আজ মহান স্বাধীনতা দিবস। আজ থেকে ৪৩ বছর আগে এই দিনে বাংলা নামক দেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের পথে জয়যাত্রা শুরু হয়। ২৫ মার্চ কালো রাতে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অসহায়- অপ্রস্তুুত -নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন তাদের কাছে চাওয়া ছিল কেবল ”বাংলার সোনার মাটি” – মানুষ নয়। তাই পাকি বাহিনী কেবল মানুষ মারতে চেয়েছিল আর বাংলার মানুষ এর তৈরী সকল রাস্তা – ঘাট – ব্রিজ – কালভার্ট ভেঙ্গে চূড়ে চূড়মার করে দিয়েছিল। সৃষ্টি যখন করতেই হয় নি ধ্বংস করতে তখন দ্বিধা কী ?
মূলত বাংলা’র স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন ব্রিটিশ আমল থেকেই শুরু হয়েছিল।
ব্রিটিশদের অন্যায়- অত্যাচার – অবিচার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এর আগুন এর সূত্রপাত বাঙ্গালীরাই ঘটিয়েছিল। তখন বাঙ্গালী যতটুকু জানতো কেবল ব্রিটিশদেরকে তাড়িয়ে দিতে পারলেই বোধহয় সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু জিন্নাহ – নেহেরুর কূটচালে জড়িয়ে পড়া বাঙ্গালী জানতো না যে কেবল একটি জাতি বা সম্প্রদায়কে শারীরিকভাবে সরালেই সব কিছু মুছে যায় না বা সরে যায় না। যে বীজ ব্রিটিশরা উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ভারতবর্ষে বপন করে গিয়েছিল তার মূল উৎপাটন করা এত সহজ কাজ নয়। কেবল বিদেশী পণ্য বর্জন বা কেবল ইংরাজী ভাষা ত্যাগের মাঝেই সব কিছু শেষ নয়।
তাইতো ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের সময় জানে জিগার দোস্ত জিন্নাহ – নেহেরু ব্রিটিশদের সহায়তায় এমন ভাবে ভারত বর্ষকে ভাগ করলো যেন আজীবন শত্রুতার ঘানি টানতে হয় বাঙ্গালীকে
(প্রসঙ্গত উল্লেখ্য অন্যান্য কয়েকটি জাতিকেও টানতে হচ্ছে কিন্তু সেই বিষয়ে আমি এখন যেতে চাই না)।
পাকিস্তান এর মতো একটি বর্বর- অসভ্য- উচ্ছৃঙ্খল – অশিক্ষিত জাতি যারা বাংলাদেশ এর থেকে ১৩৭২.১৭ মাইল দূরে ভৌগলিকভাবে অবস্থান করছে যাদের সাথে বাঙ্গালীর শিক্ষা – সাহিত্য – সংস্কৃতি কোনদিক থেকেই কোন প্রকার মিল নাই সেই বিজাতীয়দের সাথে জুড়ে দেয় ” সোনার বাংলাকে” ।
ফলে যা হবার তাই হয়। একটি সভ্য ও উর্বর সংস্কৃতিমনা দেশ বা জাতির সাথে কোন অবস্থাতেই একটি অসভ্য – আদিম- বর্বর – কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশ বা জাতির জাতিগত কোন মিলন হতে পারে না। পাকিস্তানও সেটি চায় নি যে বাঙ্গালীর সাথে মিলে মিশে থাকবে।
চেয়েছিল কেবল সোনার বাংলার খাটি মাটি। খোট্টাদের তো কিছুই ছিল না। ছিল কেবল উগ্রবাদিতা, নৃশংসতা আর ধন সম্পদের লোভ ( যার সর্বোৎকৃষ্ট প্রমান আজ অব্দি পাকিস্তান স্বয়ং নিজ দেশেই দিয়ে চলেছে)।
আর অতি অল্প সময়েই বলা যায় বাঙ্গালী বুঝে ফেলে জিন্নাহ- নেহেরু – ব্রিটিশদের কূটচাল। আর তাই ১৯৪৭ সাল এ দেশ ভাগের পরই থেকেই গুঞ্জন শুরু হয়ে যায় ”বাংলা” শব্দটিকে কেন্দ্র করে।
”বাঙ্গালি” জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বাঙ্গালীর চেতনার অগ্নি মশাল। আর সেই আগুন থেকেই ভূমিষ্ট হয় ১৯৭১ সালে ” বাংলা নামের সোনার দেশ টি” ।
লক্ষ প্রানের বিনিময়ে পাওয়া এই সোনার বাংলা কারো একক অবদান নয়। এর মালিক কেবল গুটিকয়েক ব্যাক্তি বা গোষ্ঠি বা দল নয়। সমাজের সর্ব নি¤œ শ্রেনী- পেশা- জাতি- ধর্ম- বর্ণ – লিঙ্গ – বয়সের মানুষ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আপামর জনগনের এক বিশাল আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এই ” সোনার বাংলা”।
যা বিশ্বের বিস্ময় !
কেবল একটি জাতি যারা দেশ মাতৃকার জন্যে অকাতরে মান-সম্মান-জীবন -যৌবন- ধন- দৌলত নির্ভিকভাবে বিলিয়ে দিয়েছে। বাংলা ভাষার জন্যে, বাংলাদেশের জন্যে নিজেকে উজার করে দিয়েছে।
”এমন দেশ টি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি” এই গান টি যেদিন লেখা হয়েছিল সেই দূরদর্শী গীতিকার- সুরকার এর মনের মাঝেও নিশ্চয়ই বাংলাদেশ নিয়ে এক সুন্দর স্বপ্ন লুকানো ছিল । যা তিনি আমাদের মতো চিৎকার করে বেসুরো ঝগড়া না করে নিভৃতে আমাদের জন্যই – বাংলাদেশের জন্যই- বাঙ্গালীর জন্যই রচনা করে গিয়েছিলেন। যা আমরা আজও গেয়ে চলি, ”ভায়ের – মায়ের এত ¯েœহ কোথায় গেলে পাবে কেহ ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি, আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি ।
” আহ , কী বাণী ! কী অমৃত সুধারসে ভরা সুর !
কিন্তু আফসোস !
আফসোস এই জন্যে যে, স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও আমরা পেলাম না একটি সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ! মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী সকল শহীদদের তালিকা ! পেলাম না প্রকৃত বীরাঙ্গানাদের তালিকা !
আজ ৪৩ বছর পর এই প্রশ্ন এই প্রজন্মের মনে আসা কী খুব অযৌক্তিক যে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রকৃত পক্ষে কতজন মানুষ জীবন দিয়েছিল? কত জন নারী মান সম্ভ্রম হারিয়েছিল ? কী পরিমান ধন- সম্পদ পাকিস্তানিরা এদেশ থেকে পাচার করেছিল ? বা আমাদের দেশের কী পরিমান সম্পদ পাকি হানাদার বাহিনীরা মহান মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংস করেছিল ?
কোনটাই অসম্ভব নয়। কারন পুরো বাংলাকে জ্বালিয়ে – পুড়িয়ে ছাড়খাড় করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আর বাংলাদেশের এমন কোন জেলা, থানা, গ্রাম নাই বা ছিল না যেখানকার মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি।
বর্তমানে নানা দেশ নানা ছলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ কে কলংকিত করার জন্যে, শহীদদের সংখ্যা প্রকাশের অপচেষ্টা করছে। তারা আরো একটি কূটচাল চেলে আমাদের বীরাঙ্গনাদের অপমানিত করার নানা প্রয়াশে লিপ্ত।
শুধু তাই নয় স্বাধীনতার ”নায়ক” ”ঘোষক” এই সব নানান বিষয়ে অবান্তর প্রশ্ন তুলে বাংলাদেশকে- বাঙ্গালী জাতিকে বিভক্ত করারও অপচেষ্টায় লিপ্ত।
কিন্তু এই সকল চাল ই বানচাল করে দেয়া সম্ভব কেবল আমাদের সদিচ্ছার উপর । বর্র্তমান গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসাবে এই সরকারের পক্ষেই সকল প্রকার অপপ্রচার ও কূটচাল মোকাবিলা করা সম্ভব। কারন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের অবদান ছিল (গুটি কয়েক পাকিস্তানি এজেন্ট ব্যতীত) । তাই সরকার যদি ”জাতি – ধর্ম- বর্ণ- লিঙ্গ -পেশা- বয়স” নির্বিশেষে বাংলাদেশের গ্রাম কে গ্রাম জরিপ শুরু কওে, ঘরে ঘরে জরিপের কাজ শুরু করে আমি বিশ্বাস করি বাংলার মানুষ এখোনো জাগ্রত সঠিক সংখ্যা জানাতে।
অনেক দেরী হয়ে গেলেও সব শেষ হয়ে যায় নি। এখোনো বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে কেউ না কেউ জেগে আছেন , বসে আছেন পথ চেয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সরকার এর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে জানাতে।
প্রয়োজন কেবল এখনই সরকারী উদ্যোগ গ্রহণের । কারন সেই মানুষ গুলিকে হারিয়ে ফেললে বা তাঁরা ইহোলোক ত্যাগ করলে আমরা সঠিকভাবে পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে আর কিছুই জানতে পারবো না। কেন আমাদের দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা নিয়ে, শহীদদের সংখ্যা নিয়ে, বীরাঙ্গানাদের মান সম্মান নিয়ে সেই ব্রিটিশরাই সংখ্যা প্রকাশ করবে ? ঠান্ডা দেশে রুম হিটার চালিয়ে কেবল কম্পিউটার এর বাটন টিপে তাদের করা এই পরিসংখ্যান কেন আমরা মেনে নিব ? অথবা কোন সাহসেই সেই বিদেশী / বিজাতীয়রাই আবার সেই পুরানো কূটচাল চালে?
তাদের এই সব ভিত্তিহীন গবেষণা সমূলে উৎপাটন করার এখনই সময়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল পরিসংখ্যান গত একটি বিষয়? এটি একটি ইতিহাস। ইতিহাসের একটি সর্বশ্রেষ্ঠ দলিল।
একটি প্রত্যাশিত সঠিক পরিসংখ্যান কেন আমরা সংগ্রহ করতে পারবো না ? কেন বিদেশী / বিজাতীয়রা বিভ্রান্তমূলক ” তত্ব ও তথ্য ” প্রকাশ করে আমাদেরকে আবারো দ্বিখন্ডিত করার চেষ্টা করবে ? কেন আমরা আমাদের পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে অক্ষম হবো ? আমরা কী পারদর্শী নই ? নাকি আমাদের সদিচ্ছার অভাব ? কোন টি ?
আমাদের ইতিহাস – দালিলিক ভাষায় এবং পরিসংখ্যানগত ভাবে আমাদেরকেই সঠিকভাবে আমাদের ভাষায় লেখা এখন বড়ই প্রয়োজন। আমাদের জন্য। আগামী দিনের বাংলাদেশের জন্য।
বিশ্বের জন্য। কোন বিদেশী নয় আমরাই জানবো এবং জানাবো বিশ্বকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস।
মহান স্বাধীনতা দিবসে এই হোক আমাদের ব্রত।
দিলরুবা সরমিন
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী
প্রধান সম্পাদক, প্রথম বার্তা ডটকম ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।