আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল নির্লিপ্ততা, স্থৈর্য, এই গুণ দুটি নিশ্চয়ই সবাইকে চমৎকৃত করে। আমি নিজেও উৎসুক আনন্দে মানুষের মাঝের নির্লিপ্ততা, ধীরতা খুব উপভোগ করি। নিজের যেহেতু এই জীবনে একজন নিঃস্পৃহ (ভাল অর্থে), নির্লিপ্ত মানুষ হয়ে ওঠা হবে না কখনো, তাই নির্লিপ্ত মানুষদের হিংসাও করি।
এরকম মানুষ খুব একটা দেখা যায় না। যারা এদের খোঁজেন, শুধু তারাই মূলত এদের দেখতে পান।
স্বাভাবিকভাবেই, এধরনের ব্যক্তিরা খুব যত্ন করে নিজেদের লুকিয়ে রাখেন।
ডাচ বাংলা ব্যাংকে এরকম একজনকে দেখেছিলাম আমি। ব্যাংকে কাজ করেন তিনি। মধ্যবয়স্ক, মাঝারী ছিপছিপে গড়নের লোকটি।
ভদ্রলোককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, তিনিও আমাকে চেনেন না।
কোনোদিন ভদ্রলোকের সাথে আমার কথা হয় নি; ব্যাংকিং সংক্রান্ত লেনদেন হয়নি। কারণ, নিজের কোনও কাজে নয়, আমি ব্যাংকে যেতাম আমার এক কলিগকে সঙ্গ দিতে। স্বেচ্ছায় নয়, আমার ঐ কলিগ রীতিমত জোর করে নিয়ে যেত আমাকে তার সাথে লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য!
যেহেতু এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করা ছাড়া কিছুই করার থাকত না, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম সেই নির্লিপ্ত, কুল* ব্যাংকারের কর্ম-কাজ।
ভাবতাম, “বেটায় কেমন ঠাণ্ডার ঠাণ্ডা!"
যে ডাচ বাংলা ব্যাংকে সচরাচর যায়, সে বুঝবে। ওখানে মানুষের মাথা মানুষ খায়।
অন্যান্য শাখার কথা জানি না। আমি উত্তরা শাখার কথা বলি।
সারাটা ক্ষণ গাদাগাদি ভিড় আর প্রচণ্ড গরম। এমনেতেও থাকে না কারেন্ট। তাছাড়াও কারেন্ট এসে, এত গুলা উত্তপ্ত, ক্ষুব্ধ মানুষের মাথা নিয়ে ফ্লোর ঠাণ্ডা করার বহু আগেই আবার চলে যায়।
আর ডাচ বাংলার কাস্টোমার?
কিছুই জানে না, কিছুই বুঝে না কিন্তু তার কাজ আগে হওয়া চাই।
- হয়ত একজন মহিলা চেঁচাচ্ছেন কিভাবে এটি-এম কার্ড ব্যাবহার করতে হয় সেটা কেন কেউ তাঁকে শিখিয়ে দিচ্ছে না।
- লুঙ্গি পড়া এক লোক হয়ত গোপন পাসওয়ার্ড লেখা খামটা কিভাবে কি করতে হয়, তা না বুঝে দুই টুকরা করে ছিঁড়ে দুই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় টেবিলের উপরে “কেমনে কি” চেহারা নিয়ে।
- বয়স্ক মতন ভদ্রলোক ঠাডায়া চিৎকার করতেছে 'রিকুইজিশন দেওয়ার পরও কেন এখনও চেক বই আসে নাই?'
- আর যারা একাউন্ট খুলবে তারা ফর্ম চেয়ে, কলম চেয়ে, কোথায় কিভাবে পূরণ করবে, ক্যাপিটাল লেটারে লিখবে না স্মল লেটারে লিখবেন, ভুল করে ফেলেছেন, এখন কি করবে, এইটা এনেছেন কিন্তু সেইটা আনেন নাই, পরে দিলে চলবে কিনা, ইত্যাদি প্রশ্ন করে অক্ষন* উত্তর চেয়ে হাউমাউ করে ডেস্ক'এর সামনে পেছনে নাচন কুদন করতে থাকেন অবিরত।
এবং সেই ডেস্ক সামলাচ্ছেন আমাদের সেই নির্লিপ্ত ভদ্রলোক।
আমি তাহার ফ্যান।
তিনি শান্ত, স্বাভাবিক, অবিচলিত, প্রশান্ত। মাথার পরিষ্কার টাক ঘাম-হীন, সতেজ কিন্তু চকচকে (জানি না কিভাবে?)।
ফর্সা মুখে কোনও অভিব্যক্তি নাই। ভুরু যুগলে নাই বিরক্তির কোনও ইঙ্গিত।
কণ্ঠস্বরের স্তর হাউকাউয়ের ভেতরে যতটা উঁচু না হলেই নয়, ঠিক ততটুকু।
তিনি অনুত্তেজিত কণ্ঠে কাউকে বলছেন,
"ওখানে দাঁড়ান",
"ভাই শার্ট ধরে টানবেন না প্লিজ",
"ওখানটায় বসুন আমি পাঁচ মিনিটে আপনাকে এ্যাটেন করছি"।
কাউকে বলছেন, "দেখি কি ভুল করেছেন?"
"ভাই কেমন আছেন। কখন এসেছেন? মাত্র? একটু দাঁড়ান। " (অনেকক্ষণ হল? একটু দাঁড়ান) "এই ঐটা নিয়ে আস (কলিগ’দের); এইটা কর, ঐটা দাও।
"
বেটায় সব্যসাচী! তার দুই হাত সমানে চলছে। মুখ চলছে সমান্তরালে। কিন্তু আবেগহীন, বিরক্তি-হীন, ক্ষোভহীন, উত্তেজনাহীন।
আমি যখনই যেতাম, একটা জায়গা বেছে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম ভদ্রলোকের বিস্ময়কর কর্মকাণ্ড!
আমি অনেক কিছু শেখার চেষ্টা করেছি ভদ্রলোকের কাছ থেকে। আর অফিসে এসে একটার বেশি দুইটা কাজ কাঁধে আসলে, তৃতীয় জন যদুমধু হলে রাম ঝাড়ি দিয়েছি।
শেষবার যখন গিয়েছিলাম ডাচ বাংলায়, ভদ্রলোকটিকে দেখি নাই। হয়তো ট্রান্সফার হয়ে গেছেন। কিংবা চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোচিং সেন্টার খুলেছেন। কোচিং সেন্টারের নাম “হাউ টু রিমেইন কুল”।
এখন আর যাওয়া হয় না ডাচ বাংলা ব্যাংকে।
যে কলিগ আমাকে সঙ্গে করে জোড় করে রীতিমত ধরে নিয়ে যেতেন ওখানে, তিনিও চাকরি ছেড়ে দিয়ে আরেকটি কোম্পানিতে জয়েন করেছেন।
তবু মাঝে-সাঁঝে যদি অন্য কোন কলিগ ব্যাংকে ট্যাংকে যেতে অনুরোধ করে, রাম ঝাড়ি দেই। পুরা ম্যাজাজ খারাপ হয়া যায়! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।