নিরর্থক এই জীবনে অর্থকতার খোঁজে চলেছি অজানায় এইচ,এস,সি পাশ করে ভর্তি কোচিং নামক ভয়ঙ্কর একটা জিনিস পার করে একজন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় অনেক স্বপ্ন নিয়ে। নতুন ছাত্র হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সে সবার আগে যে জিনিসটার মুখোমুখি হয় সেটা হল র্যাগিং !!! আমি জানি র্যাগিং সমর্থনকারী লোকের সংখ্যা এর বিরোধীদের তুলনায় অনেক বেশি। তারপরও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এই অদ্ভুত ও নোংরা জিনিসটার প্রতি কেন এত আগ্রহ সেটা বোঝাও খুব একটা কঠিন কাজ নয়।
আগে দেখা যাক র্যাগিং আসলে কি জিনিস-র্যাগ হল এক ধরণের সিনিয়র জুনিয়র পরিচয় বা আলাপ পর্ব(!),পরিচয়টা কিভাবে হয়?কোন জুনিয়র ক্যাম্পাস বা ক্যান্টিন এ ইতঃস্ততভাবে ঘুরে বেড়ানোর সময় কোন বড় ভাই পাশ থেকে ডাক দেয় বা হলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ার পর তারই কোন ব্যাচমেট তাকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জাগিয়ে তুলে বলে অমুক ভাই তাকে অত নম্বর রুম এ ডাকছেন। হল র্যাগিং এবং ক্যাম্পাস র্যাগিং সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস।
ক্যাম্পাস র্যাগিং এ আলাপচারিতা শুরু হয় এভাবে "তুমি কি ১০(বা ১১)?"তারপর নাম পরিচয় শোনা হয়,খুব ই ভাল কথা। কিন্তু এরপরই শুরু হয় আসল জিনিস,হঠাৎ তাকে বলা হয় একগাদা লোকের সামনে "শিলা কি জাওয়ানি", "মুন্নি বদনাম হুয়ি" ,"চিকনি চামেলি" এই জাতীয় গানের সাথে তাল মিলিয়ে নাচার জন্য। বলা বাহুল্য বড় ভাইদের সামনে এ কাজে অসম্মতি জানানোর মত সাহস জুনিয়রের হয় না। যে যা পারে তাই করে পার পাওয়ার চেষ্টা করে। এটাই র্যাগ এর একমাত্র আইটেম নয় , গান গাওয়া,কোন অভিনয় করা এগুলো খুব ই সামান্য জিনিস র্যাগ এ ,কে কয়টা অশ্লীল শব্দ জানে তার ইন্টারভিউ নেয়া, কোন অচেনা বড় আপুকে গিয়ে হঠাৎ সালাম দেয়া,কোন বড় আপুর বাজে ছবি একে তার কাছ থেকে সই করে আনা ইত্যাদি আইটেম এ পরিপূর্ণ হয় ক্যাম্পাস র্যাগিং।
হল র্যাগিং ক্যাম্পাস র্যাগিং থেকে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। নিজের ই কোন ব্যাচমেট যে ইতিপূর্বে র্যাগ খেয়ে অভ্যস্ত সে ডেকে নিয়ে যায় হলের ছাদ এ বা বড় ভাইদের রুমে । হল র্যাগ এ কি পরিমাণ আইটেম থাকে তা দিয়ে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য রচনা লেখা সম্ভব। হল র্যাগ এর মূলমন্ত্র হল জুনিয়রের উপর ত্রাস সৃষ্টি করা। জুনিয়র এর সামনে হাজারটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ বা তাকে দিয়ে উচ্চারণ করিয়ে নেয়া, জঘন্য অশ্লীল অভিনয় করানো,অশ্লীল কবিতা বা গল্প পাঠ, কি হয় না হল র্যাগিং এ? প্রশ্ন করতে পারেন , সব জুনিয়র কি এসব কাজ অবলীলায় করে? না তা করে না ।
যারা করে না তারা হল "বেয়াদব"। আর এই বেয়াদবদের শাস্তি সিনিয়ররা খুব ভালভাবেই দেয়। প্রথমে ঝাড়ি ও গালি বর্ষণ করা হয়,কাজ না হলে মারার জন্য বারবার ভয় দেখানো হয়,বুয়েট আসলে 'ভদ্র ' জায়গা ,আমরা জুনিয়রদের জাহাঙ্গীরনগরের মত করে র্যাগ দেই না। তবে আমরা যা করি তাও অন্যান্য ভার্সিটি থেকে নিতান্ত কম না। একেবারে যে গায়ে হাত তোলা হয় না তা নয়,র্যাগ এ অবাধ্য জুনিয়রদের চূড়ান্ত পর্যায়ে দুই একটা চড়চাপড় প্রায়ই দেয়া হয়।
স্ট্যাম্প দিয়ে এক দুইটা বাড়ি দেয়ারও খবর শোনা যায়। আমার কাছে সবচেয়ে হাস্যকর লাগে যে বিষয়টা তা হল র্যাগ এর পর জুনিয়রকে সিনিয়র ভাইয়েরা মিলে খাওয়ায়। একটা কাচ্চি বিরানি খাইয়ে দিয়ে রাতভর র্যাগ দেয়ার হিসাব পরিষ্কার করা হয়।
র্যাগ খাওয়ার পর সিনিয়র ও জুনিয়র এর প্রতিক্রিয়াও খুব ই সাধারণ। জুনিওর ভাবে এই বছর তো আমি শিকার হলাম, সামনের বছর দেখে নেব জুনিয়রগুলোকে,এর চেয়ে বহুগুন বেশি পেইন দেব।
সিনিয়র তো বিজয়ীর ভুমিকায় অভিনয় করে,কেউ কেউ আবার জুনিয়রের কাছে "ভাল" সাজার চেষ্টা করে এভাবে-"ভাইয়া এতক্ষণ যা করা হল সেটা নিতান্তই ফান(!),এটাকে সিরিয়াসভাবে নেয়ার কিছু নাই, আর এতে তোমাদেরই ভাল হল ,সিনিয়রদের সাথে পরিচয় হয়ে গেল । কারো কোন লেখাপড়ায় প্রব্লেম থাকলে আমার কাছে চলে এস"।
এখানে আমার কথা হল,সিনিয়রের সাথে পরিচয় খুব ই ভাল কথা , কিন্তু সেটা এইভাবে কেন?আমরা কি লেখাপড়া শিখে এই শিক্ষা অর্জন করেছি? যারা 'ফান' বলে র্যাগকে উড়িয়ে দিতে চায় তাদের বলব,র্যাগ " ফান" শুধু সিনিয়রদের জন্য,এটা একটা অপরাধ। জুনিয়ররা র্যাগ এর পর কখনই সিনিয়রের প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধা পোষণ করে না,র্যাগ দিয়ে আমরা শুধু তাদের কাছে ছোটলোক হিসেবে পরিচিত হই। আমার এক ব্যাচমেটকে র্যাগ খাওয়ার পর কান্নাকাটি করতে দেখেছি ও ওই রাতেই বুয়েট ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতে শুনেছি
এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, প্রতি ব্যাচ তার সিনিয়র ব্যাচ এর কাছ থেকে এর শিকার হয় এবং জুনিয়রদের এর শিকারে পরিণত করে।
অনেকে বলে এটা একটা ট্র্যাডিশন ,র্যাগ না দিলে জুনিওররা বেয়াদব থেকে যায়। আমি বলব ফালতু কথা বলে নিজের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা করবেন না,বেয়াদবদের শিক্ষা দেয়া ভাল কথা তবে সব জুনিয়রই কি বেয়াদব?আর বেয়াদবির শাস্তি কিন্তু নতুন করে তার সাথে বেয়াদবি করা বা তাকে বেয়াদবির ক্রিয়াকৌশল শিক্ষা দেয়া নয় । ভার্সিটি লাইফ এ এসে সামনাসামনি কেউ বেয়াদবি করবে আর সিনিয়র হয়ে চুপ করে থাকব এতখানি অপারগ আমরা না। তাই র্যাগিংকে লাইসেন্স দেবার জন্য এধরণের আজেবাজে কারণ দেখাবেন না। চিন্তার বিষয় হল এটা যে র্যাগিং কিন্তু দিনদিন বাড়ছে।
আমাদের ব্যাচ তাদের সিনিয়র থেকে বেশি র্যাগ দিয়েছে এবং জুনিয়ররাও আমাদের চেয়ে নতুন ব্যাচকে বেশি র্যাগ দেয়ার ব্যপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
তবে র্যাগিং নামক উটকো ভাইরাস এর বৃদ্ধি রোধের উপায় কি?এর বিরুদ্ধে কথা বলা, সামান্য ব্যপার বলে একে উড়িয়ে না দেয়া। যারা র্যাগ দিতে যাচ্ছে তাদের চিন্তা করা উচিত অপরাধ এর জবাব কখনও অপরাধ হতে পারে না। সুস্থ স্বাভাবিক উপায়েও জুনিয়রদের সাথে পরিচিত হওয়া যায় । কোনও একটা ব্যাচ যদি সবাই মিলে র্যাগ এর বিরুদ্ধে একজোট হয় এবং তাদের জুনিয়রদেরও এই ব্যপারে উৎসাহিত করে তবে র্যাগিং নামক ভাইরাস থেকে অন্তত বুয়েট মুক্ত হবে।
জানি সে আশা সুদূর পরাহত, তবু ভাল কিছু আশা করতে দোষ কি? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।