হতাশা আর দু;খ ব্যাথা যাদের দেখে থমকে দাঁড়ায় আজকে তাদের খুব প্রয়োজন, বিশ্ব এসে দু হাত বাড়ায়। ঘটনার বিবরন শুনে মনে হতে পারে আদিম অসভ্য যুগের কোন ঘটনা। কিম্বা সিনেমার কল্পিত দৃশ্য। মনে হতে পারে কোন অত্যাচারী রাজা বা জমিদার খাজনা না পেয়ে তার জল্লাদ বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে। বলছিলাম বিশ্বজিত হত্যার কথা।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে বিশ্বজিত হত্যা দৃশ্য কোন সিনেমার অংশ নয়। এটা অনেক অতীতের ঘটনা নয়, কোনা রাজা বা জমিদারের রাজত্ব নয়। বিশ্বজিত কোন খাজনা বাকী পড়া প্রজা ছিল না। এমন আমাদের গণতন্তের সোল এজেন্ট প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কোনটির কর্মীও ছিল না। নিতান্তই পেটের দায়ে কর্মস্থলে যাবার চেষ্টায় রাস্তায় বেরিয়েছিল এক কর্মজীবি তরুন যার স্বপ্ন ছিল একদিন মাকে এনে তার কাছে রাখবে!
এটা মুখ মুখে শোনা অতিরঞ্জিত কোন ঘটনা নয়।
একুশ শতকের মিডিয়ার কল্যাণে আমরা এর ভিডিও দেখেছি, সংবাদ পত্রে ছবি দেখেছি। খুন করবার পর খুনীদের কেক খাওয়ার ছবি দেখেছি। ইন্টারনেট ও সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে জনগনের প্রতিক্রিয়া দেখেছি। আর নতুন করে উপলব্ধি করেছি যে আমরা নিজেদের সভ্য জগতের বাসিন্দা ভেবে আসলে কোন বোকার স্বর্গে বাস করছি। বুঝেছি গনতন্ত্রের নামে ভোট দিয়ে আমরা কোন দানব বানিয়েছি রাষ্ট্রকে।
এমনি কোন একদিন কোন এক ভুল মুহুর্তে আমি বা আমার কাছে কেউ বিশ্বজিতের মত ঘটনা শিকার হতে পারে ভেবে ভয়ে শিহরিত হয়েছি।
এই ঘটনার বিভিন্ন ধরেনের প্রতিক্রিয়া দেখেছি, কোনটা দেখে বাক্যহারা হয়েছি। সব পত্রিকায় এসেছে সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীরা এই খুন করেছে। সরকারী দল অবলীলায় এই হত্যার দ্বায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছে। বলা হয়েছে বিশ্বজিত নাকি ভুল সময়ে ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল, এখানে সরকারের কোন দায় নাই।
কাছে যে পুলিশ দাঁড়িয়ে দ্বায়িত্ব পালন করছিল, তাদের কোন ব্যার্থতা নাই। খুনীরা যেই হোক তাদের আইনের আওতায় আনা হবে, এমন কোন কথা আমরা শুনিনি বরং দেখেছি ছাত্রলীগ জড়িত নয় এটা প্রমান করবার প্রানান্তকর প্রচেষ্টা।
কেউ কেউ দেখলাম সাংবাদিকদের এক হাত নিয়েছেন কারন তারা বিশ্বজিত কে বাচাতে না যেয়ে বরং তার ছবি তুলেছে। অবশ্য তারা কি সাংবাদিকদের বিশ্বজিত কে বাচাতে চেষ্টা না করার অমানবিক ঘটনায় ব্যাথিত নাকি সাংবাদিকদের ছবি তোলায় খুনীদের পরিচয় প্রকাশ হবার জন্য ব্যথিত সেটা নিয়ে একটু সংশয় রয়ে গেল মনের মধ্যে। এত বিস্তারিত পরচয়, নাম-ছবি থাকবার পরেও পুলিশ যে তাদের ধরতে পারছে না, অজ্ঞাতনামা দের আসামী করে মামলা হচ্ছে সেটা নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা দেখলাম না।
আরেক গ্রুপ পেলাম যারা চিহ্নিত খুনীদের শিবির প্রমান করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। বিশ্বজিত এক স্বাধীন দেশের নাগরিক তথা মানুষ আর যারা তাকে প্রকাশ্যে খুন করেছে তারা অপরাধী। তাদের অপরাধের সচিত্র প্রমাণও হাজির। অথচ আমরা এই সামান্য ও সহজ সমীকরন কে জটিল করে ফেলছি। যেন খুনী শিবির হলে তাদের ধরবার দায় রাষ্ট্রের নাই।
অবশ্য বিশ্বজিত হিন্দু ধর্মালম্বী হয়ে বেচে গেছে, না হলে তাকেও শিবির প্রমান করবার চেষ্টা হতো। যেন খুনী বা নিহত হওয়া ব্যাক্তি শিবির হলে যেন সুশীল সমাজ বিশাল দায় থেকে মুক্তি পেয়ে যেত!!
আরেক গ্রুপ পেলাম যারা মনে হলো বেজায় খুশী, সরকার কে বেকায়দায় ফেলবার একটা মারাত্মক অস্ত্র পাওয়া গেছে। ভিডিও-ছবি ফরোয়ার্ড করছে খুশি মনে। এরপর যদি কখনো বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং সরকারী দলের ক্যাডারদের হাতে এরকম ঘটনা ঘটে তাহলে এরা ব্যাথিত হবে না বরং বিশ্বজিতের এই ঘটনা নিয়ে এসে সে সরকারের সাফাই গাইবে। মন হচ্ছে এটা তারই প্রস্ততি।
বিশ্বজিতের জন্য তাদের মমতা বড় মনে হয়নি, বরং সরকার কে বিপদে ফেলবার অস্ত্র পাওয়াতেই তারা খুশী।
যেদিন বিশ্বজিত কে হত্যা করা হলো তার পরদিন ছিল মানবাধিকার দিবস। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের এসএমএস পেয়ে মনে পড়ল দিনটির কথা। একবার ভাবতে ইচ্ছে হলো আচ্ছা বিশ্বজিত কি মানুষ ছিলেন? তার কি বেচে থাকবার অধিকার ছিল? তাহলে মানবাধিকার কমিশনের কোন প্রতিক্রিয়া তো দেখলাম না। যে ঘটান রাষ্ট্রের অস্তিস্তকে প্রশ্নের সম্মুখিন করছে, সেই ঘটনায় মানবাধিকার কমিশনের ভুমিকা কি? আমি ক্ষুদ্র জ্ঞানে জানিনা মানবাধিকার কমিশনের কাজ কি।
তবে তারা ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে ও খুনীদের বিচার চাইতে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের কাছে যেতে পারতেন (সাধারন মানুষদের তো আর তাদের কাছে যাবার জায়গা নাই, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান চাইলে নিশ্চয়ই যেতে পারেন), নিদেন পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করতে পারতেন, হয়ত একদিন বিশ্বজিতের বাড়িতে যেতে পারতেন বা প্রেসক্লাবে অনশন করতে পারতেন। কিম্বা আমাদের মহামান্য হাইকোর্ট হয়তবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিম্বা প্রধানমন্ত্রী কে তলব করতে পারতেন! ঘটানার গুরুত্ব কি সেই পর্যায়ে ছিল না?
আসলে বিশ্বজিত আজ কোন ব্যাক্তি নয়, বিশ্বজিত আজ রক্তাক্ত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। ক্ষমতালোভী, প্রতিহিংসাপরায়ন, দুর্ণীতিগ্রস্ত রাজনীতির বলি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলি টার্গেট যেভাব হোক ক্ষমতায় যাওয়া, আর সেই পথে মাঝে মাঝেই প্রয়োজন হয় লাশের। কখনো তৃনমুল কর্মী, কখনো বিশ্বজিতের মত নিতান্তই ছা-পোষা নীরিহ মানুষ হয় এর শিকার।
আমাদের ভাইদের লাশ মাড়িয়ে আমাদের ভোটেই তারা ক্ষমতায় যান। লাশ দিয়েই বানানো হয় ক্ষমতার সিড়ি, আর কেউ ক্ষমতায় যাবার লোভে আর কেউ ক্ষমতা পোক্ত করবার চালে থাকেন, তাই লাশের রাজনীতি বন্ধ হয় না।
প্রিয় কবি নজরুল লিখেছিলেনঃ
হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।
তেমনি কবিরে সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাইঃ
আওয়ামি-বিএনপি-জামাত না কমিউনিস্ট,
নাকি সাধারন মানুষ যাকে আমরা মফিজ বলি,
জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী, বল মরিছে মানুষ, সন্তান মোরা মার!
কান্ডারী কি জাগবে? আমরা আর কোন লাশের রাজনীতি চাই না। চাইনা আর কোন মায়ের বুক খালি হোক এই নষ্ট রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার সিড়ি হবার জন্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।