আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুবার ডেকে আমার সাথে পরামর্শ করেছেন : আবদুল কাদের মোল্লা

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, এতদিন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সাথে একসাথে মিছিল-মিটিং ও রাজনীতি করেছি। আজ পলিটিক্যালি ভিক্টিম করার জন্য যাদের সঙ্গে একসাথে রাজনীতি করেছি, তারা জামায়াতে ইসলামী করার কারণে আমার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছে। গত ৪০ বছর সময়ে মধ্যে কোনো পত্রপত্রিকা বা কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করা হয়নি। তিনি বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুবার ডেকে তার সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।

আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ দ্বিতীয় দিনের মতো আবদুল কাদের মোল্লা নিজেই সাফাই সাক্ষী হিসেবে নিজের পক্ষে সাক্ষী দিয়েছেন। জবানবন্দীতে কাদের মোল্লা বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে গণভবনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করার পর তিনি আমাকে বলেন, আমরা সরকার গঠন করলাম। আমাদের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ছিলেন।

তিনি আমাকে রিসিভ করেন। আমি তখন প্রধানমন্ত্রীকে জনগণের উন্নয়নে গঠনমূলক পরামর্শ দেই। প্রধানমন্ত্রীও তাতে সাদুবাদ জানান। এভাবে আরো দুইবার প্রধানমন্ত্রী আমাকে গণভবনে ডাকেন। আবদুল কাদের মোল্লার জবানবন্দী : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চুড়ান্ত বিজয়ের পর আমি লেখাপড়ার জন্য ঢাকা আসার চেষ্টা করতে থাকি।

জবানবন্দীতে উল্লেখিত ব্যক্তিদের সাথে ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করি যাতে আমার লেখাপড়ার কোনো ক্ষতি না হয়। তারা তিনজনই আমাকে একযোগে পরামর্শ দেন, এখন ঢাকায় যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ হিসেবে তারা বলেন তোমার ভূমিকা সম্পর্কে ঢাকায় কারো জানা নাই। সেখানে গেলে বর্তমান অবস্থায় যেকোনো ধরনের বিপদ হতে পারে। আমরা তোমার ভূমিকা সম্পর্কে জানি, তাই তুমি বাড়িতে থাক।

আমরা খোঁজখবর নেই, তারপর সবকিছু জানাশোনার পর এবং বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে ছড়ানো ছিটানো অস্ত্রশস্ত্র সরকারের হাতে জমা হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, জান-মালের নিরাপত্তা বিধান হবে, তখন আমরাই তোমাকে ঢাকায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করব। এরপর তাদের পরামর্শ মোতাবেক আমি বাড়িতে এবং উপরে উল্লেখিত পীর সাহেবের বাড়ীতে অবস্থান করতে থাকি এবং চৌদ্দরশি বাজারে ব্যবসা করতে থাকি। তখন মাঝে মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা হাসান, মাকসুদ, আবদুল হাই প্রমুখের কাছ থেকে আমি চিঠি পেতে থাকি। তারা লেখে, তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নাই তুমি তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে আস। এই চিঠিপত্র সম্পর্কে আমি সদরপুর থানার উল্লেখিত তিন ব্যক্তিকে জানায়।

তারা বললেন, একটু দেখেশুনে যাওয়াই ভালো, এই চিঠি যে তারাই লিখেছেন তার কী প্রমাণ আছে। ১৯৭২ সালের সম্ভবত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সদরপুর থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি শাহজাহান তালুকদার নিজেই আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং আমাকে শহীদুল্লাহ হলের গেটে নামিয়ে দেন। আমি আসার পর ছাত্রলীগের বর্ণিত নেতারা আমার ভর্তির এবং হলে থাকার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন। কারণ তারা আমার কাসমেট ছিলেন এবং আমি তাদেরকে লেখাপড়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করতাম, তাদের সঙ্গে আমার আন্তরিকতাও ছিল। ১৯৭১ সালের সম্ভবত জুলাই মাসের শেষের দিকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অফিস থেকে টেলিগ্রাম এবং ডাকযোগে খবর পাই, পরীক্ষা শুরু হয়েছে, আমি যেন এসে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা দেই।

আমি এই বার্তা মোতাবেক জুলাই মাসের শেষের দিকে আমি ঢাকায় এসে হলেই উঠি। সপ্তাহখানেক প্রাকটিক্যাল কাসও করি। কাস শেষ হওয়ার ২/৩ দিন পর তিন দিনের বিরতিসহ দুই দিনব্যাপি প্রাকটিটক্যাল পরীক্ষা চলে। পরীক্ষা শেষে সপ্তাহখানেক পর আবার বাড়ি চলে যাই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষা বাতিল হওয়ার কারণে আমার ব্রেক অব স্টাডি হয় এবং এ কারণে পদার্থ বিদ্যায় এমএসসি করা হয়নি।

১৯৭৪ সালে আমি আইইআর (ইন্সটিটিট অব এডুকেশন এন্ড রিসার্চ)-এ ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন (সোস্যাল সাইন্স)-এ ভর্তি হই। ১৯৭৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন পাশ করি। আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করি। এরপর ডিগ্রী প্রথম বর্ষে যখন পড়াশুনা করি তখন ইসলাম এন্ড কমিউনিজমের তুলনামূলক পড়াশুনা করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পেরে আমি ইসলামী ছাত্র সংঘের কাজ করতে থাকি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পড়াশুনা করি।

পড়াশুনা শেষ করে ওই সালেই আমার রেজাল্ট প্রকাশ হওয়ার আগেই আমি কিছুদিন ইসলামী ফাউন্ডেশনে চাকরি করি। পরে বিডিআর সেন্ট্রাল পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে চাকরি করি। আমি সেখানে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। আমি উদয়ন বিদ্যালয়ে ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে শিক্ষকতা করেছি। আমি মানারাত স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম।

১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করার পর আমি জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করি। ইতিমধ্যে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক সংগ্রাম পুনঃপ্রকাশিত হয়। আমি মানারাত থাকা অবস্থায় ওই পত্রিকায় শিক্ষা বিভাগের পাতার পরিচালক ছিলাম। আমার সাংবাদিকতার প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে আমি সংগ্রাম পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ১৯৮১ সালের প্রথম দিকে যোগদান করি, তবে তখনও আমি মানারাত ট্রাষ্টের সদস্য ছিলাম। ইতিমধ্যে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করি।

১৯৮২-৮৪ পর্যন্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই বার নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছিলাম তার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকি। সম্ভবত ১৯৮৩ সালে ঢাকা মহানগর জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক নিয়োজিত হই। ১৯৮৭ সাল আমি ঢাকা মহানগর জামায়াতে আমির নির্বাচিত হই এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করি। ঢাকা মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসেবে আমি কেন্দ্রীয় লিঁয়াজো কমিটির সদস্য ছিলাম। কেন্দ্রীয় লিঁয়াজো কমিটির সদস্য থাকার কারণে তৎকালীন এরশাদ বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াসহ উভয় দলের সিনিয়র নেত্রীবৃন্দের সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে উঠে।

১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ জামায়াতের সমর্থন চায়। জামায়াতে ইসলামের সমর্থন পেলেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে পারবেন না- একথা আওয়ামী লীগকে জানানো হয়। এরপর বিএনপি আমাদের কাছে সরকার গঠনের জন্য সমর্থন চাইলে বিএনপি’কে সমর্থন দেই এবং শর্ত দেই, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেনি এই কারণে আমরা পরে আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে একীভূত হয়ে তত্ত্ববধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করি। আন্দোনের সময় মরহুম আবদুস সামাদ আজাদের বাসায় প্রায়শই লিঁয়াজো কমিটির মিটিং হতো এবং আমি সেখানে উপস্থিত থাকতাম। নাসিম সাহেব এই লিঁয়াজো কমিটিতে গৃহীত আন্দোলনের কর্মসূচী সম্পর্কে ব্রিফিং করতেন।

আমি এগুলো নোট করে নিয়ে এসে বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করতাম। আন্দোলন তীব্রতর রুপ লাভ করলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাজে আমাকে এবং আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদকে একই দিনে গ্রেফতার করে, আটকাদেশ দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। সপ্তাহ দুয়েক পরে আমি মুক্তি পাই। আমাদের আন্দোলন চলেতে থাকে। একপর্যায়ে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে আইন পাশ করে।

আন্দোলনের কারণে জামায়াতের সাথে বিএনপি’র দুরত্ব সৃষ্টি হয় ফলে ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে জামায়াত এবং বিএনপি আলাদাভাবে নির্বাচন করে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একপর্যায়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং আমাকে বললেন আমরা তো সরকার গঠন করলাম, আমাদের কিছু পরামর্শ দেন। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মহিউদ্দিন খান আলমগীর মুখ্যসচিব ছিলেন এবং তিনি আমাকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে রিসিভ করেন। আমি তখন প্রধানমন্ত্রীকে কিছু গঠনমূলক পরামর্শ দেই যা শুনে তিনি আমাকে সাধুবাদ দেন।

একইভাবে তিনি পরে আমাকে আরো দুবার ডেকেছিলেন। এখন আমি মনে করছি দীর্ঘদিন যাদের সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলন করলাম, মিটিং মিছিল করলাম, সুসম্পর্ক রাখলাম, সখ্যতা রেখে চলেছি তারা এখন শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য দীর্ঘ ৪০ বছর পর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর সঙ্গে আমার বিন্দুমাত্র কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না এবং নাই এবং আমি কোনভাবেই ওই ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। বিগত ৪০ বছর মধ্যে আমার বিরুদ্ধে কারোর পক্ষ থেকে পত্র-পত্রিকায় বা কোনো কর্তৃপক্ষের বরাবরে আনীত কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো মিথ্যা, বানোয়াট, কাল্পনিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

প্রসিকিউশনের জেরা : আবদুল কাদের মোল্লার জবানবন্দী শেষ হলে তাকে জেরা করেন প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী। প্রসিকিউটরের প্রশ্নের জবাবে কাদের মোল্লা বলেন, আমরা ছয় বোন তিন ভাই ছিলাম। বর্তমানে তিনভাই তিন বোন জীবিত আছি। বড় ভাই মো. ইব্রাহিম মোল্লা, আমি মেজ এবং ছোটভাই মো. মইনউদ্দিন মোল্লা। বর্তমানে ভাষাণ চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমার ছোটভাই মইনউদ্দিন মোল্লা।

এক প্রশ্নের জবাবে কাদের মোল্লা বলেন, ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে পড়ার সময় আমি ছাত্রসংঘে যোগ দেই। ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে আমি জামায়াতে ইসলামীর সিদ্ধান্তে অধ্যাপক গোলাম আযমের একান্ত সচিব ছিলাম। অপর এক প্রশ্নের জবাবে কাদের মোল্লা বলেন, ছাত্রসংঘ ছাত্রশিবিরে পরিণত হয়নি। শিবির একটি নতুন ছাত্রসংগঠন। প্রসিকিউটরের প্রশ্নের জবাবে কাদের মোল্লা বলেন, ধলা মিয়া পিরসাহেব বর্তমানে জীবিত নেই।

তিনি পুলিশের সাবেক আইজিপি আবুল হাসনাত মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেবের ছোট ভাই। অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, অবসরপ্রাপ্ত জেসিও মোফিজুর রহমান বর্তমানে সম্ভবত জীবিত নেই। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.