আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৃত্যু? সে তো মামুলি ব্যাপার

জড় এক প্রসঙ্গ কাঠামোর নিবিড় পর্যবেক্ষক :P ( এটা কোন ম্যুভি রিভিউ নয়) "এ সার্ভিয়ান ফিল্ম" ম্যুভিটা দেখেছেন? আমি প্রথম ম্যুভিটার সন্ধান পাই আমার এক বিদেশী বন্ধুর কাছ থেকে। যাবতীয় হরর আর ডিস্টার্বিং ম্যুভির ফ্যান সেই বন্ধুটি নিজেকে অনেক "Tough guy" মনে করত। যে হরর ম্যুভি 'Saw' দেখে অনেকের বমি বমি ভাব হয়, আমার সেই বন্ধুটি কিনা সেই "Saw" ম্যুভিতে "মানুষের তলপেট থেকে রক্তে মাখামাখি ক্ষুদ্রান্ত্র বেরিয়ে আসছে" এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে রীতিমত থাইস্যুপ খায়। তো সেই বন্ধুর সাথে একদিন চ্যাট হল। বেচারার মন অনেক খারাপ, গত তিন চার দিন ধরে নাকি সে কিছুই খেতে পারছে না, তাও আবার এক ডিস্টার্বিং ম্যুভি দেখার কারনে।

বেপারটা আমার কাছে অনেকটা ব্যাঙের সর্দির মত ঠেকল। আমার কোন কালেই এসব ম্যুভির প্রতি আকর্ষন ছিল না। কিন্তু তার মত "Tough guy" এর বেহাল দশা দেখে আমার খানিকটা কৌতূহল হল। জানতে চাইলাম কি সেই ম্যুভি। এই কথা শুনে বন্ধু জিহ্বায় কামড় দিয়ে না করল।

আমার মত সেন্সেটিভ পাকস্থলির জন্য নাকি এই ম্যুভি না বিশেষ করে তার নিজেরই হজম করতে যেখান বেগ পেতে হচ্ছে। তার এই কথা আমার ভার্চুয়াল পুরুষত্বে আঘাত হানলো এবং আমার কৌতূহল বেড়ে গেল বহুগুন। চেপে ধরলাম বন্ধুটিকে, নাম না জানার আগে ছাড়ছি না। শেষে সে বাধ্য হল নাম বলতে, তবে সাথে সাথে সে ভীষনভাবে নিষেধ করে দিল-এই ম্যুভি যেন ভুলেও না দেখি। "এ সার্ভিয়ান ফিল্ম" হল সেই ম্যুভি; এই পৃথিবীর সবচেয়ে আসুস্থ ম্যুভিগুলোর মধ্যে একটা।

ম্যুভিটা জোগাড় করেই দেখতে বসে গেলাম এবং এক নিঃশ্বাসে দেখে শেষ করলাম। নিশ্চয়ই সবাই ভাবছেন আমার অনেক বমি-বমি ভাব হচ্ছিল, মাথা ঝিম ঝিম করছিল, বিশ্বের সবচেয়ে অসুস্থ ম্যুভি বলে কথা। কিন্তু আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম আমার মধ্যে এই ধরনের কোন অনুভুতি কাজ করছে না। এই ধরনের ম্যুভি দেখে অভ্যস্থ আমার বিদেশী বন্ধুটি যেই ম্যুভি দেখে তিন-চার দিন খেতে পারছে তা দেখে আমি বিন্দুমাত্র ক্ষুধামন্দাও অনুভব করছিলাম না। কেন জানেন? এই অসুস্থতম ম্যুভিতে যা কিছু দেখানো হয়েছে তা আমাদের দেশে প্রতিদিনের ঘটনা।

=>এখানে দেখানো হয়েছে একটি নবজাতককে ধর্ষণ করা হচ্ছে। তিন-চার বছরের কোন শিশু ধর্ষিত হওয়া আমাদের দেশে নিত্যদিনের ঘটনা, শিগ্রই আমরা 'নবজাতক' লেভেলে পৌছে যাব। এই খবর কি আমাদের আর বিচলিত করে? =>এখানে দেখানো হয়েছে ধারানো অস্ত্র দিয়ে মাথা কেটে ফেলা হচ্ছে এক এক অসহায় তরুনীর। আমাদের দেশে শুধু জবাই নয়, এরপর টুকরা করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়। আর এই খবর আমাদের সংবাদপত্রের পঞ্চম পাতায় অবহেলার সাথে চাপা হয়।

=> এখানে দেখানো হয়েছে অনেক খুন, যা কিনা এদেশে নুনের চেয়ে সস্তা হয়ে গিয়েছে বহু আগেই। "এ সার্বিয়ান ফিল্ম" দেখার আগে আমার বিদেশী বন্ধুর কাছে অসুস্থতা আর ভয়াবহতার একটা সীমা ছিল। এই ম্যুভিটি তার সেই সীমা অতিক্রম করেছে বলেই হয়ত সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবে সে এটা ভেবে অন্তত সান্তনা নিতে পারে যে 'এটা নেহাতই একটা ফিল্ম। ' কিন্তু আমরা যারা এই মৃত্যুপুরীতে থাকি তারা খুব ভাল করে জানি এই ম্যুভির প্রতিটি অবাস্তব বিম্ব আমাদের জীবনে কতটা বাস্তব।

আমাদের সান্তনা নেবার জায়গা কোথায়? বাস্তবতা যতটা না ভয়াবহ তার চেয়ে ভয়াবহ হল "একটি শিশু ধর্ষিত হল", "একজন যুবক জবাই হল", "এক অজ্ঞাত তরুনীর গলিত লাশ উদ্ধার হল" এই খবরগুলো শুনে আমি বা আমরা আজ আর বিচলিত হই না। পাতা উলটে সংবাদপত্রের বিনোদন পাতায় চলে যাই, কিংবা রিমোট টিপে চলে যাই হিন্দি ছবির কোন আইটেম গানে। জাতি হিসেবে আমরা দিন দিন ভোঁতা আর অনুভুতিহীন হয়ে যাচ্ছি। কোন মৃত্যুই আমাদের আর বিচলিত করে না, কোন ট্র্যাজেডিতেই আমরা আর ব্যথিত হই না। এটা সম্ভবত মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর।

এবার আসুন একটা ছোট গল্প শুনি। ২০৩০ সাল। বিশ্বকাপ ফুটবল চলছে। রহিম সাহেব তাড়াতাড়ি অফিস সেরে বাসায় ছুটে এলেন, আজ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচ। ঘরে ঢুকতেই তার ছেলে ঝন্টু ছুটে এল; --জানো আব্বু, আজ তো অস্থির একটা ঘটনা ঘটেছে।

--কি হয়েছে? --তুমি যে last month e একটা জায়ান্ট সাইজের ফ্রিজ কিনেছিলে, আম্মু আজ সেখান থেকে খাবার বের করতে গেল আর ফ্রিজটা ঢুম করে আম্মুর উপর এসে পড়ল। একেবারে ম্যুভির মত। আর আম্মুর শরীর থেকে রেড চিলি সসের মত রক্ত বের হচ্ছিল। আম্মু অনেক্ষন চেষ্টা করেছিল বের হবার। i guess মাম্মি is dead. আই এম ফিলিং স্যাড।

রহিম সাহেব উঁকি দিয়ে পাশের রুমে ফ্রিজের নিচে চ্যাপ্টা হওয়া স্ত্রীকে দেখলেন। রক্তে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। তিনি টাইয়ের নট ঢিলে করতে করতে ছেলের দিকে ফিরলেন। --আই এম স্যাড ঠু ঝন্টু। কিন্তু কথা হল টিভির রিমোটটা কোথায়।

আজকে তো ব্রাজিল আরজেন্টিনা ম্যাচ। --রিমোট তো আম্মুর হাতে ছিল। --যাও তো নিয়ে আসো। কাল সকালে ফ্রিজ সরিয়ে তোমার আম্মুর ডেডবডি বের করতে হবে, এখন অনেক টায়ার্ড লাগছে। ঝন্টু গিয়ে তার মায়ের হাত থেকে রক্তাক্ত রিমোট নিয়ে আসলো।

এবং রহিম সাহেব তার ছেলেকে নিয়ে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল ২০৩০ দেখতে লাগলেন। কিছুক্ষন পরই তাদের বাসা থেকে ভেসে এল চিৎকার "গোওওওওওওওল। " উপরের গল্পটি কাল্পনিক। আমরা এতটা পাষাণ না যে চোখের সামনে একজন মানুষ ফ্রিজের নিচে চাপা পড়ে আছে আর অথচ আমরা বিনোদনে ডুবে যাচ্ছি। কিন্তু আসলেই কি তাই? সাভারের রানা প্লাজায় কনক্রিটের নিচে চাপা পড়া মানুষদের জন্য কি আমরা সত্যিই কিছু করছি? যদি না করে থাকি কেন করছি না? নিজের মা, নিজের স্ত্রী কিংবা নিজের বোন নয় বলে? আজ আমি অন্যের মা,কিংবা অন্যের বোনের জন্য করছি না এই আমিই ২০৩০ সালে 'রহিম সাহেব' এ পরিনত হব না তার কি নিশ্চয়তা আছে? বারবার প্রশ্ন করি নিজের বিবেককে, আর বারবারই মনে হয় আমাদের এই দেশ উপরে বর্নিত ম্যুভির চেয়ে অনেক ভয়ংকর, আর আমরা 'এ সার্বিয়ান ফিল্ম' এর অসুস্থ চরিত্র গুলোর চেয়ে আরো বেশী অসুস্থ।

**এখানে বর্নিত প্রতিটি ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। অতীত, বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের কোন ঘটনার সাথে মিল পাওয়া গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়। **"A serbian film" is a highly disturbing movie. watch at your own risk. I suggest don't.  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.