সত্য ও সুন্দরের পথের অভিযাত্রী আমি, কিছুতেই যেন এ যাত্রা শেষ না হয়... ছোট বেলায় মনে হত, দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে আমাকে আম্মু-আব্বু, ভাই-বোনের সাথে থাকতে হবে না। আমি একাই থাকব সেখানে। কখনও মনে হত আমার নিজের টাকা থাকলে একটা বাসা ভাড়া করে থাকতাম, নিজের ইচ্ছা মত ঘর সাজাতাম। আবার মনে হত কবে যে বড় হব? বড় হলেও তো পড়ালেখার জন্য হোস্টেল এ থাকতে পারব, আমাকে আর কেউ জ্বালাতন করবে না, কেউ বলবে না পড়তে বস, খাচ্ছিস না কেন? খেয়ে নে।
না খাইতে চাইলেও আম্মু জোর করে খাওয়াতে পারবে না... কার্টুন দেখতে বারণ করবে না কেউ, খেলতে খেলতে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরলেও কেউ বকবে না, একা একা অনেক শান্তিতে থাকব, সারাদিন একা একা কার্টুন দেখব, চিপস, চকলেট, নুডুলস, আইস্ক্রিম, আরও কত কি সব একাই খাবো। কারো সাথে ভাগ করে খেতে হবে না। আহা কি সুন্দর আমার কল্পনা !!!!!
২০১১ এর জানুয়ারী তে আমার ইচ্ছা পূরণ হল। আমি হোস্টেলে চলে এলাম। সেখানে সত্যি আমি খেয়েছি কিনা, পড়ছি কিনা ঠিকমত, এত বেলা করে ঘুমচ্ছি কেন? কেউ দেখছে না।
আমার তো মহা খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমার অনেক খারাপ লাগা শুরু করল, কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলতাম। যারা আমাকে এত জ্বালাতন করত তাদের খুব বেশি মিস করতে লাগলাম। এখানকার খাবার গুলো আমার পছন্দের ছিল না মোটেও। কি আশ্চর্য যাদের যন্ত্রণায় আমি অতিষ্ঠ তারা আমার এত খেয়াল রাখত।
তিন বেলায় আমার পছন্দের খাবার আলাদা করে রান্না করত আমার মা। অথচ আমি খাবার নিয়ে কত জ্বালিয়েছি মাকে। এই শীতে ঘুম থেকে উঠে যখন হাত-মুখ ধুতে যেতাম ঠাণ্ডা পানি দেখে ভীষণ কষ্ট লাগতো। কেউ পানি গরম করে দিচ্ছে না। আগে আম্মু প্রতিদিন সকালে পানি গরম করে দিত, আর এখন হয় নিজে গরম করে নাও নাহয় ঠাণ্ডা পানি দিয়ে কাজ কর।
নিজে নিজে কাপড় পরিষ্কার কর, ঘর গোছাও, সব নিজে কর। এসবে আমি মোটেও অভ্যস্থ না, এসব দেখে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হত।
এভাবে তিনমাস হোস্টেল এ থাকার পর একটা ছোট ফ্ল্যাটে আমি আর আমার ভাইয়া উঠলাম। আমার আরেকটা ইচ্ছাও পূরণ হল, নিজের ইচ্ছা মত ঘর সাজানো তো দুরের কথা ঘরের প্রয়োজনীয় কাজই করি না ঠিকমত। ভাইয়া বার বার বলার পর করি।
সারাদিন একাই থাকি, কার্টুন দেখলেও চিপস, চকলেট, নুডুলস, আইস্ক্রিম আর খাওয়া হয় না। অলসতার জন্য বাইরে গিয়ে ওগুলো আনতেও কষ্ট লাগে, ভাইয়া আনলে তারপর যদি খাই, আর নুডুলস রান্না করা লাগবে দেখে খাই না। ঘুম থেকে ওঠার পর আম্মুর হাতের চা অনেক মিস করি, নিজে নিজে বানিয়ে খেতে হয়। ঠাণ্ডা পানি ধরার পর আমার হাত লাল হয়ে ফুলে গিয়ে ব্যথা করে, আম্মু পাশে থাকলে হাত মালিশ করে গরম করে দেয়, আর পানি ধরতে বারণ করে। যেই আমি প্রতিটি কাজের জন্য মায়ের উপর নির্ভরশীল, সেই আমার কি অদ্ভুত ইচ্ছা ছিল ছোটবেলায়।
চোখ খুলেই মোবাইল হাতে নিয়ে যার সাথে কথা না বললে আমার দিনই শুরু হয় না, যে আমাকে ফোনে খেতে বললে তারপর খাই, তাকে ছেড়ে থাকতে আসলেই অনেক খারাপ লাগে। আজ আসলেই অনেক অনেক মনে পড়ছে আম্মুর কথা। বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, তোমাকে ছাড়া আমি যে বড় অসহায়।
আমি আসলে এই মহিলাটাকে এখনও চিনতে পারলাম না, বুঝতেই পারলাম না সে এত ভাল কেন, সেই ভোরে উঠে শুরু করে সবার ফরমায়েশ পূরণ করা, একটুও বিরক্তি বা সংকোচ করে না। সবার ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা, ভিন্ন ভিন্ন আবদার সবি হাসি মুখে করে আসছে।
অথচ নিজের প্রতি তার কোন খেয়ালি নেই, সারাদিনে ঠিকমত খাওয়াদাওয়াও করে না। আসলেই পচা একটা মহিলা। আমি কোন কাজই ঠিক মত করতে পারি না। আর এই মহিলা কিনা ক্লান্তিহীন ভাবে এতকাজ করে আসছে এতগুল বছর ধরে। কি করে পারে সে? আমি ভাবলেই অবাক হয়ে যাই।
সে এত ভালবাসে কেমন করে আমাদের? এই ভালবাসা প্রতিদিন বেড়েই চলে, কমে না কখনও। আজ তাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে কেন যেন।
আমি জানি আমি যদি সারাজীবন চেষ্টাও করি তবুও তার মত হতে পারব না, তার মত যে কেউ হতে পারবে না, কেউ হতে পারে না। দুনিয়াতে সে একাই এমন। তার মত যে কেউ নেই।
তার তুলনা সে নিজেই। আর এই মানুষটাকেই আমি যে সবচাইতে বেশি ভালবাসি। কিন্তু কখনও বলা হয় না, মা তোমাকে অনেক ভালবাসি। কিছু ভালবাসা বলে প্রকাশ করা লাগে না, না বলার মাঝেও অসীম ভালবাসা নিহিত থাকে।
পৃথিবীর সকল মায়ের জন্য থাকল আমার অনেক অনেক শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।
আমি জানি এক-দু কলম লেখার মাধ্যমে কখনই একজন মায়ের অবদান কে ফুটিয়ে তোলা যায় না, তা সম্ভবও না।
একজন মা যেমন চান তার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে, তেমনিও আমাদের সব সন্তানের চাওয়া আমার মা যেন থাকে হাসি-খুসি, দুনিয়ার কোন কষ্ট যেন আমার মাকে স্পর্শ না করে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।