনমন্যতায় অস্বীকার করবো আমাদের স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তা? নাকি বিজয়ী বীরের মতো কৃতিত্বে-সফলতায় বার বার বাঙালিত্ব প্রকাশ করে ছাপিয়ে দিবো অন্যদের অস্তিত্ব? আমার নামে আরো হাজারো ভালো/ মন্দ মানুষ ছিল বলে, আছে বলে আমি কি বাদ দিয়ে দেবো নিজের নাম? ভারতে কাশ্মিরি আছে বলে নিজেদের জাতীয় পরিচয় কি অস্বীকার করছে পাকিস্তানের কাশমিরিরা? তাহলে আমরা সমস্বরে বলবো না কেন- আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের ভাষা, বাংলা আমাদের দেশ, জয়বাংলা আমাদের মটো। জয়বাংলা আমাদের ঐক্যের বন্ধন, অগ্রগতির পাথেয়, জয়ের শক্তি। খেলাধুলাসহ বিভিন্ন শুভ প্রতিযোগিতায় অন্যান্য দেশকে হারিয়ে দিয়ে, সুশিক্ষা অর্জন করে, পরিক্ষায় প্রথম হয়ে, সকল শুভ কামনা করে, অমঙ্গল পরাজিত করে, নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার করে, দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করে, সুখ-শান্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করে, নোবেল পুরস্কার জয় করে, বার বার 'জয়বাংলা' বলে একসঙ্গে নেচে উঠবো আমরা! মহান শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও শোক দিবসসহ সকল জাতীয় দিবসে জয়বাংলা ধ্বনিতেই প্রকাশ করবো আমাদের আনন্দ / শোক / প্রতিবাদ! মনে রাখতে হবে- সেই পরাজিত ইংরেজ শোষকদের V (ভি) বাঙালিদের জয়ের সংকেত নয়। বাঙালিদের জয়ের সংকেত ঊর্ধ্বে ওঠার ইঙ্গিতবহ ঊর্ধ্বমুখি তর্জনি।
বাঙালিদের সার্বিক জয়ের বজ্রধ্বনি 'জয়বাংলা'। বাঙালি জাতির সফল জাতীয় মটো 'জয়বাংলা'।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।