নিঃসঙ্গ এক ইলেকট্রনের কথন আমার জীবনটা বড়ই অদ্ভুত ধরনের। কষ্ট কাকে বলে তা যেন আমি ছোটবেলা থেকেই বুঝতাম। শুনেছি বাবা নাকি আমার জন্মের আগে মারা গেছেন। আর মা!সবাই যেদিন প্রথম পাঠশালায় যায় সেদিন তাদের কত আনন্দ!আর আমার বেলায়!আমাকে হারাতে হয়েছিল আমার মাকে। মৃত্যু কাকে বলে তখন বুঝার মত বয়সই হয় নি।
দেখলাম একটা সাদা কাপড় দিয়ে আমার মাকে ঢেকে রাখা হয়েছে। মনে করেছিলাম মা ঘুমিয়ে আছে। মা মা বলে কত ডাকছি মা শ
ুনছেই না। অন্য সময় একবার মা ডাক দিলেই মা কোথা থেকে যেন ছুটে এসে আমাকে কোলে তুলে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতেন। আজ সেই মা কোন সাড়াই দিচ্ছে না।
"মা,ও মা,তুমি কি রাগ করেছ আমার সাথে। আমি আর কক্ষনো দুষ্টামি করব না। মা ও মা কথা বল না"। কিন্তু মা আমার সে ডাকে সাড়াই দিচ্ছে না। "চাচ্চু মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তারা?"চাচা আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন।
চাচা কেন কাঁদছেন তা বুঝার মত কতই বা বয়স হয়েছে আমার!
এরপর চাচা আমার দেখাশুনার ভার নিলেন। মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে মা মা বলে চিত্কার করে উঠতাম। চাচা আমার চিত্কার শুনে দৌঁড়ে আসতেন। চাচ্চু মা কোথায়?আমি মা'র কাছে যাব। কোথায় মা?চাচা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলতেন।
বুঝতাম না আমি মা'র কথা বললেই চাচা কেন কাঁদতেন। কেউ একজন বলেছিল আমার মা নাকি কোনদিন আমার ডাকে সাড়া দিবে না। আমার মা নাকি বেঁচে নেই। যে একবার মারা যায় সে নাকি আর ফিরে আসে না। কষ্ট কাকে বলে তা যেন ধীরে ধীরে বুঝতে লাগলাম।
তখন থেকেই আমি আমাকে নিজের মাঝেই গুটিয়ে ফেলি। অনেকটা চাপা স্বভাবের হয়ে যাই। কারো সাথে তেমন মিশতামও না। আসলে কেউ মিশত না। কেউ কথাও বলতে আসত না।
যারা আসত তারাও নিরাশ হয়ে ফিরে যেত। মানুষের সাথে কথাই বলতে পারতাম না। চালচলনও ছিল সাধারণ। অনেকটা খ্যাত টাইপের আরকি!কিছুটা বলদ বলদ টাইপের ছিলাম। বন্ধুত্বের জগত্ বলতে কিছু ছিল না।
এতিম ছিলাম বলে সবাই কেমন যেন একটা বাঁকা চোখে দেখত। তাদের ভাষায় অলুক্ষণে ছিলাম আমি। তাদের বাবা মাও মনে হয় আমার সাথে মিশতে মানা করত।
ক্লাসের একটা ভালো ছাত্র ছিল। কেমন আছ,পড়ালেখা কেমন করছ এরকম হাল্কা কথা হত তার সাথে।
ক্লাসের অন্যান্য ভালো ছাত্রদের মত সে অহংকারী ছিল না। আমাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করত। বন্ধুত্ব কাকে বলে তা জেনেছি ওর কাছ থেকেই। আমার মত খ্যাত,অলুক্ষণে টাইপের একটা ছেলের সাথে মিশার কারণে ক্লাসের অন্যান্যরা তাকে নানারকম কথা বলত। সে এসবে পাত্তা দিত না।
ধীরে ধীরে তার আমার মধ্যে দারুণ সখ্যতা গড়ে ওঠে। আমরা দুজনই নিজেদের কথা শেয়ার করতাম। জানতে পেরেছিলাম তার নাকি বাবা বেঁচে নেই। এতিমের কষ্ট তো এতিমই বুঝবে!
এভাবে প্রাইমারি শেষ করে হাইস্কুলে উঠি। তার সাথে আমার দারুণ প্রতিযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
প্রতিযোগিতা কাকে বলে আমি মূলত ওর কাছ থেকেই শিখেছিলাম। সব কিছুতেই আমাদের মধ্যে দারুণ প্রতিযোতিতা হত। কোন প্রাইজ পেলে আমার ইচ্ছা হত মাকে নিয়ে তা দেখাই। কিন্তু মা যে আজ অনেক দূরে। আমরা হয়ে গিয়েছিলাম একেবারে আপন সহোদরের মত।
মনে হত দুটি দেহে এক প্রাণ। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতাম। একবার রক্তের গ্রুপ নিয়ে কথা বলছিলাম। কথায় কথায় জানলাম তার আর আমার রক্তের গ্রুপ একই। "ভালোই হল কোনদিন যদি তোর রক্ত লাগে তাহলে আমি দিতে পারব।
"
একদিন আমার বন্ধু আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেল। তার মা আমাকে খুবই আদর করতেন। তাকে দেখলেই বা তার কথা মনে পড়লেই আমার নিজের মা'র কথা মনে হত। আমার মা যদি বেঁচে থাকত তাহলে আমাকে এভাবে কত আদর করত!মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠতাম। রাতে মা'র কথা মনে হলে আর ঘুমাতে পারতাম না।
বাড়ির উঠানে যেয়ে বসে থাকতাম আর আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হত মা আমাকে ঐ দূর আকাশ থেকে দেখছেন। চাচা আমাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করতেন।
৮ম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়ে আমি অন্যান্যদের মত হাসতে পারি নি। আজ যদি আমার মা বেঁচে থাকতেন তাহলে তার হাসিতে আমিও হাসতাম।
আজ যখন তিনি নেই তখন আমার কাছে সে নিস্ফল হাসির কোন মূল্যও নেই। মাঝে মাঝে আনমনে বলতাম আল্রাহ তুমি এত নিষ্ঠুর কেন?আমার বাবা মাকে কেন তুমি নিয়ে গেলে?আমার বন্ধুটি আমাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করত। অনেক সময় সান্তনা দিতে গিয়ে সে নিজেও কেঁদে ফেলত।
কষ্ট যেন আমার জীবনের সাথে আঠার মত লেগে ছিল। নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় আমার চাচা মারা যান।
কষ্টের লাভা যেন আমাকে আরেকবার জ্বালিয়ে দিল।
পিতৃ-মাতৃহীন হয়ে চাচার কাছে যে ভালোবাসা পেয়েছি তাতে মনে হত আমার বাবা-মা বেঁচে থাকলে আমাকে হয়ত এরকমই ভালোবাসত। আজ সেই চাচা আমাকে আরও একবার শূন্যতার অগ্নিদহনে ফেলে চলে গেলেন। সৃষ্টিকর্তাকে বড় নিষ্ঠুর মনে হত। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম আমার নিয়তিতে যা আছে তাই ঘটছে।
সৃষ্টিকর্তা আমাকে তার এই পৃথিবী নামক পরীক্ষা হলে পরীক্ষা নিচ্ছেন।
চাচা চলে যাওয়ার পর মামা আমার দেখাশুনা করতে থাকেন। কিন্তু মামী আমাকে সাদরে গ্রহণ করেন নি। তাদের পরিবারে আমি যেন ছিলাম এক উটকো আপদ। মামাতো ভাই বোনরাও আমাকে একটা বাকা চোখে দেখত।
মাঝে মাঝে তারা কথা বলতে আসত। কিন্তু তাদের কথা শুনলেই ঠিকই বুঝে যেতাম তারা আমাকে করুণা দেখাতে কথা বলে। নিজেকে আরও গুটিয়ে ফেলি। মামার পরিবারের সাথে একসাথে বসে কখনো কিছুই করা হত না। অলুক্ষণে ভাবতেন মনে হয়।
খাওয়ার সময় একসাথে খাওয়ার জন্য ডাকা হত না। আমাকে তারা তাদের খাওয়ার পরে একটা প্লেটে ভাত আর বাটিতে সামান্য কিছু তরকারী দেওয়া হত। ঘুমাতাম বারান্দায়। মামা মামীকে এইসব বিষয় নিয়ে নানা রকম কথা বলত। পরে আমি মামাকে বলেছি কেন আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করে।
বাবা-মা নেই,কোন আশ্রয় নেই সেখানে আমি যে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছি এটাই বেশি নয় কি!মামা কোন কথা বলতে পারেন নি।
এস এস সি পরীক্ষায় আমি যে রেজাল্ট পেয়েছিলাম তা শতগুণে ভালো ছিল। আমার বন্ধুটিও আমায় মত রেজাল্ট পায়। দেখেছিলাম বন্ধুটি যখন রেজাল্ট নিয়ে তার মা'র কাছে যায় তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। ঐ দৃশ্য দেখে আমার মনের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে।
আজ যদি আমার মা বেঁচে থাকতেন তাহলে মনে হয় আমাকেও মা এভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁদতন। মা ও মা তুমি কি দেখতে পাচ্ছ আমাকে?তোমার ছেলে আজ কত ভালো রেজাল্ট করেছে তা কি দেখছ?মা ও মা!
রেজাল্ট এর পর আমি চাইছিলাম না যে মামার পরিবারে বোঝা হিসেবে থাকি। মামাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে মেসে থাকা শুরু করি। মামা সামান্য কিছু টাকা পাঠাতেন। তাই দিয়ে কোনরকম চলতাম।
মামী নাকি এই টাকা দেয়া নিয়েও অনেক কথা বলতেন।
একটা মেট্টিক পাস ছেলেকে কি কেউ কখনো টিউটর হিসেবে রাখবে?অনেক কষ্টে একটা টিউশনি ঠিক করি। অবশ্য টিউশনিটা ঠিক করে দিয়েছিল আমার এক বন্ধু। তার মামাতো বোনকে পড়াতে হবে। যেদিন তাদের বাসায় যাই আমি কেমন যেন একটা সংকোচ বোধ করছিলাম।
এত শান-শওকত!কত বড়লোকরে বাবা!নিশ্চয় খুব অহংকারী হবে। বন্ধুরা বলত বড়লোকরা নাকি অহংকারী হয়। কিন্তু আমার সেই ভুল ভেঙ্গে যায়। তাদের আচার আচরণ ছিল অমায়য়িক। আংকেল আমাকে আমার ব্যাপারে কিছু জিঙ্গেস করলেন।
আমি উত্তর দিলাম। যাকে পড়ানো হবে তার সাথে পরিচিত হলাম। পরদিন থেকে তারা আমাকে পড়াতে বললেন।
টিউশনিটা ঠিক হওযার পর আমি মামাকে টাকা পাঠাতে মানে করেছিলাম। মামা তাও পাঠাত।
পরে বাধ্য হয়ে বলেছিলাম মামা আগে যা পাঠাতেন তার অর্ধেক পাঠালেই চলবে। মামা আমার কথা মেনে নিয়েছিলেন।
আংকেল আন্টি আমার অনেক খোঁজ খবর রাখতেন। বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতেন। হয়ত বা বুঝেছিলেন পিতৃ মাতৃহীন একটা ছেলের কষ্ট।
যেদিন আমি প্রথম টিউশনির টাকা পাই সেদিন আচমকাই আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে। আজ মা বেঁচে থাকলে তিনি যে কত খুশি হতেন। আমার ছাত্রী আমার চোখে পানি দেখে বলে ভাইয়া আপনি কাঁদছেন কেন?মায়েয় কথা মনে পড়ছে বুঝি?ওর কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে আরো জোরে অশ্রু বের হতে লাগল।
একদিন খবর পেলাম আমার সেই বাল্যকালের বন্ধুটি নাকি একসিডেন্ট করেছে। এক মুহুর্তও দেরি করি নি।
ছুটে গিয়েছিলাম তাকে দেখতে। আমাকে দেখে ওর মা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। জানতে পারলাম ওর নাকি প্রচুর রক্তের প্রয়োজন। কিছুক্ষণের মধ্যে রক্ত না পেলে ওর বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ। আমার আর ওর রক্তের গ্রুপ একই।
ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন আমার শরীর থেকে নাকি এক ব্যাগ রক্ত নেয়া যাবে। আমি বলেছিলাম দরকার হলে আমার সব রক্ত ওকে দিব। তবুও ওকে যেন বাঁচানোর চেষ্টায় কোন ত্রুটি না করে। কিন্তু আমার সেই আকুল আবেদনে তারা সাড়া দেয় নি। অনেক কষ্টে রাজি করালে তারা এক ব্যাগ রক্ত নিতে রাজি হন।
ওর আরো রক্তের প্রয়োজন ছিল। ডাক্তার বলল ২ ঘন্টার মধ্য আরো ২ ব্যাগ রক্ত না দিতে পারলে রোগীকে আর বাঁচানো যাবে না। ব্লাড ব্যাংক থেকে শুরু করে অনেক নামি দামি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কোথাও পাই নি। শেষ পর্যন্ত এক অখ্যাত হাসপাতাল থেকে রক্ত পাই।
কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমি আমার বন্ধুকে রক্ত পাওয়ার পরও বাঁচাতে পারলাম না। নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হল। বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলাম। ছেলে হারানোর বেদনায় কিছুক্ষণ পর পর আন্টি মুর্ছা যাচ্ছেন।
আন্টিকে সান্তনা দেয়ার ভাষাও আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম।
জীবনটা কেন এত নিষ্ঠুর। বন্ধুর বিয়োগে অনেকটাই ভেঙ্গে পরেছিলাম। কেন আমার জীবনে এমন ঘটনা ঘটছে?কেন আমার আপনজনকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে?সৃষ্টিকর্তা কি আমার জীবনে শুধু কষ্টই লিখে রেখেছেন?সামান্য এক ফোঁটা সুখের অনুভূতি কি কখনো আমি পাব না?মাঝে মাঝে মনে হত এই কষ্টময় জীবন রেখে লাভ কি?কিন্তু সৃষ্টিকর্তা পবিত্র কোরআনে যে শাস্তির কথা বলেছেন সে কথা মনে পড়লেই সাথে সাথেই তা দমন করে ফেলি। সৃষ্টিকর্তা যখন এ জনমে আমার জন্য সুখের ছিটে ফোঁটাও রাখেন নি তাহলে নিশ্চয়ই পরের জনমে রেখেছেন।
এ কথাটিই আমাকে শক্ত হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আর কদিন ই বা বাঁচব!এতদিন যখন কষ্ট পেয়ছি তখন বাকি জীবনও কষ্টে কাটাতে পারব। সে শক্তি যেন আমি পাই প্রতিনিয়ত সৃষ্টিকর্তার কাছে সে প্রার্থনাই জানাই।
[গল্পটা আমার অনুর্বর মস্কিষ্কের ক্ষুদ্র কল্পনার এক প্রতিফলন মাত্র । সবাই তো ভালোবাসার অদৃশ্য কষ্ট নিয়েই লেখে।
শুধু যে ভালোবাসাতেই কষ্ট পাওযা যায় তা আমি মনে করি না। জীবনে নানারকম কষ্ট পেতে হয়। আমি তার কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।
আর একটি কথা যদি এই লেখায় কোন ত্রুটি খুঁজে পান তাহলে তা নিজ বিবেচনায় মার্জনার চোখে দেখবেন। ]
প্রথম প্রকাশ- Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।