লিলিপুটরা বড়ো হবে। এই আশায় দলা পাকানো কাগজ খুলে আবার ব্যবচ্ছেদকরণে বিশ্বাসী আমি। যদিও কাগুজে বৃত্তান্ত যা বলে অতটা খারাপ আমি নই। ওই বারান্দাটার কথা বলছি যেখানে দিনের বেলা সূর্যের আলো পড়ে মেঝে গরম হয়ে যায়, কিন্তু বিকেল থাকে ঠান্ডা। আর রাতের বেলা সোডিয়াম বাতির উৎপাতে দু’দ- শান্তি মেলে না।
ওই বারান্দাতেই ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরার ইচ্ছে বাস্তবায়নের পুরো পরিকল্পনা করেছিল।
যথারীতি পারেনি। চতুর্থবারের মতো।
যাচ্চলে। লেখাটা রোমান্টিক গল্পের দিকে যাচ্ছে।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, ছেলেটার মধ্যে রোমান্টিকতার ছিটেফোঁটাও নেই।
রেস্টুরেন্টে গিয়ে টেবিল পরিষ্কারের তোড়জোর করত, কিন্তু গলার স্বরে আধিপত্যের লেশ দেখা যেত না। ক্লাসে শেষ বেঞ্চে বসে সুন্দরী সহপাঠীর দিকে ট্যারা চোখে তাকাত না, বাসে জানালার ধারের সিট মোটেও পছন্দের ছিল না। একটু বৃষ্টি হলে ছাউনির খোঁজে অস্থির হয়ে পড়ত, ভেজা ঘাস তার অসহ্য। ডাক শুনে পাখির নাম বলতে পারত না, ফুলের গন্ধ চেনা ছিল অসম্ভব।
এহেন এক নীরস বান্দাও শেষমেশ প্রেমে পড়ল। তবে একা একা পড়েনি। তার মানে আবার দুই তিনজন মিলে একজনের ওপরও পড়ে নাই। মেয়েটা ঠিক জিরো ফিগার না হলেও তিনজনের ভার নেয়ার মত সমর্থ নয়।
আপদ! রোমান্টিকতা কাটাতে গিয়ে এইবার অ্যাডাল্টিসিটির উপদ্রব।
তার চে সোজাসাপ্টা ভাষাই ভাল।
তো হল কি? ছেলেটা নাওয়া-খাওয়া ভুলল না। তবু সুর কাটাকাটিতে পেপার-রক-সিজরও ফেইল। আমরা ধরে নিলাম অগ্যস্ত যাত্রা অবশ্যম্ভাবী। এমন সময় ঘটল দুর্ঘটনা।
মুশকিল! এইভাবে ছেলেটা ছেলেটা না করে তার একটা নাম দেয়া দরকার। ধরলাম তার নাম ক্যামেরা। ক্যামেরার শাটার না টিপলে ফ্লাশ হয় না, আর তার দু চোখের বিষ টয়লেটে যেয়ে ফ্লাশ না করে আসা লোকজন। জনাব ক্যামেরার পাস্ট হিস্টরি এডিটিং বিহীন ছবির মতই ম্যাড়ম্যাড়ে। একদা জনাব ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে (যা সচরাচর ব্যবহার হত কেবল পাঠ্যবইয়ের কিলবিলে কালো নকশাগুলোর ভাব উদঘাটনে) জনৈকা প্রফাইল পিকচার সর্বস্বা ধরা পড়লেন।
আর তিনি এমনি ফোকাসড হলেন যে তার পাশের ষন্ডামার্কা বয়ফ্রেন্ড মাত্রাতিরিক্ত ব্লার হয়ে রইলেন। আমরা জানতে পারিনি ক্যামেরার দৃষ্টিতে কী এমন পাপ প্রকাশ পাচ্ছিল। শুধু জানলাম ভিউ ফাইন্ডার পুনরায় কর্মক্ষম হতে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক সময় নিয়েছিল।
নাহ্ এমন আপাত নিরস ব্যক্তির নাম ক্যামেরা হতে পারে না। তার নাম হোক ফেরদৌস।
আর যার হাত সে ধরতে চেয়েছিল তার নাম শান্তা। খুবই আটপৌরে নাম দুজনের। রোমান্টিক গল্পের মতো নাম নয়। না হোক, তবু ওই মেয়ের মাঝে এমন কিছু ছিল যার জন্য ফেরদৌসের মত ছেলে হাত ধরতে রাজি হয়েছিল। আর শান্তাও যে সে নয়।
তার আজন্ম সাধ (পড়ুন আবিশ্ববিদ্যালয় জীবন) এমন ছেলে খুঁজে বের করা যার হাত একবার ধরলে সারাজীবন সে হাত ধরেই কাটিয়ে দেয়া। লাইব্রেরিতে পড়া শেষে বই গোছানোর সময় তার মনে হয়, ‘আহা যদি এমন কেউ থাকত যে বই গোছানোর সময়টা পাশে থেকে বইগুলো নিজেরগুলোর সাথে তুলে নিতো। টুকটাক পড়ার খোঁজ নিতে নিতে লাইব্রেরির সিড়ি বেয়ে নামতে থাকতো আর লাইব্রেরির পাশ রাস্তা দিয়ে যেয়ে টং দোকানের চা বিস্কিটে ক্লান্তি মেটাতো। টিভি সিরিয়ালে যেমনটা দেখায় তার বেশিরভাগই বাড়াবাড়ি। তেমন নাটুকে না হলেও চলবে।
আবার ওই নাটক বাস্তবে দেখলে মেনে নিতেও কষ্ট হবে। তবু দিনমান হাজার কাজের ভিড়ে ওই এক জোড়া হাত প্রায় প্রায়ই টোকা দিয়ে যায়। এক জোড়া হাত আর মেলে না।
বিকেলটা আর দশটা বিকেলের মতোই তো ছিল। আহামরি কিছু না।
শান্তাকেও কনে দেখা আলো না কি ছাই তাতে অন্যরকম কিছু তো লাগছিল না। তারপরেও ফেরদৌস হাত ধরতে চাইল। মুখে বলেছিল কি? নাহ্। ক্লাসে শিক্ষকের সাথে নানান থিওরি নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক চালাতে পারে। মুখ ফুটে বলার দুঃসাহস সে দেখাতে পারেনা।
কিন্তু নিছক এক হাত ধরার ঘটনা বাস্তবে রূপ দিতে ঈশ্বর নিমরাজি কেন ছিলেন? আর শান্তাই বা কেন নিজে যেচে হাত বাড়ালো না? হাতের ওপর হাত পড়লে কি বা এমন যায় আসে আজকাল? এত অহম নিয়ে বরং বাসায় একা ঘুমানো ভাল ।
শেষমেশ কিছুই হল না। বেহুদা প্যাঁচাল, এদিক সেদিক নানান ইঙ্গিত নিয়ে নিরস বিকেল ততোধিক নিরসভাবেই ফুরলো। সন্ধ্যা নামল। আর ছেলেটা অন্ধকার সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে কিসের সাথে হোঁচট খেয়ে পা হড়কে পড়ে হাঁটু ছিলল।
পাড়ার ফার্মেসি থেকে এক সপ্তাহর ওষুধ কিনে ছেলেটা যখন খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরছিল তখনই একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন। ধরবে না ভেবেও পরে রিসিভ করে হ্যালো বলল সে। বুক তখন ক্রমাগত ঢিবঢিব, খুব করে মন চাইছিল এটা যেন শান্তাই হয়। চারবারের চেষ্টাতেও একটু হাত ধরার আশা যখন ঈশ্বর পূরণ করেনি এইটাও করার দায় তার থাকে না এমনিতেই। তাই সেটা শান্তার ফোন ছিল না।
ওই ফোনের পর ফেরদৌস কোথায় হারিয়ে গেল আমরা কেউ জানি না। তার ইউনিভারসিটির শিক্ষক, হলের রুমমেট, জনাকয়েক বন্ধু যাদের সেলফোনে অন্তত ফেরদৌসের নম্বরটা ছিল, কেউ জানল না, জানতে পারলও না ফেরদৌসের কী হয়েছিল। আমরা যারা দূর থেকে ফেরদৌসের আঁতেলিপনা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতাম তারা বিষয়টা আরো গা করলাম না। থাকলেই দুনিয়ার কি যেতো আসতো। ও হ্যাঁ।
আমরাই কিন্তু ফেরদৌসের ওপর শান্তাকে লেলিয়ে দিয়েছিলাম।
পুনশ্চ: যা হওয়ার তাই হয়েছে। শান্তা সম্প্রতি এক মেরিন ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করেছে। যে হাতের প্রতীক্ষায় সে ছিল সেই হাতের দেখা মেলে ছয় মাস, এক বছর পর। আর তখন ওই হাতের পরশ শান্তার হাতের ওপর পড়ে না বললেই চলে।
তার চেয়ে অন্যান্য নাজুক অঙ্গের ওপরই টান বেশি। সে যাকগে, শান্তার নাকি ফেরদৌসকে নাচিয়ে মজা লাগতো। শান্তার ঘনিষ্ট বান্ধবীর জবানিতে প্রাপ্ত খবর। ক্রস চেকের ঝামেলায় কেউ যায়নি।
সব শালা হিপোক্র্যাট!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।