মমতা মাখা নরম রোদের দিন । চোখের মনি দুটো আলাদা পথে এগুচ্ছে সামনের দৃশ্য টপকে অনেক দূরে । আমি জানি এই অন্যমনস্ক দৃষ্টিটা বেশ অস্বাভাবিক ও বিরক্তিকর ঠেকছে অন্যের কাছে । ঠিক হীরা আপাকে দেখে আমরা যেমনটা বোধ করতাম । অবশ্য সেই বয়সে যখন রহস্যগুলো আমাদের কাছে থাকে দুর্বোধ্য ও কৌতুকময় ।
আসলে অনুভূতিটা অদ্ভুত রকম করুণ ও ঘোর আসক্তির । যেন অন্য কোন ভুবনের পথ খুঁজে নিতে থাকা । এটা বুঝতে বুঝতে আমার অস্পষ্ট নাকসহ পুরোটাই এখন হীরা আপা হয়ে যায় । সব কিছু, সবাইকে পেড়িয়ে আমি অনেক দূরে চলে যাই। আমার চিবুক ঠিক হীরা আপার মতো বেঁকে যায় এদিকে সেদিকে কিসের যেন খোঁজে।
কোন এক পরিচিতার ডাকে আমি ইতস্তত: দাঁড়াই।
-আরে দেখেন নাই নাকি ?
-না। খেয়াল করি নাই।
পরিচিতার কথা দীর্ঘ মনে হয় । বাসায় যাবেন; বলে আলাপ ছেটে নেই।
আস্ত হীরা আপাকে নিজের ভেতর থেকে টেনে বের করতে করতে রাস্তাটা পার করে একটি শপিংমলে ঢুকি।
সাজানো সারি সারি পণ্য দেখে এবার ভীষণ ভালো লাগে। মুনিয়া পাখির মতো ভেতরটা এ ডাল ও ডাল করতে থাকে কি যেন চাই ! কি কি যেন চাই ! আমি শিউলীদির মতো ব্যস্ত হয়ে এটা ওটা হাতড়াই । রতন কাকার মেঝ মেয়ে শিউলীদি, যার বড় ঘরে বিয়ে হয়েছিল । তাকে শপাহলিক বলে খুব ঘৃণা করতাম এক সময় তাই তেমন একটা সখ্য গড়ে উঠেনি তখন ।
এখন কি সেই শোধেই সে বলা নেই কওয়া নেই আমার ভেতরে হুটহাট চলে আসে !
এই যেমন এই মুহূর্তে আমি কাণায় কাণায় অনুভব করছি তাকে । কি এক ভালোলাগায় , কি এক নেশায় কিনতে থাকছি ভুরি ভুরি প্রয়োজন । নিজের ভেতরের এই সুক্ষ্ম আনন্দকে আমি অবশ্য শিউলীদির মতোই অস্বীকার করে চলি । প্রশ্নের উত্তরে তার সুরেই বলি,
_ দরকার রে সোনা । কি আর এমন কিনছি !
গাড়ির ব্যাক ডালা বোঝাই ‘প্রয়োজন’ নিয়ে বাসায় ফিরে আসি।
সব গুছগাছ শেষে বুয়াদের কর্তব্য বুঝিয়ে বসে চায়ের কাপে চুমুক দেই। রুনা ভাবী এই সময়ে ঠিক এভাবেই চিন্তায় ডুবে পান চিবোতেন । ভঙ্গীটা কিছু একটা উপলব্ধির । অসময়ে এমন অদ্ভুত ভঙ্গীকে তখন মনে হতো পাগলামি । এখন বুঝতে পারছি লেবুর রস যেমন দুধ কেটে তাকে তরল থেকে কঠিন করে তোলে এই অনুভবগুলোও তেমন করে ধারনাগুলোর সার-সংক্ষেপ দিয়ে থাকে।
এভাবে ভাবনাগুলো থেকে থেকে একটি পরিনত উপলব্দির প্রক্রিয়া চলতে থাকে চায়ের চুমুকে চুমুকে।
কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে আমার সংবিৎ ফিরে। ঘরে বিশৃঙ্খলা দেখে আমি আমার মায়ের মতোই গর্জে উঠি । কর্তব্যে, ভালোবাসার প্রতাপে আমি আমার সংসারকে একটা মর্সৃণ গতি দেই । সন্তানদের শাসিয়ে, খাইয়ে , পরে অনুতাপের চুমুতে তাদের দেই একটা সফল নবায়ন ।
ঠিকঠাক হলো কিনা তা দেখতে শেষে আমার মায়ের সেই বিখ্যাত কৃষক চোখেই তাকাই।
সব চুকিয়ে ভাত ঘুমের জন্য আস্থির হয়ে উঠি কমল চাচীর মতো । আসলে এটাযে মাথায় কিলবিল করে গজিয়ে উঠা মেজাজের পোঁকাগুলো খুন করার অস্ত্র কে জানতো ! কিছুক্ষণের জ্ঞান লোপের এই আকাঙ্ক্ষা আমাকে অনেক আকুল করে তোলে। বিকেলে নিস্তেজ সূর্যের আলো আমার ঘর ছাপিয়ে যায় । ঘুম ভাঙ্গলেও সেই আলোতে আমি কমল চাচীর মতো বিছানায় এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি খাই।
বুঝতে থাকি আসলে অনুভূতিটা ভালো ও মন্দ লাগার মাঝামাঝি উপত্যকায় অথবা শূন্যতায় হেঁটে বেড়ানোর মতো ।
আঁধার বাড়তেই কাজের তাগিদ জেগে উঠে । ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো নিশু ফুফির সেই স্কুটিটার শব্দ পাই যেটার পেছনে চেপে মাঝে মাঝে আমিও সাইটে যেতাম। একজন জাদরেল পরিদর্শক হিসাবে তার ভুল ধরার চোখকে তখন শেয়ালের ধূর্ততায় মাপতাম । এখন তার মতো করে তাকাতে তাকাতে অবাক হই।
আসলে পরিদর্শক কোন চোখতো নয় ! চোখ থাকে তার উপরেই শত শত ।
রুটিন কাজগুলো সারতে সারতে আমি ভাবনা , আগ-পিছ ভুলে যাই। কখন রাত বেড়ে যায় টেরই পাইনা । ছেলেমেয়েরা শুয়ে পড়ে,আস্তে আস্তে সেই স্কুটিটার শব্দ দূরে মিলিয়ে যায়।
এখন আলাদা নিরিবিলি ।
স্বামী লোকটা খাওয়া শেষে ঘরে চলে গেছে। ঘুমিয়ে পড়ল কিনা কে জানে ! গত কিছুদিন মন -মালিন্য চলছিল। দোষটা তারই ছিল বলে কাল পরশু পর্যন্ত তার মধ্যে একটা মৃদু সমঝোতার ভাব ছিল। আজ তা মিইয়ে গেছে। যাবেই বা না কেন? পনেরো বছরের পুরোনো দাম্পত্যে এসব হালকা ব্যাপার।
তবু আমার অস্থির লাগতে শুরু করে ।
পরগাছা শিরদাঁড়াহীণ হীনমন্যতা আমাকে কুঁকড়ে ফেলে নিমেষে। নিজের অবস্থান , ক্ষমতা সব কিছুই মনে হয় একটা নড়বড়ে মাচায় দোল খেতে দেখি।
সমঝোতার জন্য মরিয়া হয়ে আমি অন্ধকার ঘরটাতে ঢুকি। স্বামীর পাশে শুয়ে তার পিঠে আলতো আঙুল ছোঁয়াই ।
আমার শরীর সেধে দিতে থাকি যেভাবে হয়তো হাসান লেনের, কালো দাঁত উঁচু মেয়েটা তার ক্রেতাকে দিয়ে থাকে । আমার লতানো অবস্থানকে সমর্পণের মোড়কে পেঁচিয়ে ওই নাম না জানা মেয়েটির মতোই নির্লজ্জ উল্লাস দেখাই। সকল অসহায়ত্ব লুকাই সবল শিৎকারের শব্দে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।