শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
সকাল বেলা হই হই শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। কয়েকটি কণ্ঠ গলগল করে কথা বলছে। ভাল করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করতেই পাশের ঘরের দরজা পেটানোর ঠাস ঠাস শব্দ কানে এলো। দরজা পেটানোর পরপরই কয়েকটি আধা মোটা কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আরো ভালো করে কান পেতে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করতেই কানে এলো, এই তোরা উঠ, দরজা খোল।
বিষয়টি অবলোকন করার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠার চেষ্টা করতেই আমার গিন্নি দেখি হন্তদ›ত হয়ে বাইরে থেকে ছুটে এসে ঘরের দরজা আটকিয়ে দিল। আমি গিন্নিকে জিজ্ঞেস করতেই গিন্নি মুখে আঙ্গুল তুলে ইশারায় আমার মুখ বন্ধ রাখতে বলল। আমিও গিন্নির ভীতু মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কোঁকড়া লেগে গেলাম।
বিছানা ছেড়ে ভয়ে ভয়ে তার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, কি হয়েছে?
গিন্নি ফিস্ ফিস্ করে আমার কানে কানে বলল, শাড়ি পইরা মহিলার মত কতগুলা মাস্তান ঢুকছে। সব ভারাইটা গো রুমের দরজা পিটাইতেছে।
না জানি সব মাইরা ধইরা ট্যাকা-পয়সা, মাল-সামানা নিয়া যায়। বলেই গিন্নি আমাকে টেনে খাটের কাছে এনে ঘাড় জাতা দিয়ে ইশারা ইঙ্গিতে বলল, তাড়াতাড়ি খাটের নিচে ছালা গায়ে দিয়ে পালাও।
আমিও বুঝতে না পেরে ছালা গায়ে দিয়ে খাটের নিচে ঢুকতে যাবো অমনি আমার ঘরের ধরজায় ঠাস ঠাস করে পিটানো শুরু হলো। ভয়ে হাত পা অবস হয়ে গেল। খাটের নিচে ঢুকতে গিয়ে খাটের বাইরেই পরে গেলাম।
গিন্নি আমাকে পড়ে যাওয়া অবস্থায় ছালা দিয়ে পেঁচিয়ে ধাক্কিয়ে খাটের তলায় ঢুকিয়ে দিল। আমার কলিজায় পানি নেই। মাস্তান যখন এসেছে টাকা পয়সা নিবে তো নিবে জানেও মেরে ফেলতে পারে। ভয়ে ছালাসহ কাঁপতে লাগলাম। একটু পরে আবার ঠাস্ ঠাস্ দরজা পিটানো শুরু হলো।
আমার অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। এমন সময় মোটা গলায় আওয়াজ হলো, এই দরজা খোল, নইলে কিন্তু দরজা ভাইঙ্গা ফালামু। বলেই আবার দরজা পিটানো শুরু করল। একজন আধা মহিলা কন্ঠে বলল, এই রুপভানের মাও, দরজা খোল। আমাগো দেইখা দরজা দিলি ক্যা? আমরা কি মানুষ না? আমাগো তোরা ঘিন্না কইরা দরজা দ্যাশ।
মনে করছা দরজা দিলেই আমরা চইলা যামু। তগো ঘর থিকা বাইর না করা পর্যন্ত এক পাও নরমু না।
দরজা পিটানো আর ওদের কথা শুনে আমার তখন হুশ হারা হওয়ার অবস্থা। গিন্নিও ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়েছে।
এমন সময় আমার এক ভাড়াটিয়া আমাকে ডাক দিয়ে বলল, ভাই দরজা খোলেন, এদের আগে বিদায় কইরা দেন।
নইলে কিন্তু ঘরের বাইরে বারাইতে পারবেন না।
আমি আমার ভারাইটা মইদুলের কথা শুনেও কোন উত্তর দিলাম না। কারণ মনে মনে ধারনা করে নিলাম, হয়তো মইদুলের মাথায় পিস্তুল ঠেকিয়ে আমার ঘরের কাছে এনে আমাদেরকে সহজেই দরজা খোলানোর জন্য ওকে দিয়ে কথাগুলো বলানো হচ্ছে। ভয়ে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম। আমার গিন্নিও দোয়া ইউনুস পাঠ করতেছে।
এমন সময় মোটা দরাজ গলায় বলে উঠল, এই মিয়া, বাড়িওয়ালা কোন ঘরে থাকে রে? হেই ঘর আগে দেহায়া দে, বাড়িওয়ালারে আগে সাইজ কইরা নেই, তার পরে অন্য ঘরে যামু।
মইদুল বলল, ওইটাই বাড়িওয়ালার ঘর।
এ কথা শোনার সাথে সাথে ঘরের দরজার কাছ থেকে একজন বলল, এই নছিমন, তোরা সবটি এইহানে আয়। আগে বড়িওয়ালারে সাইজ করি। তার পর ভারাইটাগো ধরমু।
এবার অনেকগুলো পায়ের শব্দ শোনা গেল। দরজায় জোরে জোরে থাপপর দিতে লাগল। পারলে দরজা ভেঙে ফেলে। আমি মনে মনে মইদুলের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে গালাগালি দিতে লাগলাম। কারণ মইদুল যদি ঘর দেখিয়ে না দিত তাহলে হয়তো ওরা এভাবে আমার ঘর এ্যাটাক করতো না।
এবার বাড়িওয়ালা হিসাবে আমার ঘরের জিনিষ পত্র তো নিবেই, সাথে আমাকেও হয়তো মেরে ফেলবে।
মোটা গলায় আবার বলল, ওই বাড়িওয়ালা দরজা খোল, নইলে এমন কাম কইরা যামু সারা জীবন আমাগো কথা মনে করবি। মনে মনে ভাবলাম, হয়তো আমাকে পেলেই ওরা পিটিয়ে হাড়গোড় ভেঙে আধামরা করে যাবে। যা সারা জীবন মনে করতে হবে।
আবার ঠাস্ ঠাস্ করে দরজায় পিটাতে লাগল।
জোরে পিটানোর পরও যখন দরজা খুলছি না তখন একজন আরেকজনকে নাম ধরে ডাকছে, এই নছিমন, বাড়িওয়ালা যহন দরজা খুলবো না তহন দরজার ফাঁক দিয়া ঘরের মইধ্যে মুইতা দে।
একথা বলার পরপর মইদুল বলে উঠল, ভাই দরজা খোলেন, ওরা ঘরের দরজায় মুইতা দিল তো! মইদুলের কথা শেষ হতে না হতেই ঘরের দরজায় চ্যার চ্যার শব্দ হতে লাগল। ছালার ফাঁক দিয়ে আধা অন্ধকারে তাকিয়ে দেখি, ঘরের ভিতর পাকা,মেঝের উপর দিয়ে পানি গড়িয়ে আসছে। এরপরেও দরজা খুলতে সাহস হলো না। মনে মনে ভাবলাম মুতে মুতুক, তবু ঘরের দরজা খোলা যাবে না।
দরজা খুললেই ডাকাতি করবে, জানে মারবে।
মইদুল আবার ডেকে উঠল, ভাই তাড়াতাড়ি দরজা খোলেন, নইলে আরেকটা কাপড় তুলছে, হেডাও মুতবো। সবটি মুতলে কিন্তু ঘরে থাকতে পারবেন না। ঘর ভাইসা যাইবো।
মইদুলের কথা শুনে মনে মনে ভাবলাম, মুতে ঘর ভাসে ভাসুক, তবু ওদের হাতে মাইর খাওয়া যাবে না।
এবার একজন মোটা গলায় বলল, হারামজাদা বাড়িওয়ালা এতো খারাপ, এক পোয়া চাইল দেয়ার ডরে দরজাই খোলে না। এরকম কৃপণ বাড়িওয়ালা তো জীবনে দেহি নাই। ঘরে মুইতা দিলাম তাও ঘর খোলে না। এই এককাজ কর। হারামজাদা বাড়িওয়ালার চাইল নিমু না।
সবটি মিলা ঘর ভইরা মুইতা দে। তহন বুঝবো হিজড়া গো ঠকাইলে কেমুন মজা।
হিজড়া শব্দ কানে আসতেই হুশ হলো। গায়ে থেকে ছালা ফেলে দিয়ে চট করে খাটের নিচ থেকে বেড়িয়ে এসে গিন্নিকে বললাম, এই দরজা খুলে দাও।
গিন্নি ভয়ে চোখ বন্ধ করে আল্লাহ আল্লাহ করতেছিল।
দরজা খুলতে বললেও শুনতে পেল না। ভয়ে মনে হয় কান বন্ধ হয়ে গেছে। দুই তিন বার ডাক দিয়েও যখন চোখ খুলছে না তখন গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিতেই ভয়ে ‘আউ আউ’ করে উঠল।
আমি ধমক দিয়ে বললাম, আরে পাগোল দরজা খোল।
বউ কাঁপতে কাঁপতে বলল, দরজা খুললে যদি ওরা মারে।
আমি বললাম, না মারবে না, ওরা হিজড়া, চালের জন্য এসেছে।
আমাদের কথা শুনে এক হিজড়া বলল, এই বাড়িওয়ালা, তোরা কি কথা কস?
আমি বললাম, তোদের চাইল দেয়ার কথা বলতেছি?
হিজড়া বলল, চাইল লাগবো না। তরে একনজর দেইখা যাই।
গিন্নি দরজা না খোলায় আমি নিজেই দরজা খুললাম। দরজা খুলতেই হইহই রইরই করে এসে ওরা আমাকে জড়িয়ে ধরল।
পাঁচ জনের চিপায় পরে দম বন্ধ হয়ে মরার অবস্থা। আমাকে জড়িয়ে ধরা দেখে গিন্নি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মইদুল আমাকে জড়িয়ে ধরা আর গিন্নির কান্না দেখে হা হা করে হেসে উঠল। আমি খুব বিব্রত অবস্থায় পরে গেলাম।
আমি ওদের উদ্দেশ্য করে বললাম, এই তোরা হুড়াহুড়ি করবি না চাল নিবি?
মোটা কণ্ঠওয়ালা হিজড়া বলল, আইজ আর চাইল নিমু না, তুই কেমন বাড়িওয়ালা, ঘরের দরজা বন্ধ কইরা হুইয়া থাকোস, আমাগোরে পাত্তা দিবার চাস না, তাই তরে একটু সাইজ কইরা লই।
আমি বললাম, আমারে ধইরা রাখলে কি চাল পাবি, আমারে ছাইড়া দে চাইল নিয়া যা।
আধা বয়েসি এক হিজড়া বলল, আমাগো এতক্ষণ ভোগাইছস, এহন আর এক পোয়া চাইল নিমু না। এক কেজি চাইল দিবি আরও একশ’ ট্যাকা দিবি।
আমি বললাম, ঠিক আছে তাই দিতেছি, বলেই গিন্নিকে বললাম, তাড়াতাড়ি এক কেজি চাইল আর একশত টাকা দিয়ে দাও। গিন্নি একশত টাকা বের করতে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে পাঁচশত টাকার নোট বের করে আনলে হিজড়ারা থাপা দিয়ে গিন্নির কাছ থেকে টাকা নিয়েই দৌড়।
গিন্নি আর কিছু বলার সুযোগই পেল না।
আমি গিন্নির দিকে বড় বড় চোখ করে বললাম, ওরা চাইল একশত টাকা আর তুমি পাঁচ শ’ টাকা দিয়ে দিলে।
গিন্নি তখনও কাঁপতে ছিল, ধরা গলায় বলল, ওদের মাইর খাওয়ার ভয়ে আমি পাঁচ শ’ টাকা দেই নাই, ওরা যদি আবার আপনারে চ্যাঙদোলা কইরা নিয়া যায়, হেই ভয়ে দিয়া দিছি।
আমি গিন্নির ভয়ের কারণ শুনে আর কোন কথা বললাম না। মইদুল বলে উঠল, ভাই, ভাবী ঠিকই কইছে, ওরা যদি ঘারে কইরা আপনারে নিয়া যাইতো তহন পাঁচ হাজার টাকা দিয়াও ফিরায়া আনা যাইত না।
কাজেই পাঁচ শ’ টাকা গ্যাছে যাক হিজড়া তো বিদায় হইছে।
গিন্নি আর মইদুলের যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।