কবে, কখন পরিচয় আমার ঠিক মনে নেই। তবে পরিষ্কার মনে আছে, নব্বই-উত্তর গণতান্ত্রিক জমানায় পেশার তারে জড়ানো জীবনে রাজনীতির উত্তাল সময়টাতে যখন মাঠ চষে বেড়ানো রিপোর্টার, তখন প্রেসক্লাবের প্রবেশমুখে তিনি 'তুই' বলে সম্বোধন করেছিলেন। কমিউনিটিতে আমাকে 'তুই' বলে কোনো সিনিয়র সাংবাদিক সম্বোধন করেন না। মাঝেমধ্যে কেউ করতে চাইলেও আমার মন তা গ্রহণ করেনি। কিন্তু এ বি এম মূসা প্রথম দিন থেকেই 'তুই' বলে ডেকেছেন, ভুলেও কখনো তুমি বলেননি।
তার 'তুই' ডাকটার মধ্যে কী যে শক্তি ছিল, তা বোঝানোর সাধ্য আমার নেই। সাংবাদিকতা জগতে তিনি সর্বাধিকহারে অনুজদের 'তুই' বলে হাঁকডাক করতেন। এ বি এম মূসা নেই- ভাবতেই পারছি না। মানতেও পারছি না।
আমার প্রেমের শহর, জল, জোছনা, কবিতা, গান ও আড্ডার শহর সুনামগঞ্জে এসেছি মঙ্গলবার।
বুধবার দেরিতে ঘুম থেকে উঠে চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় বসতে না বসতেই মুঠোফোনের সুইচ অন করে খবর পেলাম বরিশালের সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণ এমপি আর নেই। মনটা খারাপ হয়ে গেল। তার পর পর সংবাদ দেখলাম প্রবীণ সাংবাদিক এ বি এম মূসা লাইফ সাপোর্টে। বুকের ভেতর ধক করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আবু শামীমকে ফোন করি।
বললেন, এ যাত্রায় মূসা ভাইকে হয় তো আর বাঁচানো যাচ্ছে না। ৩০ মিনিট পর আপনাকে জানাচ্ছি। বন্ধুবর সম্পাদক নঈম নিজামকে খবরটি দিয়েই আমি চুপ হয়ে বারান্দায় বসে থাকলাম। এই জীবনে অনেক কীর্তিমান পুরুষের স্নেহ-সানি্নধ্য পেয়েছি। উপমহাদেশের কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক আমাদের সবার প্রিয় মূসা ভাই তাদের অন্যতম।
তার 'তুই' ডাকটির মধ্যে অসাধারণ স্নেহের টান জড়ানো ছিল। তার 'তুই' ডাকটির মধ্যে পিতৃহৃদয়ের এক অধিকার ছিল। তার 'তুই' ডাকটির মধ্যে গভীর ভালোবাসা ও শাসনের সুর ছিল। এ বি এম মূসা আমাদের কমিউনিটিকে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ে রাখতেন।
বুধবার বেলা দেড়টায় ৮৩ বছর বয়সে এ বি এম মূসা নিয়তির কাছে হার মেনে চিরদিনের জন্য চোখ বুজেছেন।
আমার ভেতরটা পিতাহারা সন্তানের মতো কেঁদে উঠল। শাওয়ারে প্রবেশ করতে না করতেই চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি গড়াচ্ছিল। আমি কি দ্বিতীয়বার পিতাহারা হয়েছি? আফসোস, পিতার আসনে বসা মানুষটিকে ইদানীং একবারও দেখতে যাওয়া হয়নি।
আমার মেয়ে চন্দ্রস্মিতার জন্মদিন। বাসায় অনেক রাজনীতিবিদ- সাংবাদিকসহ মেহমানরা আসেন পারিবারিক অনুষ্ঠানে।
সেসব অনুষ্ঠানে এ বি এম মূসাও থাকেন। একবার মেয়ের জন্মদিনে মূসা ভাইকে টেলিফোন করতেই বললেন, গায়ে জ্বর। বললাম, মেয়েকে দোয়া দিতে আসতেই হবে। তার জবাব ছিল এমন, তুই আমার জন্য নরম খিচুড়ি রাখবি। আমি তাই করেছিলাম।
তিনি আমার ছোট্ট ঘরটি আলো করে বসেছিলেন। মূসা ভাইর জন্মদিনে পারিবারিক অনাড়ম্বর আয়োজন হতো ইকবাল রোডের বাসভবনে। সীমিতসংখ্যক অতিথির মধ্যে তিনি আমাকে ডাকতেন। আমার জীবন ধন্য, আমাদের অনেকেরই সৌভাগ্য এ বি এম মূসার স্নেহ-দোয়া পেয়েছি। শেষবার অসুস্থ হওয়ার আগে তিনি নিয়মিত টেলিফোন করতেন।
পত্রিকায় কোনো রিপোর্টে ভুল থাকলে, কোনো তথ্যে গরমিল থাকলে, বানানে গলদ থাকলে তিনি তা ধরিয়ে দিতেন। একজন উঁচুদরের সাংবাদিকই ছিলেন না, একজন উঁচুদরের অভিভাবকই ছিলেন না, একজন উন্নত, উচ্চশিক্ষিত পাঠকও ছিলেন তিনি। মূসা ভাই আমার লেখনী শক্তির উৎসাহদাতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক সাহসী ছায়া। মনে হতো, তিনি আগলে রেখেছেন তার বুকখানি দিয়ে। তার সঙ্গে কাজ করার সুবাদে দেখেছি, পেশাদারিত্বের অহঙ্কার ও আত্দমর্যাদার প্রশ্নে কখনো মাথা নোয়াতেন না।
অনুজ সহকর্মীদের আত্দসম্মান, সম্ভ্রম রক্ষা করতেন তার তেজস্বী ব্যক্তিত্ব দিয়ে।
এক বছর আগে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়েছিল। সাত বছর ধরে ছেলের মতো এই প্রবীণ সাংবাদিকের চিকিৎসার দেখভাল করার দায়িত্ব নেওয়া ডা. আবু শামীম তখনই আমাকে বলেছিলেন, এ যাত্রায় রক্ষা পেলেও তার শরীরের অবস্থা ভালো নেই। ছয় মাস আগে আবু শামীম আরও জানিয়েছিলেন, ব্লাডের সেল ভেঙে যাচ্ছে। নতুন সেল তৈরি হচ্ছে না।
তার শরীরে কিছু দিন পর পর রক্তও দেওয়া হচ্ছিল। 'আমাদের সময়'-এর সম্পাদক কবি আবু হাসান শাহরিয়ারও এ বি এম মূসার বুকভরা স্নেহ পেয়েছেন। মঙ্গলবার তাকে দেখতে গেলে, কথা বলতে পারেননি। আমাকে শামীম জানিয়েছেন, তাদের সঙ্গে চোখের ভাষায় কথা বলেছেন। ওজন কমে তখন ৩৫-৪০-এ চলে এসেছিল।
জাতীয় প্রেসক্লাবে অসংখ্যবার তিনি নেতৃত্বের আসনে অভিষিক্ত হয়েছেন। আমাদের সেকেন্ড হোম খ্যাত বা গণতন্ত্রের দ্বীপ জাতীয় প্রেসক্লাবে আজীবন সদস্য হয়েও তিনি নিয়মিত আসতেন। ছোট-বড় সবার টেবিলে, তাসের আড্ডা থেকে শুরু করে সবখানে তিনি জমিয়ে গল্প করতেন। তার আচরণে দেখেছি, তিনি ছিলেন শিশুর মতো সরল। দেশি-বিদেশি নামিদামি পাঠকপ্রিয় গণমাধ্যমে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্বশীল পদে কাজ করা এ বি এম মূসা এই বর্ণাঢ্য জীবনে সংসদ সদস্য থেকে অনেক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে কাজ করেছেন।
মনে হয় সেদিন কডের প্যান্ট আর মেরুন হাতাগুটানো লংস্লিপ গেঞ্জি পরিহিত এ বি এম মূসা বরফ দিয়ে কোকাকোলা পান করছেন। সিলেটে একবার তাকে নিয়ে ইতিহাসের বৃহত্তম সুধী সমাবেশ করেছিলাম। সিলেটের সাংবাদিক রেজোয়ান আহমেদ সেই আয়োজনে আমার সঙ্গে পায়ে পায়ে হেঁটেছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে আমরা এই দেশবরেণ্য সাংবাদিককে আজীবন সম্মাননা দিয়ে গর্বিত হয়েছি। গেল বছর ১২ নভেম্বর আমার জীবনে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেছি।
পঞ্চাশ বছর পূর্তি নিয়ে অনুজদের উদ্যোগে যে স্মারকগ্রন্থ বের করার কথা, তা রাজনৈতিক সহিংস পরিস্থিতির কারণে প্রকাশ হয়নি। এ বি এম মূসা সেই গ্রন্থের জন্য আমার শতায়ু কামনা করে একটি লেখা পাঠিয়েছিলেন। সেখানে তিনি আমাকে তার মুরিদ বলেই সম্বোধন করেছেন। মূসা ভাইয়ের সঙ্গে কথা ছিল, এ বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হবে সুনামগঞ্জে। তিনি হবেন মধ্যমণি।
এত দ্রুত এভাবে চলে যাবেন ভাবিনি। অনেক দিয়েছেন তিনি দেশ, মানুষ ও আমাদের। আরও দিতে পারতেন। আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা ঋণী।
ভারত বিভাগ থেকে পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসন, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, স্বাধীন দেশের ৪৩ বছরের ঘটনাবহুল জীবনের সরব সাক্ষী এ বি এম মূসা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখতে নোয়াখালীতে ছুটে আসা মহাত্দা গান্ধীর আগমনী সংবাদ শুনে তিনি ছুটে গেছেন। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের মহান নেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীসহ অনেক বিশ্ববরেণ্য নেতাকে কাছে থেকে দেখেছেন। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর স্নেহ-সানি্নধ্য পেয়েছেন। প্রখর হিউমার সেন্স আর বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায় আড্ডার আসর মাতিয়ে রাখা এ বি এম মূসা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কোমল হৃদয় দিয়ে 'প্রিয় মুজিব ভাই' বলে সম্বোধন করতেন।
তার লেখা 'মুজিব ভাই' গ্রন্থখানি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন করে বলেছিলেন, বইটি এনে পড়িস আর মতামত জানাস। কথা রেখেছিলাম।
আমার বাসভবনে এলে ছেলে অন্তর সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মূসা ভাই ডাকায় বলেছিলাম, চাচু ডাকবে। মূসা ভাই আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, তুই ভুল করছিস। ও ঠিকই আছে।
আমি ওর মূসা ভাই, ওর বাপের মূসা ভাই, ওর দাদার মূসা ভাই, ওর ছেলেরও মূসা ভাই। তিনি আসলেই ছিলেন আমাদের সবারই প্রিয় মূসা ভাই।
ওয়ান-ইলেভেনে অনেক দলকানা, দলদাসকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও, এ বি এম মূসা দুই নেত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এক নেত্রীকে বলেছিলেন দেশে ফিরে আসতে, আরেক নেত্রীকে বলেছিলেন, দেশ না ছাড়তে। মূসা ভাই আমার টকশো দেখে বলতেন, তুই বলিস ভালো, ভাষাশৈলীও চমৎকার।
কিন্তু দাঁড়ি, কমা কোথাও থাকে না। এমন দরদি অভিভাবক আমি আর পাইনি। কলাম পড়ে বলতেন, লিখিস খুব ভালো। কিন্তু লেখায় প্যারা থাকে না। অনেক লেখকের লেখায়ও কেন প্যারা থাকে না, তিনি জানতে চাইতেন।
পিতৃহৃদয়ের মূসা ভাই সত্যি আমার পীর ছিলেন। আমি ছিলাম তার মুরিদ মাত্র। ওয়ান-ইলেভেনে একজন সাধারণ সংবাদকর্মী বিপদগ্রস্ত হলে কেউ এগিয়ে না এলেও, মূসা ভাই গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের টেলিফোনের পর টেলিফোন করেছিলেন তাকে ছেড়ে দিতে। আপাদমস্তক গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা, স্বাধীনচেতা এ বি এম মূসা সাংবাদিকতার জগৎকে আজকের খরাকবলিত সময়ে এতিম করে গেছেন। চীনা প্রবাদ, কোন কোন মৃত্যু পাখির পালকের মতো হালকা, কোন কোন মৃত্যু থাই পাহাড়ের সমান ভারি।
মূসা ভাইয়ের মৃত্যু আমাদের কাছে সেই থাই পাহাড়ের মতো ভারিই মনে হয়। মূসা ভাই আপনাকে অভিবাদন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আপনার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দিন। কোনো দিন কোনো কষ্ট দিয়ে থাকলে, ক্ষমা করে দিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।