সকল স্বপ্ন সত্য হবে- ছেড়েছি এই আশা, জরুরী নয় সব স্বপ্নই- সত্য রুপে আসা...
ভার্সিটির পড়া শেষ হতে আরও মাস ছয়েক বাকি, ওদিকে বাবা মা’র চিল্লানিতে ঘরে থাকা দায়। সমবয়সী চাচাতো ভাইয়েরা সবাই পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু করে। কেবল আমিই কিছু করিনা। সারাদিন ঘরে বসে মুভি দেখা আর ফেইবুকিং করাও যে একটা বিরাট কাজ, এই কথা তাদেরকে কে বোঝাবে?
যাই হোক, জীবনটা মাঝে মাঝে বেশ অতিস্ট লাগে। সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় বাব মা’র চিল্লানি, থামে রাত ১২টায়।
কতোদিন আর এভাবে থাকা যায়?
একদিন চিন্তা করলাম, বাসা থেকে বেরিয়ে যাবো। বেরিয়ে গেলাম। সারাদিন এক বন্ধুর বাসায় কাটিয়ে সন্ধ্যায় নদীর পাড়ে গিয়ে বসে রইলাম। ঠিক করলাম, আর কখনো ফিরবোনা বাসায়। বাবা- মা বুঝুক, আমি না থাকলে তাদের কেমন লাগে।
রাত ৯টা পর্যন্ত বসে রইলাম নদীর পাড়ে। ১০টার দিকে এমন খিদে পেলো যে, শরীর কাঁপতে শুরু করলো। জোর করে আরও মিনিট দশেক থাকার পর আর পারলাম না। বাধ্য ছেলের মতো বাসায় ফিরে গেলাম। এভাবে প্রায় ৬ বার বাসা ছেড়েছি তবে, কোনটার স্থায়িত্বই রাত ১০টার বেশী হয়নি।
পরদিনের কথা। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গেছি। বাথরুমে ঢুকেই প্রচণ্ড ভয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলাম। বেসিনের ঠিক পাশে বিকট দর্শন এক মাকড়সা। বিশাল সাইজ।
গায়ের রঙটাও কেমন আজব। নীলচে আর বাদামী, মাথার দিকে কালো। ঢাকা শহরের বাথরুমের ভিতরে এরকম মাকড়সা দেখবো- কখনও কল্পনাও করিনি। এগুলো শুধুমাত্র ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলেই মানায়। এখানে কোত্থেকে এলো কিছুই বুঝলাম না।
সাত- পাঁচ না ভেবে স্যান্ডেলটা উঁচিয়ে সামনে গেলাম মারার জন্য। মানুষ হিসেবে আমি বেশ ভীতু। কখনো একটা তেলাপোকাও মারিনি। আতঙ্ক নিয়ে বেড়িয়ে গেলাম। ঢুকলাম বাবা মা’র বাথরুমে।
দুপুরে একটা জরুরী কাজে বাইরে যেতে হবে। তাড়াহুড়ো করে বাথরুমে ঢুকেই আতঙ্কে বেড়িয়ে গেলাম। মাকড়সাটার কথা মনেই ছিলো না। ব্যাটা তখনো সেই একই জায়গায় সেঁটে আছে। নড়ার নামগন্ধও নেই।
ভাবলাম, ধুর- যা হয় হবে। ভয়ে ভয়েই গোসল সারলাম। গোসলের মাঝে হঠাৎ মাথায় একটা আজব চিন্তা উঁকি দিলো। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে- এটা অন্য কোন প্রজাতির মাকড়সা! বিজ্ঞানীরা যে প্রজাতির ব্যাপারে এখনো কিছু জানে না! গায়ের রঙটাও কেমন অদ্ভুত। জীবনে অনেক মাকড়সা দেখেছি কিন্তু, এরকম আজব কালারের মাকরসা আজ পর্যন্ত দেখিনি।
ছোটবেলার সেই ভয়ানক ইচ্ছাটা হঠাৎ করে ধাক্কা দিলো মনে। এ ধরনের পাগলামিগুলো আমার মধ্যে বেশ প্রবল। যখন মনে আসে, কিছু না ভেবেই করে ফেলি। এখনো তাই হলো। আর, যা ভাবছি তা যদি নাও হয়, পরিক্ষা করে দেখতে দোষ কি? জীবনে তো কতো কিছুই করলাম, এটাও না হয় আরেকটা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম মাকড়সাটার দিকে। বুক ঢিপ ঢিপ করছে, জানিনা এর ফলাফল কি হবে। ভয় এবং আশার অভূতপূর্ব এক প্রতিক্রিয়া নিয়ে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলাম মাকড়সাটার সামনে। এক মিনিট চোখ বন্ধ করে রইলাম। এরপর আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখি মাকড়সাটা খানিকটা দূরে চলে গেছে।
আবার হাত বাড়িয়ে দিলাম, আবার সে দূরে সরে গেলো। মিনিট পাঁচেক এরকমভাবে চলার পর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। শেষমেশ সব ভয় উপেক্ষা করে মাকড়সাটা জোর করে ধরে ডান হাতের উপর বসিয়ে দিলাম। বেশ কিছুক্ষন উত্যাক্ত করার পর এক পর্যায়ে সে বুঝলো- আমি কি চাই। কামড় বসিয়ে দিলো আমার ডান হাতে।
সাথে সাথে আমার পাগলামি কেটে গেলো। প্রচণ্ড জোরে দূরে ছুঁড়ে দিলাম মাকড়সাটাকে। এরপর ভয়ে আর আতঙ্কে বাথরুম থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলাম।
যাক, প্রথম ধাপ কমপ্লিট। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।
আমার সেই ছোটবেলার স্বপ্ন। এভাবে পূরণ হবে- কখনো কল্পনাও করিনি। যা ভাবছি, একবার হতে পারলেই আর পায় কে? চাকরী, ব্যাবসা সব আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। বাবা- মার চিল্লাচিল্লিও আর সহ্য করতে হবেনা।
যাই হোক, রেডি হয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেলাম।
চশমা ছাড়া আমি এক কদমও চলতে পারিনা। তারপরও, কি ভেবে যেন আজ চশমাটা নিলাম না। আমি জানি, এখন আমি চশমা ছাড়াই দেখতে পাবো। ভার্সিটিতে যাওয়ার কথা না থাকলেও ভার্সিটির দিকেই রওনা দিলাম। মনে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা।
বেরিয়েই বুঝতে পারলাম, ভুল হয়েছে। রিক্সার প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়ে গেলাম পাশের ড্রেনে। আমি কিছু বলার আগেই রিক্সাওয়ালা আমাকে কানা- লুলা জাতীয় কিছু একটা বলতে বলতে টেনে চলে গেলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষন বসে রইলাম। এরপর আস্তে আস্তে উঠে আবার বাসার দিকে গেলাম।
কাপর সব ময়লা হয়ে গেছে, চেঞ্জ করতে হবে। চশমাটাও নিতে হবে।
ভার্সিটি যেয়ে ক্লাসে ঢুকলাম না। সরাসরি চলে গেলাম ক্যান্টিনে। কোনার এক টেবিলে যেয়ে বসলাম।
পাশের টেবিলে দেখলাম ক্লাসের সবচেয়ে ফাঁতরা ছেলে সবুজ (ফেইসবুকে যেটা হয়ে গেছে- শুভজ) তার বান্ধবীদের নিয়ে বসে আছে। সবার পরনে যথারীতি সন্ন্যাসী মার্কা ড্রেস। আমি সুযোগ খুজতে লাগলাম কিভাবে ঝগড়া বাঁধানো যায় ব্যাটার সাথে। অন্যান্য সময় আমাকে দেখলেই ও দূর থেকে আজেবাজে বুলি ছোড়ে। বিভিন্নভাবে উত্যক্ত করার চেষ্টা করে আমাকে কিন্তু, আজ আমার দিকে তাকাচ্ছেই না।
ব্যাপার বুঝলাম না। আমি জানি এই মুহূর্তে আমার শরীরে অন্যরকম এক শক্তি খেলা করছে, আজ কিছু বললেই ব্যাটাকে ইচ্ছামতো ধোলাই দেবো, দেখিয়ে দেবো অস্বাভাবিক শক্তি। কিন্তু আজকে সেরকম কোন লক্ষণই সে দেখাচ্ছে না। মেজাজটা বিগড়ে গেলো।
উঠে দাঁড়ালাম।
এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম সবুজের টেবিলের দিকে। কাছে গিয়ে দাড়াতে সবুজ খানিকটা অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিয়ে কিছু বলার উদ্দেশ্যে মুখ খুললো।
মুখটা খোলার সাথে সাথেই ‘ধুম’ করে ঘুশি মেরে বসলাম।
সবুজ নাক ধরে বসে পরলো।
পাশে বসে থাকা মেয়েগুলো প্রচণ্ড অবাক দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। আমাকে তখন পায় কে? আজকে তারা বুঝবে, এই ক্যাম্পাসে সবুঝ একাই হিরো না। আশে- পাশের টেবিলগুলো সরিয়ে জায়গা করলাম মারামারি করার সুবিধার্থে। সবুজ ততোক্ষণে চেহারা লাল করে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি চড়া গলায় বললাম, আজকে আমার বদলা নেয়ার সময়।
আয় হয়ে যাক ‘ম্যান টু ম্যান ফাইট’।
ম্যান টু ম্যান ফাইটের পুরো প্রস্তুতি নিয়ে দাড়িয়ে থাকলেও সবুজ এগিয়ে এলো না। রুমালে নাক মুছে চাপা হাসি হাসলো। হঠাৎ দেখলাম, পিছন থেকে ওর পুরো চামচা বাহিনী এসে আমাকে ঘিরে ফেললো। উপায় না দেখে চোখ বুজে হাত- পা ছুড়তে শুরু করলাম, যেন কেউ সামনে আসতে না পারে।
লাভ হলো না। সবাই একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার উপর। ম্যাট্রিক্স রেভোলুশন কায়দায় সবাইকে এক ঝটকায় উড়িয়ে দেয়ার অনেক চেষ্টা করলাম। বিন্দুমাত্র কাজ হলো না।
বিকালে ফিরে এলাম বাসায়।
ভাগ্য ভালো বাসায় বাবা- মা কেউ ছিলো না। থাকলে আমার ছেঁড়া শার্ট আর চোখ- মুখের অস্বাভাবিক ফুলে ওঠা দেখে বোঝার কিছু বাকি থাকতো না। কিন্তু আমার ছোট ভাই ফাহিম দেখে ফেললো। আমার এই অবস্থা কেন- জিজ্ঞেস করাতে বেশ জোরে ধমক দিলাম। ও কথা না বাড়িয়ে মুখ টিপে হেঁসে ভিতরে চলে গেলো।
বয়স ১২ হলেও ব্যাটা এখনই অনেক কিছু বোঝে।
রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। মনে হলো, মাকড়সার কামড়ের আসল কাজ এখন শুরু হচ্ছে। একদিন অপেক্ষা করেই অ্যাকশনে নামা উচিত ছিলো আসলে। তাহলে আজকে আর মার খেতে হতো না।
যাই হোক, বুক ভরা আশা নিয়ে ঘুম দিলাম।
সকালে ঘুম ভাঙ্গতে বুঝলাম, জ্বর নেই তবে শরীরে সামান্য ব্যাথা আছে। মারের কারনেই হয়তো। আয়নার সামনে যেয়ে দেখলাম স্বাস্থ্যের কোন পরিবর্তন হয়েছে কিনা। বেশ অবাক হয়ে দেখলাম, আমূল পরিবর্তন হবার কথা থাকলেও সেটা হয়নি।
কোন পরিবর্তনই নেই। চোখ পড়লো বেসিনের পাশে। মাকড়সাটাও নেই। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতে দেখলাম, আমার ছোট ভাই ফাহিম হন্যে হয়ে ঘরের দেয়ালে কি যেনো খুঁজছে। হাতে ছোট একটা বোতল।
বাথরুমেও গেলো খুঁজতে। আমি ঠাট্টা করে বললাম- কিরে, সকালবেলা বাথরুমে কি খুঁজছিস? নাস্তা করিস নাই?
ফাহিম নির্বিকার ভঙ্গীতে বললো, মাকড়সাটা খুজে পাচ্ছিনা। ওটার উপর আমার নতুন প্রাণনাশক ওষুধের একটা গবেষণা চালাচ্ছিলাম।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কিসের ওষুধ? কিসের গবেষণা?
-ক্যান, তুমি জানোনা আমি বাথরুমে ওষুধ বানাই? কয়েকদিন আগে যখন প্রথম মাকড়সাটা দেখলাম বাথরুমে, তখন থেকেই ওষুধটা বানানো শুরু করে দিয়েছি। নতুন আইটেম হিসেবে এবার এতে যোগ করেছি কলমের কালি, সামান্য হারপিক, তোমার আফটার-শেভ, আর টুথপেস্ট।
এবারেরটা বেশ পাওয়ারফুল হয়েছে। গতকাল একটা তেলাপোকার উপর ঢেলে দিয়েছিলাম। এক ঘণ্টার মাথায় মরে গেছে বেচারা। মাকড়সাটার উপরও একবার ঢেলেছি, ব্যাটা মরেনি। আরেকবার ঢালতে হবে মনে হচ্ছে।
ফাহিমের উত্তর শুনে বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ বসে রইলাম। এরপর নাস্তা সেরে বেরিয়ে গেলাম ইমন ভাইয়ের সাথে দেখা করতে। আমার ফুপাতো ভাই। ভালো জ্যাক আছে উনার। চাকরির ব্যাপারে আমাকে হেল্প করবে বলেছিলো।
ওই ঘটনার পর থেকে আর বাসায় অলস সময় কাঁটাইনি। বিভিন্ন জায়গায় চাকরী, ব্যাবসার জন্য দৌড়াদৌড়ি করেছি, এখনও করছি। কারন সেদিন আমি যা বুঝতে পেরেছিলাম তা হলো, কল্পনার জগৎ বেশ আরামদায়ক ও সহজ, সেটা সত্যি হয়ে কাছে এলেও আসলে সেটা ক্ষণিকের। আর, বাস্তবতা বেশ কঠিন হলেও সেখান থেকে বের করে আনা সুখটা চিরস্থায়ী।
-ঘটনা এখানেই শেষ হলে ভালো হতো তবে তা হয়নি।
আমার এই আজব ঘটনাটা আমি কাউকে কক্ষনো বলিনি। শুধুমাত্র একজন ঘনিস্ট বন্ধু ছাড়া। একদিন ঘটনাক্রমে সে ও এই ঘটনাটা ফাঁস করে দিলো পুরো বন্ধু মহলের কাছে। আর এরপর থেকেই মূলত ওরা আমাকে আড়ালে 'স্পাইডারম্যান' বলে ডাকে।
শুনতে খারাপ লাগে না
বিঃদ্রঃ- উল্লেখিত ঘটনা ৯৯% কাল্পনিক।
------------------------------------------- ---------------------------------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।