এখনো গেলনা আঁধার............... রাহুল রাহা, সাংবাদিক
২০০৬ সালের শেষের দিকে একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত একটি তথ্যচিত্রের গবেষণা, পান্ডুলিপি রচনা, ভিডিও সম্পাদনা ও কণ্ঠদানের কাজটি আমি করেছিলাম। তথ্যচিত্রটি বহুল প্রচারিত একটি চ্যানেলে বার বার প্রচারিত হওয়ায় ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিলো। ঐ তথ্যচিত্রটি সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত হলেও বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সেটি প্রচার করায় বিএনপি-জামাত জোট ক্ষুব্ধ হয়। তারা নির্বাচন কমিশনে এ নিয়ে আপত্তিও দেয়। তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামসুল হুদা আমাকে ফোন করে তথ্যচিত্রটির প্রচার বন্ধ করার অনুরোধ করেন।
কিন্তু আমি তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে সক্ষম হই যে, এটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এটি আওয়ামী লীগের কিছু নয়। ফলে এটি নিয়ে বিরোধীদের আতঙ্কিত হওয়ার কোন কারণ নেই।
ঐ তথ্যচিত্রে আমার সবচেয়ে প্রিয় একটি শট ছিলো। সেটি হলো মুক্তিযোদ্ধারা কোন একটা মাঠে ট্রেনিং নিচ্ছেন আর অস্ত্র উঁচিয়ে বলছেন, জয় বাংলা।
সেই উচ্চারণের যে দৃপ্ততা, যে উদ্দামতা, যে গরিয়ান ভাব, সেটিই আমাকে বেশী আকর্ষণ করতো। দুই ঘণ্টার তথ্যচিত্রটি বানাতে বানাতে আমার মনে হয়েছিলো, মুক্তিযুদ্ধ যেন একটা অস্ত্র, আর জয় বাংলা সেøাগান ছিলো তার বারুদ।
কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্বেও ‘জয়বাংলা’ সেøাগানটা আমি দিতে পারতামনা। কারণ, সাংবাদিক হিসাবে আমি সব সময়ই চেয়েছি নিরপেক্ষ থাকতে। কোন বিশেষ দলের প্রতি আমার কখনো যেন কোন ধরনের আনুগত্য প্রকাশ না পায়, সে ব্যাপারে আমি খুব সচেতন।
আর জয়বাংলা সেøাগানটা এতটাই আওয়ামী পক্ষীয় যে, সেটা দেওয়ার পর আর নিজেকে নিরপেক্ষ মনে করা যেতো না। যদিও আমি খুব ভালো করেই জানতাম, এটা মুক্তিযুদ্ধের জনযুদ্ধের মূল মন্ত্র। তারপরও পচাত্তর পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায়, সবকিছু দ্বিখ-িত করার সংস্কৃতিতে এই সেøাগানটা দিলে সহজেই যে কাউকে আওয়ামী ঘরানায় ফেলে দেয়া যেতো। সেই সহজ বিভক্তির পথে আমি হাঁটতে চাইনি। এখনো চাইনা।
শাহবাগ আমাকে নতুন করে সেøাগানটা উচ্চারণের শক্তি যোগালো। একাত্তরের সেøাগানগুলো কি অসাধারণ অভিব্যক্তি নিয়ে এদেশের তরুণেরা ফিরিয়ে আনলো। মাত্র পাঁচদিন আগেও এটা কল্পনার বাইরে ছিলো। শাহবাগের প্রতিবাদী তরুণ-তরুণীরা তাদের সেøাগান শুরু করছে ‘জয় বাংলা’ বলেই। একাত্তরের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার থেকে মাত্র কয়েকশ’ ফুট দূরে শাহবাগ চত্বরে বেয়াল্লিশ বছর পর ফিরে এলো সেই সব সেøাগানগুলো।
আর এবার সেই সেøাগানগুলো উচ্চারণ করছে হাজার হাজার নতুন প্রজন্মের মানুষ যাদের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক পক্ষপাত নেই। বরং তারা উল্টে ঐ সেøাগানের একক দাবিদার আওয়ামী লীগ নেতাদের ধারেকাছে খুব একটা ভিড়তে দেয়নি। ঐ তরুণ-তরুণীদের একটাই দাবি, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি, একটাই পক্ষ, বাংলাদেশ। তারা আবার দেশবাসীকে মনে করিয়ে দিলো, জয়বাংলা কোন দলের সেøাগান নয়, এটা বাংলাদেশের সেøাগান। বাংলাদেশের সব কাজ- কি রাষ্ট্রীয়, কি সামাজিক-শুরু হওয়া উচিত জয়বাংলা সেøাগান দিয়ে।
শাহবাগে আরো একটা বিষয় লক্ষণীয় ছিলো। জয়বাংলা যাতে আওয়ামী সেøাগান না হয়ে যায়, সে ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলেন লাকী আক্তারসহ সব সেøাগানদাতারা। ‘জয়বাংলা’-বলার পর তারা সচেতন ভাবেই তারা ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলেনি। তারা বলেছেন, ক্ষুদিরামের বাংলাদেশ, তীতুমীরের বাংলাদেশ, কিন্তু বলেনি, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। আমি তাদের কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছি, বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু-এই দুটি নাম কি আলাদা করা সম্ভব? তারাও জানে সম্ভব নয়।
তারপরও যাতে কেউ এই উদ্যোগকে গতানুগতিকভাবে বিশেষ কোন ধারায় ফেলে দিতে না পারে, সে জন্যই তারা এই সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। আমি যেমন সতর্ক ছিলাম জয়বাংলা উচ্চারণে। পাশাপাশি, তাদের অন্যমতও আছে। তারা মনে করে, আওয়ামী লীগ জয়বাংলা আর বঙ্গবন্ধু শব্দটাকে এতটাই কুক্ষীগত করার চেষ্টা করেছে যে, তার কারণেও অনেকে মহান এই সেøাগান দিতে পারেনি। মহান এই নেতাকে নিয়ে গর্ব করতে চেয়েও পারেনি।
বঙ্গবন্ধু গোটা দেশের কিন্তু আওয়ামী লীগ চেয়েছে তাদের নিজেদের করে রাখতে। এটা আওয়ামী লীগেরই ব্যর্থতা। শাহবাগের তারুণ্য সেই আসল ভুলের ক্ষতে ঘা দিতে পেরেছে। মুক্ত করতে পেরেছে জয়বাংলা সেøাগানকে। যারা স্বাধীনতা বিরোধী ও তাদের সমকালীন দোসর, তারা হয়তো অতসহজে এই সেøাগান মেনে নিতে পারবেন না।
কিন্তু এদেশের তরুণ সমাজ, যারা মূল জনসংখ্যার প্রায় ৭০ ভাগ, তারা যে এটা লুফে নিয়েছেন সে বিষয়ে খুব একটুও সন্দেহের অবকাশ নেই। আগামী ৩০ বছর দেশের চাবিকাঠি তাদের হাতেই থাকবে। কাজেই ধরে নিতে পারি, ‘জয়বাংলা’ ফিরে এলো।
মা’র মুখে গল্প শুনেছিলাম। বাহাত্তর সালে ভারত থেকে শরনণার্থীরা দেশে ফিরতে শুরু করলে স্থানীয় অনেকেই বলতে শুরু করেন, ঐ যে জয়বাংলা ফিরছে।
শরণার্থী শিবিরে চোখওঠা রোগ ব্যাপকভাবে দেখা দিয়েছিলো। পশ্চিমবঙ্গে চোখওঠার তখন নাম হয়ে যায় জয়বাংলা হওয়া। অনেকে নবজাতকের নামও রেখেছিলেন, জয়বাংলা। তখন শরণার্থী শিবিরে নতুন শিশু জন্মনিলে তাকেও জয়বাংলা বলা হতো। রেশন বা রিলিফ নিতে বাংলাদেশীরা গেলেও বলা হতো, জয়বাংলা নিতে এসে গেছে।
এভাবেই জয়বাংলা শব্দটি ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিলো সেদিনের মুক্তিযুদ্ধ ও গোটা বাংলাদেশের অস্তি¡ত্বের সঙ্গে। স্বাধীনতা বিরোধীদের খপ্পরে পড়ে সেই পাসওয়ার্ড বা মূলমন্ত্রকে আমরা বহুবছর কুক্ষিগত রেখেছিলাম। শাহবাগের প্রযুক্তিনির্ভর তারুণ্য সেই পাসওয়ার্ড বাঙালিকে ফিরিয়ে দিলো। এজন্য তাদের সবিশেষ ধন্যবাদ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।