আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তোমরা আয়েশার কথা ভুলে গেছ। সমস্যা নেই আয়শা তার কাজ করে যাচ্ছে।

হৃদয়ের কাছে বুদ্ধির বাস ভাল কথা। কিন্তু মাঝে মঝে হৃদয়ের ওপর থেকে বুদ্ধির শাসন তুলে দিতে হয়, হৃদয়কে স্বাধীন করে দিতে হয়, মুক্ত করে দিতে হয়। স্বাধীন মুক্ত হৃদয়ের ধর্মকে সব সময় বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে নেই তোমরা আয়েশার কথা ভুলে গেছ। সমস্যা নেই আয়শা তার কাজ করে যাচ্ছে। আবার শুনবে তার গল্প তবে শোন……… রাবেয়া, জোবেদা, মমতাজ, মজিদা, নাজমাকে এখন আর না খে য়ে থাকতে হয় না।

শুনতে হয় না স্বামীর গালমন্দ। কারণ, এখন সংসারে অর্থের জোগান দিচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের মতো রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার পানেয়া গ্রামের অন্তত ৪০০ হতদরিদ্র নারী বাণিজ্যিকভাবে নকশিকাঁথা তৈরি করে দারিদ্র্যকে জয় করেছেন। সংসারে এসেছে সচ্ছলতা, স্বাচ্ছন্দ্য। তাঁদের এই কৃতিত্বের নেতৃত্বও দিয়েছেন এক নারী।

নাম আয়শা সিদ্দিকা (৪৫)। আয়শা নকশিকাঁথা তৈরি করা শিখে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তেমনি গ্রামের অন্য নারীদের এ কাজ শিখিয়ে তাঁদের উপার্জনের পথ দেখিয়েছেন। এখন বেশ কাটছে তাঁদের দিন। যেভাবে শুরু: পীরগঞ্জ উপজেলার সাদুল্যাপুর গ্রামের মেয়ে আয়শা সিদ্দিকার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় চতুর্থ শ্রেণীতে ওঠার পরই।

১৯৭৭ সালে ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয় পানেয়া গ্রামের হতদরিদ্র যুবক আবদুল লতিফের সঙ্গে। দিনমজুর স্বামীর আয়ে সংসার চলত না। আশ্বিন-কার্তিক মাসে ওঁদের বেশির ভাগ দিন কেটেছে সেদ্ধ শাক-পাতা খেয়ে। আয়শা জানান, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছা সব সময় তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াত। চিন্তা করতেন, কীভাবে দুই পয়সা বাড়তি আয় করা যায়।

১৯৯৩ সালে তিনি উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ১৫ দিনের সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। মায়ের কাছে টাকা নিয়ে একটি সেলাই মেশিন কেনেন। শুরু করেন কাপড় সেলাইয়ের কাজ। কিন্তু অভাবের গ্রামে আশানুরূপ কাজ জুটত না। ১৯৯৪ সালে পরিচয় হয় পাশের কুমোদপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের বাসিন্দা চন্দনা আক্তারের সঙ্গে।

চন্দনার স্বামীর বাড়ি ঢাকার ধানমন্ডি। ঢাকায় তাঁর কাপড়ের শোরুম। কষ্টের কথা শুনে তিনি আয়শাকে ঢাকায় তাঁর বাসায় নিয়ে যান। হাতে তুলে দেন সুই-সুতা, কাপড় ও কাঁথায় তোলা বিভিন্ন নকশার সরঞ্জাম। এক মাসের প্রশিক্ষণে পাক্কা সূচিশিল্পী হয়ে ওঠেন আয়শা।

সুই-সুতার সংগ্রাম: নিজ বাড়িতে আয়শা শুরু করেন কাঁথায় নকশা তোলার কাজ। দুই মাসে দুটি কাঁথা তৈরি করে নিয়ে যান চন্দনার কাছে। চন্দনা তাঁকে দুই হাজার ৮০০ টাকা মজুরি দেন। এ টাকা আয়শাকে অনুপ্রেরণা জোগায়। শুরু হয় এগিয়ে চলা।

নতুন স্বপ্ন উঁকি দেয় মনে। কাজ শেখানোর মাধ্যমে এলাকার দরিদ্র নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার কথা ভাবেন তিনি। প্রথমে কেউ তাঁর কথায় সাড়া দেয়নি। কিন্তু আশা ছাড়েননি আয়শা। ১৯৯৬ সালে ছয়জন নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাঁথায় নকশা করার কাজে লাগিয়ে দেন।

উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকেও নিয়ে দেন তাঁদের প্রত্যেককে ১৫ হাজার টাকা করে ঋণ। কাঁথায় নকশা করার পাশাপাশি তাঁরা শুরু করেন হাঁস-মুরগি, ছাগল-গাভি লালন-পালন। বদলে যেতে থাকে ছয়জনের সংসারের মলিন চেহারা। দিনে দিনে আরও অভাবী নারী আয়শার কাছে ছুটে আসেন কাজ শিখতে। নকশিকাঁথার আয়ের টাকায় আয়শার পাকা বাড়ি হয়েছে, কিনেছেন আবাদি জমি, বসিয়েছেন নলকূপ ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা।

এক মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলেও চাকরি করে। আয়শার স্বামী আবদুল লতিফ বলেন, একদিন তাঁদের কোনো পরিচয় ছিল না। সমাজে মাথা নিচু করে থাকতে হতো। এখন সবাই ডেকে কথা বলে, প্রশংসা করে আয়শার।

অভাব পালায়: পানেয়া গ্রামের মেয়ে সুলতানা খাতুন। আট বছর আগে বিয়ে হয় পাশের কাউনিয়া উপজেলার বিশ্বনাথ চড় গ্রামের সাইফুলের সঙ্গে। দারিদ্র্যের কারণে সেখানে টিকতে না পেরে দিনমজুর স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন। আয়শার কাছে কাজ শিখে শুরু করেন কাঁথাতে নকশা তোলা। এখন তিনি হাঁস-মুরগি, গাভি-ছাগল পালন করে আয় করছেন মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।

মনোয়ারা খাতুন তাঁর মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী আনিছাকে নিয়ে ২০ দিনে একটি কাঁথা তৈরি করেন। এ উপার্জনের টাকায় তিনি একটি গাভিও কিনেছেন। স্বামী ময়নুল হকের দিনমজুরির আয় মিলে বেশ চলে যাচ্ছে তাঁদের সংসার। গৃহিণী কহিনূর বেগমের স্বামী কৃষিকাজ করেন। নকশিকাঁথা বানানোর আগে বারো মাসই তাঁদের সংসারে অভাব-অনটন লেগে থাকত।

এখন তিনবেলা খাবার জুটছে। কহিনূর বলেন, ‘নকশিকাঁথা বানাইতে হামাক খালি সুই কিনবার নাগে। বাকি সউক জিনিস আয়শা ভাবি দেয়। কাঁথায় নকশা তোলার পর যখন হাতোত মেলা টাকা পাই, তখন খুব আনন্দ নাগে। ’ কাঁথা তৈরির খরচ: নকশিকাঁথা তৈরির কারিগর নছিমন খাতুন বলেন, ছয় হাত বাই সাড়ে পাঁচ হাতের একটি উন্নতমানের নকশিকাঁথা তৈরিতে বিভিন্ন রঙের সুতা লাগে আধা কেজি, কাপড় লাগে ২০ গজ।

প্রতি কেজি সুতা ৫০০ টাকা ও প্রতি গজ কাপড় ৭০ টাকা দরে কিনতে হয়। একটি কাঁথা তৈরি করতে একজনের ২৫-২৬ দিন সময় লাগে। প্রতিটি কাঁথা তৈরির মজুরি দেওয়া হয় দুই হাজার ৪০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা। আয়শা খাতুন বলেন, উন্নতমানের নকশিকাঁথায় বিভিন্ন রঙের সুতা দিয়ে প্রচুর কারুকার্য করা হয়। কাজ শেষে গ্রামের নারীরা এ কাঁথা তাঁর কাছে জমা দেন।

এরপর তাঁদের মজুরি পরিশোধ করে নতুন কাজের জন্য কাপড় ও সুতা দেওয়া হয়। ঢাকা, রাজশাহী, রংপুরের ব্যবসায়ীদের কাছে এ কাঁথা পাঁচ হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি করা হয়। উন্নতমানের কাঁথা ছাড়াও নারীরা সাধারণ কাঁথায়, শাড়িতে, থ্রি পিসে, জামায়, জায়নামাজে, বিছানা ও গায়ের চাদরে নকশা তোলার কাজ করেন। পীরগঞ্জ উপজেলা সদরের বাসিন্দা কাঁথার পাইকারি ব্যবসায়ী আকমল হোসেন বলেন, শীত মৌসুম এলে নকশিকাঁথার চাহিদা বাড়ে। এ সময় ওই গ্রামের নারীরা কাঁথা তৈরি করতে ব্যস্ত সময় কাটান।

তাঁরা উন্নতমানের নকশিকাঁথা ছাড়াও সাধারণ নকশিকাঁথা তৈরি করেন। দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৩০০ টাকায় এ কাঁথা কিনে বিভিন্ন জেলা শহরে অফিস-আদালতে ঘুরে দুই হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি করা যায়। পানেয়া গ্রামে কাঁথা কিনতে আসা ঢাকার ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন বলেন, এ গ্রামের তৈরি উন্নতমানের একটি কাঁথা ঢাকায় ছয় হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি হয়। বিদেশিরা এই কাঁথা বেশি কেনেন। এখন এ গ্রামের তৈরি কাঁথার কদর বেড়ে গেছে, কিন্তু কারিগররা চাহিদা অনুযায়ী কাঁথা সরবরাহ করতে পারছেন না।

সেই গ্রামে: উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে পানেয়া গ্রাম। গ্রামটির বেশির ভাগ বাড়ির নারীরা এখন কাঁথায় নকশা তোলার কাজ করছেন। আয়শার বাড়ির উঠানে দেখা গেল, ২৫-৩০ জন নারী নিপুণ হাতে কাঁথায় ফুল, কলস, পাখি, নৌকা, হাতি, ঘোড়া, বর, বধূ, পালকিসহ বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত নানান বিষয় সুই-সুতা দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন। অন্যদের কথা: স্থানীয় পাঁচগাছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম (তোতা) বলেন, এ গ্রামের নারীরা মিলেমিশে নকশা তোলার কাজ করে বাড়তি আয় করছেন। উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নুরেশ কাওসার জাহান বলেন, আয়শার হাত ধরে ওই গ্রামের নারীরা যেভাবে বাঁচার পথ খুঁজে পেয়েছেন, অন্য এলাকার অভাবী নারীরাও তাঁদের দেখে অনুপ্রেরণা পাবেন।

এবং আয়শা: নকশা তোলার কাজ শিখিয়ে আয়শা গ্রামের নারীদের শুধু স্বাবলম্বী করেননি, তাঁদের একজোট করে বানিয়েছেন পানেয়া দারিদ্র্য বিমোচন মহিলা উন্নয়ন সমিতি। সমিতির সদস্য ৩০৯ জন। প্রতি মাসে সদস্যরা পাঁচ টাকা করে এ সমিতিতে সঞ্চয় দেন। বিপদে-আপদে তাঁরা এ সঞ্চয়ের টাকা কাজে লাগান। সাফল্যের পথটি আয়শাকে যিনি দেখিয়েছিলেন, সেই চন্দনা আক্তার বলেন, ‘আয়শাকে যখন কাঁথায় নকশা তোলার ওপর প্রশিক্ষণ দিই, তখন তার মধ্যে একটা দূরদৃষ্টি লক্ষ করেছিলাম।

এখন আয়শা নিজেই স্বাবলম্বী হয়েছে, অন্যদেরও নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা করছে। ’ আর আয়শার কথা, ‘দরিদ্র গ্রামীণ নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে বাকি জীবনটা ব্যয় করতে চাই। ’  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।