আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব এবং আইনের পরিহাস

To live is the rarest thing in the world. Most people exist..!! ধর্ষণের ঘটনা এখন নৈমিত্তিক। পত্রিকার পাতা কিংবা খবরের ওয়েব পোর্টালগুলো খুললেই ধর্ষণের অজস্র খবর চোখের সামনে ভেসে উঠে। ধর্ষণের খবরে আমরা আর বেশি আঁতকে উঠি না। নির্লিপ্ত অভ্যস্ততায় আমাদের অসংবেদি চোখ পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে বিনোদন পাতায় চলে যেতে সময়ক্ষেপণ করেনা। আবার অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের খবরের সরস উপস্থাপনায় অনেকেই খুঁজে পাই বিনোদন উপাদান।

সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতন, নারীকে যৌনহয়রানি এবং নারী অবমাননার ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে উঠে আসছে,গণমাধ্যমে ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হলে সেটার সাথে চাটনি হিসেবে ধর্ষণের আনুমানিক বিবরণ থাকে, এভাবে আরেকদফা শ্লীলতাহানী ঘটে ধর্ষিতার। নারীর উপর পুরুষের বলপ্রয়োগের চরম রূপ ধর্ষণ, যাতে পুরুষ নারীর সম্মতি ছাড়া তাঁর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। ধর্ষিত হওয়া নারীর জন্য মৃত্যুর থেকেও মারাত্মক; ধর্ষিত হওয়ার অভিজ্ঞতা ধসিয়ে দেয় ধর্ষিত নারীর জীবনের ভিত্তিকেই। যে কোনও সাধারন মানুষের-ই যে ধারণা ধর্ষণ নিয়ে তা হচ্ছে, ধর্ষণ করা হয় শুধুমাত্র কারো সাথে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। এটা আংশিক সত্য মাত্র।

ধর্ষণের অনেক শ্রেণীর মধ্যে একটি হচ্ছে ‘Spousal Rape বা Marital Rape ’, অর্থাৎ নিজের spouse বা স্ত্রীকে ধর্ষণ। শুধুমাত্র যৌন-সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নিজের স্ত্রীকে কেউ ধর্ষণ করে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন কোনও পুরুষ এরকম হিংস্র আচরণ করে? উত্তর এক কথায় দেওয়া যায় না। মনোবিদরা বলেন সবক্ষেত্রেই ধর্ষকদের তিনটি ব্যাপার লক্ষণীয়ঃ ক্ষমতা (power), ক্রোধ (anger) এবং যৌনতা (sexuality)। মনোবিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ মনে করেন ধর্ষণও (শিশু নির্যাতন থেকে শুরু করে নারী নির্যাতন) শুধুমাত্র নিজের কর্তৃত্ব (dominance) প্রতিষ্ঠার জন্যই করা হয়।

গবেষকরা মোটামুটি দুইটি বড় শ্রেণীতে ফেলেন ধর্ষণকে। একটি হচ্ছে Power Rape, আরেকটিকে বলা যায় Anger Rape। সবক্ষেত্রেই একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, “the use of sex is to express issues of power or anger”। আজকাল নারীর স্বনির্ভরতা পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে তুলছে। নারী হয়ে উঠেছে শত্রু লিঙ্গ।

নারীর নিরাপত্তা, আত্মসম্মান, স্বাধীন চিন্তার সুযোগ কেড়ে নিলেই কেবলমাত্র পুরুষ নিশ্চিন্ত হতে পারে এবং তার সবচেয়ে সহজ উপায় হল যৌন হিংসা। একজন নারী কেবল মাত্র পুরুষকে সুখ দেবার একটা শরীর, তার বেশি কিছু নয় পুরুষের এটা বারবার মনে করার এবং মনে করাবার প্রয়োজনীয়তা এখন তীব্র। নারীকে গায়ের জোরে অসহায় করে ফেলতে পারলে একদিকে তার স্পর্ধা গুড়িয়ে দেয়া যায় অন্যদিকে পৌরুষের তীব্র মনোবেদনা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়। পুজিবাদী সমাজে নারীর প্রধান পরিচয় সে যৌনবস্তু, পন্য বিক্রি থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে নারীর শরীর ও যৌনতাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সমাজের সর্বত্র পুজিবাদী এই আদর্শের বিকাশ আমাদের একধরনের বিকৃত যৌনচর্চায় অনুপ্রানিত করে।

নারী পুরুষ সম্পর্ক আর দশটা সম্পর্কের মতই ক্ষমতা সম্পর্ক। ঘরে বাইরে নারীর উপর আগ্রাসী যৌন আচরন,যৌন হয়রানী যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ সবই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোতে নারীর অধস্তনতাই প্রকাশ করে নানা রুপে। তাই ধর্ষণ, যৌন হয়রানী/নিপীড়ন, নারীর সম্মতি ব্যাতিরেকে তার উপর যে কোন ধরনের আগ্রাসী যৌন আচরন ক্ষমতা প্রদর্শনের, দমন-পীড়নের, কর্তৃত্ব করার কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ বই আর কিছু নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যার জন্ম সচেতন চেষ্টা ছাড়া নারীবান্ধব, নারীবাদী, সে কোনভাবেই হয়ে উঠতে পারেনা। দৃষ্টিভঙ্গিটা পুরুষতান্ত্রিক বলেই নারীকে তারা গণ্য করে অধস্তন লৈঙ্গিক পরিচয়ের বস্তু হিসেবে যা লেহনযোগ্য, পীড়নযোগ্য।

সুজান ব্রাউনমিলার তাঁর সাড়াজাগানো বইঃ Against Our Will: Men, Women, and Rape এ ধর্ষণ কে ব্যাখ্যা করেছেন পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রীয় উপাদানরূপে। ব্রাউনমিলারের মতে, ধর্ষণ শুধু কিছু মনোব্যাধিগ্রস্ত মানুষের কাজ নয়, এটি পুরুষতন্ত্রের ফসল। লৈঙ্গিক রাজনীতিতে ধর্ষণ একটি বড় হাতিয়ার, নারীকে অধীনে রাখার পুরুষের চরম উপায়। আজকের কিশোর আর তরুণেরাও এই পুরুষতন্ত্রের ফসল। তাদের ধর্ষকামী মনোবৃত্তির পিছনে তাই তাদের অবিকশিত মানস দায়ী, তাঁর চেয়ে বেশী দায়ী এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা যা তাঁকে অবিকশিত, লৈঙ্গিক চেতনায় পঙ্গু করে রেখেছে।

ধর্ষণে তাই বয়স মুখ্য নয়, কামেচ্ছাও মুখ্য নয়। নারীর পোশাকটি যৌন উত্তেজক কিনা সেটিও মুখ্য নয়। এখানে চার বছরের শিশু থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষিত হয়। বোরকা পরা মেয়েও ধর্ষণের হাত থেকে নিস্তার পায়না। বাংলাদেশের ই বহু আদিবাসী সমাজের মেয়েদের ঊর্ধ্বাংশ উন্মুক্ত থাকে।

সংক্ষিপ্ত পোশাকে নগ্ন স্তন নিয়ে তাঁরা লোকালয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাঁদের আমরা অসভ্য বলে গালি দেই। কই তাঁদের সমাজে তো ধর্ষণের মচ্ছব নেই, নগ্নতা সত্ত্বেও নারীর শরীরে আদিবাসী পুরুষ হামলে পড়েনা। তবে কি তাঁরা অমানবিক? তবে কি তাঁদের কামবোধ নেই? আদিবাসীদের সমাজে ঘুরতে গিয়ে বরং এই 'সভ্য' আমরাই তাঁদের নগ্নিতায় কামার্ত হই; অসুস্থ বিনোদন খুঁজে পাই। যে সভ্যতা আড়াল করতে শেখায়, যে সভ্যতা পোশাক আমদানি করে সেই সভ্যতা একই সাথে অবগুণ্ঠণমুক্তাদের দেখে কামার্ত হতে শেখায়।

আগ্রাসন,সংঘর্ষ এবং যুদ্ধের অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু অনিবার্য শিকার নারী। যুদ্ধে বুলেট এবং আগ্রাসী সৈনিকের পৌরুষ তখন দুটি সমান্তরাল অস্ত্রে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রের সর্বাত্মক ব্যবহার নিশ্চিত করে। পৃথিবীর নানা দেশে সংঘটিত অধিকাংশ যুদ্ধ কিংবা জাতিগত সহিংসতায় নারী ধর্ষণ যুদ্ধের অন্যতম উপকরন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সাম্প্রতিক কালের উদাহরন হিসেবে আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কম্বোডিয়া, চেচনিয়া, কঙ্গো, সাইপ্রাস, এল সালভাদর, পূর্ব তিমুর, গুয়েতেমালা, হাইতি, লাইবেরিয়া, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া, পেরু, রুয়ান্ডা, উগান্ডা, সিয়েরেলিওন, সোমালিয়া, ভিয়েতনাম, কসভ, সার্বিয়া, জিম্বাবুয়ের নাম উল্লেখযোগ্য।

অতি সম্প্রতি মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংঘটিত জাতিগত সহিংসতায় আমরা দেখেছি কিভাবে রোহিংগা মুসলিম নারীরা গণধর্ষণের নির্মম শিকার হয়েছেন। ধর্ষিত নারী আণবিক বোমাগ্রস্ত নগরী, যার কিছুই আর আগের মতো থাকেনা। কিন্তু ধর্ষিত হওয়ার পর সমাজ তাঁর সাথে সুব্যবহার করেনা, তাঁর জন্য বেদনার্ত হয়না, করুনা করেনা। ধর্ষিত অধিকাংশ নারীই ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে না, কেননা সমাজ অনেকটা ধর্ষণকারীর পক্ষেই। তাই অধিকাংশ ধর্ষিত নারীই ধর্ষণকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ না তোলে ঘটনাটি কে ভাগ্য ব'লে মেনে নেয়।

ধর্ষিত নারী কিছুটা সান্ত্বনা পেতে পারতো বিচার বিভাগের কাছ থেকে; কিন্তু বিচার বিভাগ, যা পুরুষেরই সৃষ্টি, তাকে নিয়ে অনেকটা খেলায় মেতে উঠে। বিচার বিভাগের সাহায্য চাওয়ার পর ধর্ষিত নারী ধর্ষিত হওয়ার বিভীষিকার পর পড়ে বিচারব্যবস্থার বিভীষিকার মধ্যে। ধর্ষণের অভিযোগের পর কাজ শুরু করে পুলিশ; তারা তথাকথিত সত্য ঘটনা বের করার নামে নির্মম অশ্লীলভাবে জেরা করতে থাকে ধর্ষিতাদের। (দ্রষ্টব্যঃ হুমায়ূন আজাদ, নির্বাচিত প্রবন্ধ-ধর্ষণ, পৃ. ২০০) পুলিশের জেরায় ধর্ষণের প্রাথমিক সত্যতা নিশ্চিত হলে এবার চলে ধর্ষিতার ডাক্তারি পরীক্ষা। এই পরীক্ষার জন্য ধর্ষিতাকে আবারো নগ্ন হতে হয়, চিকিৎসক তার স্তন, যোনি সহ শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অনুপুঙ্খ পরীক্ষা শেষে একটি ফরেনসিক রিপোর্ট প্রদান করেন যেটিকে আইনের ভাষায় MC বা Medical Certificate বলা হয়।

এবার শুরু হয় বিচারিক নিষ্ঠুরতা। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি অন্য আদালতের তুলনায় 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে' উৎসুক লোকসমাগম বেশী থাকে। সবাই যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে ওই ভিকটিম নারীকে দেখার আশায়, তার মুখে ধর্ষণের বর্ণনা শুনে অনেকেই লাভ করে কাম পুলক। বিচার চলার সময় অপরাধী পুরুষটির বদলে বিচারালয়ের সব মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে নারীটির উপর। বিচারালয়ে প্রথমেই নারীটির চরিত্রের উপর লেপন করা হয় একরাশ কালিমা; খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করা হয় তার অতীত যৌন ইতিহাস।

আসামীর উকিলের প্রানান্ত চেষ্টা থাকে নারীটিকে চরিত্রহীন, বহুগামী, ব্যভিচারিণী এবং চূড়ান্তভাবে পতিতা প্রমান করার এবং এর মধ্য দিয়ে এটি প্রতিষ্ঠা করা যে এখানে আসামী কর্তৃক কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি এবং যা ঘটেছে তা পরস্পরের সম্মতিতেই ঘটেছে। আর এটি প্রমাণ করার জন্য নারীটির উপর অশ্লীল প্রশ্নের ঝড় বয়ে যায়-তাকে বর্ণনা করতে হয় ধর্ষণের বিস্তারিত আখ্যান। এভাবেই নারীটি ধর্ষণের অভিশপ্ত চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকে, বার বার ধর্ষিত হতে থাকে-পুলিশের কাছে, চিকিৎসকের কাছে, আদালতেরে ভরা মজলিশে। আমরা জানি, আইন প্রমাণ আর সাক্ষ্য ছাড়া কোন প্রতিকার দেয়না কিন্তু ধর্ষিতা কি আরও মানবিক, সংবেদী বিচারব্যবস্থা আশা করতে পারেনা? ধর্ষণের মামলা গুলো যদি 'ক্যামেরা ট্রায়াল' এর ব্যবস্থা করা হয় তাহলে ভিকটিমরা এই বিভীষিকার হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেত। এছাড়া বাংলাদেশে দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারানুযায়ী এখনো স্ত্রীর ইচ্ছা বা সম্মতির বিরুদ্ধে স্বামীর যৌনক্রিয়াকে 'ধর্ষণ' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি যদি না স্ত্রীর বয়স ১৩ বছরের নিচে হয়।

অর্থাৎ ধর্ষণের সমস্ত উপাদানের উপস্থিতি সত্ত্বেও প্রাপ্ত বয়স্ক কোন স্ত্রীকে তার সম্মতি বা ইচ্ছা ছাড়াই স্বামী জোরপূর্বক যৌনকর্মে বাধ্য করতে পারে যেটি সর্বজনীন মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। আমরা একটি ধর্ষণ মুক্ত, নিপীড়ন মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি। নারীর উপর যৌন হয়রানী, ধর্ষণ, যে কোন ধরনের যৌন নিপীড়নকে আমরা যখন নারী পুরুষ প্রত্যেকে নিজেদের নিরাপত্তাহীনতা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবো, শুধু ভূক্তভোগী নয় প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অসম্মান হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবো, পুরুষতন্ত্রকে উৎখাত করে নারী-পুরুষের সমতা ভিত্তিক মানবিক সমাজ বিনির্মাণ করতে পারবো তখনই একটি নিপীড়ন মুক্ত সমাজের দিকে, বিকশিত মানবতার দিকে আমাদের যাত্রা শুরু হবে। সেদিনের প্রত্যাশায় রইলাম। ---------------------------------- ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.