সভ্যতার সৃষ্টি লগ্ন থেকে মানুষ আকাশ পানে চেয়ে বিস্মিত হত। আকাশের চন্দ্র, সূর্য সবকিছুই ছিল তার কাছে অপার বিস্ময়ের। বিজ্ঞানের চেতন তখনও মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি। তাইতো আকাশের এত সব কিছুর মধ্যে কখনও কাউকে স্রষ্টা, কখনও বিভিন্ন দেবতায় ভূষিত করে পূজা করত। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের মনে সৃষ্টি হয় জ্ঞানের চেতনা, সৃষ্টি হয় হাজার প্রশ্নের।
মেলানোর চেষ্টা করে পৃথিবীর সাথে গ্রহগুলোর সম্পর্ক। আর এই সম্পর্কিত বিষয় গুলোর অবতরনের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের।
দিন, তারিখ সহকারে বলতে না পারলেও গবেষকরা মোটামুটি নিশ্চিত জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূচনা ঘটে চীন দেশে। তবে তাদের গবেষণার বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। বিশ্ব প্রকৃতির রহস্যর উন্মোচনে যে মানুষটি প্রথম পথ দেখান তিনি পিথাগোরাস।
তিনি প্রথম পৃথিবী তার অক্ষের চারদিকে আবর্তন করছে, এই ধারণা দেন। কিন্তু তার এই অভিমত তখন কেউ গ্রহন করেনি। তার পর এলেন প্লেটো ও অ্যারিষ্টটল। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অ্যারিষ্টটল কোন পর্যবেক্ষন পরীক্ষা ছাড়াই একাধিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছিলেন। তার ধারণা ছিল পৃথিবীর স্থির।
পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা একই পথে আবতির্ত হচ্ছে, চাঁদের নিজস্ব আলো আছে। তাঁর এই মতবাদ মানুষ অভ্রান্ত বলে মেনে নিল। পরবর্তীকালের বিজ্ঞানি টলেমি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নানান তত্ত উদ্ভাবন করলেন। তার এই সব তত্ত্বগুলিই ছিল ভুল। তিনি বললেন বিশ্ব একটি গোলক এবং গোলকের মত ঘুরছে।
পৃথিবীও একটি গোলক এবং তা বিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত। আর সূর্য সহকারে সমস্ত বিশ্বজগত পৃথিবীকে কেন্দ্রে করে ঘুরছে। অ্যারিষ্টটল ও টলেমি এই সব তত্ত্ব ও সূত্র গুলি প্রায় চৌদ্দশো বছর ধরে মানুষ অভ্রান্ত সত্য বলে মেনে নিয়েছে। তাদের ভুল তত্ত্বগুলো নিরুপণ করার চেষ্টা কেউ করেনি। যীশুর জন্মের পরবর্তীকালে যখন বাইবেল রচিত হল, বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য সম্বন্ধে বাইবেল রচনাকারদের সামনে টলেমির সিদ্ধান্তগুলো বর্তমান চিল।
তাই সেই সব অভিমতকেই বাইবেলের অর্ন্তভূক্ত করে নিল। অল্প দিনের মধ্যে তা ধর্মের অঙ্গ হিসাবে পরিগণিত হলো। পরবর্তীকালে মানুষ বাইবেলের প্রতিটি কথাকেই ধ্র“ব সত্য বলে মনে নিল। কারো মনে এই নিয়ে কোন সন্দেহ রইলো না। এমনকি বৈজ্ঞানিকরাও বাইবেলকে অভ্রান্ত বলে মেনে নিল ।
মূলত তখন সমগ্র ইউরোপ জুড়ে পোপের ব্যাপক প্রতাপ। ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারো ছিল না। কেউ বলার চেষ্টা তরলে তার উপর নেমে আসত নির্যাতন। আগুনে পুড়ে মারার মত ঘটনাও ঘটেছে। এই অন্ধকারের মধ্যে অল্প কয়েকজন মানুষ এগিয়ে এল।
তাঁরা মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে সত্য প্রকাশ করল। তাঁদের আবি®কৃত সত্যের আলোয় বিজ্ঞান নতুন পথের সন্ধান পেল। আর এই সব মহান বিজ্ঞানীদের অগ্রপথিক যিনি তাঁর নাম নিকোলাস কোপার্নিকাস। আধুনিক কালের শ্রেষ্ট বিজ্ঞানী আইনষ্টাইন যাকে আধুনিক বিজ্ঞানের স্থপতি বলে সম্বোধন করেছেন।
জন্ম ও জীবনবৃত্তান্তঃ ১৪৭৩ সালের ১৪ ই ফেব্র“য়ারী পোল্যান্ডের থর্ন শহরে কোপার্নিকাসের জন্ম।
থর্ন বাল্টিক সাগরের কাছে ভিস্টল নদীর তীরে ছোট বন্দর শহর। বাবা ছিলেন তামা ব্যবসায়ী। কোপার্নিকাসের পারিবারিক নাম ছিল নিকোলাস কোপার্নিক। কোপার্নিক শব্দের অর্থ বিনয়ী । শুধু নামে নয়, আচার ব্যবহারে স্বভাবেও কোপার্নিকাস ছিলেন যথার্থই বিনয়ী।
ছেলেবেলা থেকেই কোপার্নিকাসের আকাশে গ্রহ, নক্ষত্র, সূর্য, চন্দ্র, তারা সম্বন্ধে ছিল গভীর কেীতূহল। এ দিকে মাত্র দশ বর বছর বয়সে বাবাকে হারান। বালক কোপার্নিকাসের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন কাকা লুকান ভাৎসেন রোড। কাকার বাড়িতে বিশাল বড় গ্রন্থাগার বাবাকে হারানোর দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। সারাদিন নানান বিষয়ে বই পড়তেন ।
তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত বিজ্ঞান আর সাহিত্য।
স্কুলের পড়াশুনা শেষ করে বাবার ইচ্ছানুসারে ডাক্তারিতে ভর্তি হলেন। ডাক্তারিতে পাশ করলেন। কিন্তু মানুষের দেহের জটিলতার তুলনায় তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করত বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের জটিলতা। তাই স্থির করলেন শিক্ষা সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমি ইতালিতে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করবেন।
কাকা তাকে পড়বার অনুমতি দিলেন। যথাসময়ে তিনি বেলগনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষা শেষ করে রোম বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসাবে যোগদিলেন।
সেই সময়ে টলেমির সিদ্ধান্তগুলো ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রধান পাঠ্য। কিন্তু কোপার্নিকাসের মনে টলেমির সিদ্ধান্তগুলো সম্বন্ধে সন্দেহ জেগে উঠে। পৃথিবী এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, তাঁকে কেন্দ্র করে সূযর্, তারা, চাঁদ ঘুরছে।
এই মতকে তিনি অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারেন নি। ক্লাসে যখন তিনি ছাত্রদের টলেমির সিদ্ধান্তগুলো পড়াতেন তখন বার বার তার মনে হত তিনি ছাত্রদের ভুল শিক্ষা দিচ্ছেন। প্রকৃত সত্যকে জানবার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠত। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস ও টলেমির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যারা দ্বিমত পোষণ করতেন তাদের যুক্তি ও সিদ্ধান্তগুলো গভীর মনোযোগ সহকারে অধ্যায়ন করতে আরম্ভ করলেন। সে সময় অ্যারিষ্টরকাস, কুপার নিকোলাস, লিওনার্দ দ্যা ভিঞ্চি বিশ্বাস করতেন পৃথিবী স্থির নয়, গতিশীল।
তিনি বললেন, শুধু বিশ্বাস নয়, পরীক্ষার দ্বারা প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে হবে। তখনো দুরবীন আবিস্কার হয়নি। রাতের পর রাত তিনি আকাশ পর্যবেক্ষণ করা আরম্ভ করলেন। প্রতিটি অনুসন্ধানের ফলাফল তিনি খাতায় লিখে রাখতেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছর তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান।
গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞাকে কখনোই তিনি প্রকাশ করেননি। সাধারণ মানুষের বিদ্রুপ উপহাসের চেয়ে পোপের ইনকুইজিনিসের ভয় ছিল অনেক বেশি। বাইবেলের বিরুদ্ধে কথা বলার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া।
জীবন সায়াহ্নে এসে কোপার্নিকাস তাঁর জীবনব্যাপী পর্যবেক্ষণ আর আবিস্কারকে প্রকাশ করলেন। তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থে দি রিভোল্যশনিবাস আরভিয়াম কোয়েলেসটিয়াম (মহাজাগতিক বস্তুগুলির ঘূর্ণন) বইটি রচনা করলেন কিন্তু প্রকাশ করলেন না।
বইটি ছিল কথোপকথন ভঙ্গিতে লেখা। যুক্তিনিষ্ঠ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কোপার্নিকাস তাঁর রচনা প্রকাশ করলেন না। তিনি শুধু মাত্র একটি সংক্ষিপ্ত সার প্রকাশ করলেন। তখনকার মানুষ এটিকে মজাদার কাহিনী বলে মনে করেছিল। পরে যখন মূল পান্ডুলিপি
পাওয়া যায় তখন জানা যায় প্রকৃত তথ্য।
১৫৪৩ সালে বইটি প্রকাশিত হল। কোপার্নিকাস এই বইয়ের মধ্যে দিয়ে যে সত্যের প্রতিষ্ঠা করলেন তার উপর ভিত্তি করে গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন, আইনষ্টাইন জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্তকে উন্মোচন করলেন। তিনি যে শুধু একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছিলেন তাই নয়, তিনি ইউরোপের প্রথম বিজ্ঞানী যিনি মধ্যযুগীয় কুসংস্কার, অন্ধকার বিশ্বাসের মূলে তীব্র আঘাত হেনেছিলেন।
এই মহান বিজ্ঞানী ১৫৪৩ সালে ২১ শে মে মৃত্যুবরণ করেন।
অবদানসমূহ: তার সারা জীবনের গবেষণার ফলাফল" ডি রিবোলশনিবাস ওরবিয়াম কোলেস্টিয়াল "তার শ্রেষ্ঠ প্রকাশনা।
বইটি তিনি টলেমির সিদ্ধান্ত সমূহের ভুল অত্যন্ত কঠিন যুক্তি খন্ডনের মাধ্যমে তুলে ধরেন। বইটির উল্লেখ যোগ্য সিদ্ধান্তসমূহ হলbr /> (১) এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে কেবল একটিই কেন্দ্র নয় বরং এর সংখ্যা অনেক।
(২) পৃথিবী স্থির নয় বরং সে আপন কক্ষের চারদিকে আবর্তনের মাধ্যমে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।
(৩) পৃথিবী নয় বরং সূর্যকে ঘিরে গ্রহ সমূহ আবতির্ত হচ্ছে; শুধু মাত্র চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে।
(৪) সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্বের তুলনায় তাদের ব্যাস অনেক কম।
তদ্রুপ চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্বের তুলনায় ও তাদের ব্যাস খুবই কম।
পর্যবেক্ষণ যন্ত্রের অভাবে বইটিতে কিছু ভুল থাকলেও এই কথা সকল বিজ্ঞানী স্বীকৃতি দিয়েছেন যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের মৌলিক দিকপাত করছেন কোপার্নিকাসের বইটি।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী কোপার্নিকাস জ্যোতির্বিজ্ঞান ছাড়াও গণিত, চিকিৎসা, অর্থনীতি, আইনশাস্ত্র, রাষ্ট্রপরিচালনা সম্পর্কে গবেষণা করেন এবং এইসব সম্পর্কিত পুস্তক রচনা করেন।
সূত্র : বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী
উহকপিড়িয়া, দি ফ্রি এনসাইক্লোপিড়িয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।