আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিজন অশ্রুর ধূসর পান্ডুলিপি

যখন তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেছেন,রবীন্দ্রনাথ তপনতাপে জ্বলছেন বাংলার সাহিত্য আকাশে। বাংলা কবিতার আঙ্গিক-ভাব-ভঙ্গিতে তিনি যে হিমালয়িত উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করেছেন,তার সামনে দাঁড়িয়ে সে সময়ের যেকোন কবির অসহায় বোধ করা দোষের ছিলনা। কিন্তু আর কিছু কি লেখার বাকি ছিল ? ‌‌‌‌‌সোনার তরীর কবি কি পেরেছিলেন, বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার শেষ ধাপে পৌঁছে দিতে ?প্রশ্নগুলো যখন নবীন কবিদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে,তখন কালিকলম-কল্লোল প্রভৃতি পত্রিকা চেষ্টা করছে ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহল থেকে বাংলা কবিতার প্রাণপাখিকে অন্যত্র স্থানান্তর করতে। একটি অনুচ্চারিত বিদ্রোহকে কলমে উচ্চারণের চেষ্টা করছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত,অমিয় চক্রবর্তী,বিঞ্চু দে,বুদ্ধদেব বসুরা। সময়ের সেই সন্ধিক্ষনে কবিতার আঙ্গিককে ভেঙ্গে একেবারে তছনছ করে দিলেন জীবনানন্দ।

তবে আনন্দের তুলিতে নয়,বিজন অশ্রুর অনুভূতিতে ! আসলে,আনন্দ যার জীবনে বিরলতম তিনিই জীবনান্দ । বিষন্নতার সঙ্গে বসবাস করতে করতে পিতৃপ্রদত্ত নামটির ভার কখনো কখনো তার কাছে খুব অবহ মনে হয়েছে। কিংবা,এই নামটিই হয়তো তাকে রসদ জুগিয়েছে,সতত সৃষ্টিশীলতার মাঝে বেঁচে থাকতে। সে রহস্য সমাধান আমরা কোনদিনই করতে পারবো না। পার্থিব জগতের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে জীবনানন্দের কবিতার জগত মিলতো না।

তার কবিতার শব্দগুলো ভেসে আসতো যেন, অন্য কোন ধূসর জগত থেকে। কারো চোখে তিনি নির্জনতম কবি,কেও বলেছেন নিশ্চেতনার কবি,আবার কেউ তাকে ডাকে বিজন অশ্রুর কবি। বিঞ্চু দে,অচিন্ত্যের মতো জীবনান্দের কবিতায় বিদ্রোহের তুষানল থাকলেও তারা কেউই রবীঠাকুরের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। এদের অন্তরে রবীঠাকুর ছিলেন শালগ্রাম শিলার মতো অনড়। তবে বাকিদের সঙ্গে জীবনানন্দের পার্থক্য ছিল।

অমিয় চক্রবর্তী কিংবা অচিন্ত্যদের জন্য কবিতা বাঁচামরার সংগ্রাম ছিল না। কিন্তু জীবনানন্দের জন্য ছিল। অধ্যাপনার চাকুরী জোটাতে পারলেও তা ধরে রাখতে পারেননি। ওদিকে তার কবিতা পড়ে সম্পাদকদের মনও ভরছে না। নানাভাবে অপমানিত হচ্ছেন।

বিয়ে করলেন,কিন্তু সেটাও তাসের ঘর। দারিদ্রের যাঁতাকল কি প্রভাবিত করেছিল তার কবিতাকে ? মুখচোরা,অর্ন্তমুখী,নির্বিরোধি মানুষটি রবীর আলোয় আলোকিত না হয়ে,একা একাই পথ চললেন,অচেনা এবড়ো-থেবড়ো অনালোকিত রাস্তায়। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা দলছুট মানুষগুলোর গায়ে সমাজ 'পাগলে'র ছাপ মেরে দেয়। এক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। জী্বনানন্দের কবিতাকে অশ্লীল-দুর্বোধ্য নামক দুই শব্দে ধারন করলো সবাই।

কিন্তু তার কবিতাতে এমন অদ্ভুতসব উপমা আসতে লাগলো যা এর আগে কেউ কখনো ভাবেনি। তিনি বলেছিলেন,সকলেই কবি নয়,কেউ কেউ কবি। জানতেন,সবাই তার পাঠক হবেনা। কেউ কেউ হবেন। অনেকসময় পেরিয়ে সেইসব পাঠকেরাই তার উপমা থেকে খুঁজে পাবেন নতুনসব ছবি।

দিনের আলো নিভলেই তারারা আলো জ্বালে। বৈজ্ঞানিকেরা যত ব্যাখ্যাই দিক না কেন,আমাদের অবচেতন মনে ওইসব তারাদের বাস কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক। কেউ করুন,কেউ বরুন,আবার কেউ বা আঁধার মানিকের মতোই ফুটফুটে। সেই তারা নিয়ে উপমা- 'পাড়া গেঁয়ে বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলী মদির মেয়েটির মতো কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে মুক্তো আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিল হাজার বছর আগে এক রাতে তেমনি- তেমনি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনো.....(শিকার)। তারা নিয়ে কবির আরেকটি উদ্ধৃতি দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না- 'নিশার আকাশে তাকায় কেমন করিয়া তাকায় আমার পানে সে লক্ষ্য যোজন দুরের তারকা মোর নাম যেন জানে সে যে ভাষায় তারা করে কানাকানি সাধ্য কি আর মনে তাহা আনি চির দিবসের ভুলে যাওয়া বাণী কোন কথা মনে আনে সে অনাদি উষার বন্ধু আমার তাকায় আমার পানে।

'...(উৎসর্গ-১৪ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) নারীর মুখের বর্ণনা কবিদের আরেকটি প্রিয় বিষয়। 'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা/মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকাজ'-রবীঠাকুরের কবিতার বাইরে এটিই সম্ভবত বাঙ্হালীর সবচেয়ে প্রিয় রুপমুগ্ধতার পংক্তি। কিন্তু আরো একরকমের মুখের উপমা দিয়েছেন জীবনানন্দ- 'আবিষ্ট পুকুর থেকে সিঙারার ফল কেউ কেউ মুখে নিয়ে চলে গেলে-নিচে তোমার মুখের মতো অবিকল নির্জন জলের রং তাকায়ে রয়েছে'....(তোমাকে) প্রেমের কথা উঠলে জীবনানন্দের এই কটি লাইন হৃদয় ছুঁয়ে যায়- 'এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল পদ্ম পাতায় তোমার আমার মিল আকাশ নীল,পৃথীবি এই মিঠে রোদ ভেসেছে,ঢেঁকিতে পাড় পড়ে পদ্মপত্র জল নিয়ে তার-জল নিয়ে তার নড়ে পদ্মপত্রে জল ফুরিয়ে যায়....(তোমাকে ভালবেসে) গোটা জীবনের সারাংশ যেন মাত্র কয়েকটি পংক্তিতে উঠে আসে। বাস্তব জী্বনে যখনই কোন পদ্মপাতার জল টলমল করতে দেখি,জীবনের আকুলতা,নশ্বরতা,ভালবাসার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সবই যেন মিলেমিশে বিষ্ফোরণ ঘটাতে চায়। বেশিক্ষন ওই দিকে তাকিয়ে থাকতে পারিনা।

দৃষ্টি ফিরিয়ে নেই। কবিতার জোর এখানেই। জীবনের আয়নাঘরে কবিও বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারেননি। ১৯৫৪ সালে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে কোন বিকেলের আলো-আঁধারির মাঝে ট্রামের তলে জী্বন প্রদীপ 'নির্বাপিত' করেছেন কবি। ‌'নির্বাপিত' কারণ-প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুযায়ী আত্নহত্যা করেছিলেন তিনি (উইকিপিডিয়া)।

কিন্তু কাউকে কিছুই বলে যাননি রুপসী বাংলার কবি। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।