অনিশ্চয়তার পথে একাকী হেঁটে চলা আপনাকে যদি বলি দুচোখ বন্ধ করে না ঘুমিয়ে সজাগ হয়ে একটি ঘণ্টা বসে থাকুন। আপনার কাছে কিছুক্ষণ পরই অস্থির লাগা শুরু হবে। অথচ আপনি কি জানেন আপনারই পাশের কোন কোন মানুষ ঠিক এভাবেই বেচে আছেন বহু বছর...কেউবা আর কখনোই আলোর দেখা পাবেন না। ছোট ছোট অনেক শিশুও রয়েছে এদের মধ্যে, যারা পৃথিবীর রং রূপ আলো বুঝে ওঠার আগেই সব নিভে গেছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ অন্ধত্বের স্বীকার।
এদের মধ্যে কর্ণিয়া জনিত অন্ধত্বের স্বীকার প্রায় ৬ লক্ষের মত মানুষ। চরম নৈরাশ্য নিয়ে এই মানুষগুলো দিন পার করছে। প্রতি বছর এদের সংখ্যা বাড়ছে প্রায় ৪০ হাজার করে। অথচ আমরা সবাই মিলে একটু চাইলেই এদের চোখে ফিরিয়ে দিতে পারি আলো। একাজটি সম্ভব করে তুলতে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে মরনোত্তর চক্ষুদানে।
আমাদের চোখের একদম বাইরের দিকের অংশে যে স্বচ্ছ পর্দা দেখা যায়, তাই কর্ণিয়া। মৃত্যুর পর প্রায় ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত এই কর্ণিয়া সজীব থাকে। এই সময়ের মধ্যে তা সংগ্রহ করে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে অন্ধ মানুষের চোখে তা প্রতিস্থাপন করলে সে মানুষটি পেতে পারে এই সুন্দর পৃথিবী দেখার সুযোগ।
ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মে, মরনোত্তর চক্ষুদানের ব্যাপারে কোন নিষেধাঙ্গা আমার জানা মতে নেই। মক্কার ফিকাহ একাডেমী ও ও.আই.সি এব্যাপারে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশে মরনোত্তর চক্ষুদান নিয়ে কাজ করছে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ১৯৮৪ সাল থেকে। বাংলাদেশে স্থাপন করা হয়েছে সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংক। বাংলাদেশের প্রতিটি মেডিকেল কলেজে রয়েছে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির কার্যক্রম। রয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে চক্ষুসেবার ব্যাবস্থা।
আপনার আমার একটু সদিচ্ছায় একজন মা পেতে পারেন সন্তানের মুখ দেখার আনন্দ, একজন সন্তান পেতে পারে মা-বাবার মুখ দেখার সুখ।
তাই আসুন আমরা মরনোত্তর চক্ষুদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ হই। অন্যকেও উৎসাহিত করি।
কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার। অনেকেই হয়ত তাঁর নাম শুনে থাকবেন। আমাদের শরীরের যে রক্তের গ্রুপিং সিস্টেম, ABO & Rh Blood Grouping System এর আবিষ্কারক তিনি।
তাঁর এই আবিষ্কার না হলে আমরা রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা করতে পারতাম না এক মানবদেহ থেকে আরেক মানবদেহে। অনেক অনেক প্রান হারিয়ে যেত অকালেই!
কিন্তু এরপরও রক্তের অভাবে আমরা আপনজন হারাচ্ছি!!
বিশেষ করে নিরাপদ রক্তের অভাবে।
আপনারা হয়ত জানেন আঘাত বা অন্য যে কোন রক্তক্ষরণ জনিত কারনে বা হিমোগ্লোবিনের অভাবে বা থ্যালাসেমিয়ার মত রক্তরোগের কারনে মানবদেহে রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন পড়ে। রক্তের এই স্বল্পতা পূরনের একমাত্র উপায় একই গ্রুপের অন্য একজনের রক্ত রোগীর শরীরে দেয়া।
আর এই দেয়ার মত রক্তটুকু দান করতে হবে আপনার আমার মত কাউকেই।
এর অন্য নাম স্বেচ্ছায় রক্তদান।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬ লক্ষ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন।
২০০১ সালের WHO তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার সংখ্যা মাত্র ১০ শতাংশ!
২০০৮ সালের হিসেবে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশ।
কিন্ত বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা খুবই নগন্য।
ভারতে স্বেচ্ছায় রক্তদাতার পরিমান ৬৫ শতাংশ।
থাইল্যান্ডে ১০০ শতাংশ!!
প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৯ কোটি ৩০ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন পড়ে।
স্বেচ্ছায় রক্তদাতা শতকরা ১০০% আছে এমন দেশের সংখ্যা ৬২ টি।
উন্নত বিশ্বে প্রতি ১০০০ জনে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে ৪৫০ জন। আর উন্নয়নশীল দেশে এর পরিমান প্রতি ১০০০ জনে মাত্র ৩ জন!!!
এটা অবশ্যই আমাদের জন্য খুব একটা আশার কথা নয়।
রক্ত পরিসঞ্চালন আর নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের মধ্যে মূল পার্থক্য নিরাপদ রক্তে কোন রক্তবাহিত রোগ (এইডস,ম্যালেরিয়া,সিফিলিস,হেপাটাইটিস-বি,সি ইত্যাদি) জীবানু নেই।
কিন্তু এই নিরাপদ রক্তের সংস্থান আমাদের হবে কোথা থেকে?
পেশাদার রক্তদাতারা প্রায় সবাই মাদকসেবী, তারা এসব রক্তবাহিত রোগে কম বেশী আক্রান্ত।
আমরা কেউই চাই না আমার প্রিয়জন আক্রান্ত হোক কোন মরনব্যাধিতে।
তাই এই নিরাপদ রক্তের যোগান দিতে হবে আমাদেরই। স্বেচ্ছায় রক্তদান করতে হবে।
১৮ থেকে ৫৭ বছর বয়সী যেকোন সুস্থ্য মানুষ, যাদের ওজন কমপক্ষে ৪৭ কেজি, তারা প্রতি ৪ মাস পরপর রক্তদান করতে পারবেন।
এতে আপনার শরীরের কোন ক্ষতি হবেনা।
প্রতি ৪ মাস পরপর এমনিই আমাদের রক্তকণিকাগুলো মারা যায়। আর আমাদের শরীরের মোট রক্তের প্রায় ১৩% শরীরে পুষ্টি ও অক্সিজেন বহনে সরাসরি কাজ করেনা। শরীরে ৫ লিটার রক্ত থাকলে তার পরিমান হয় প্রায় ৬৫০ মিলি। আর একটি রক্তের ব্যাগের ধারনক্ষমতা ৪৫০ মিলি।
আর আমরা সংগ্রহ করি ৪০০মিলি।
অতএব রক্ত দিলে ভয়ের কিছুই নাই।
প্রদানকৃত রক্তের জলীয় অংশ ২-৩ দিনের মধ্যেই পূরন হয়ে যায়।
তাই আমি আশা করব আমরা সকলেই স্বেচ্ছায় রক্তদানে এগিয়ে আসব।
বাংলাদেশে প্রথম স্বেচ্ছায় রক্তদান অনুষ্ঠান আয়োজন করে সন্ধানী, ১৯৭৮ সালের ২ রা নভেম্বর।
প্রথম স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন সন্ধানীর তৎকালীন রোগী কল্যান সম্পাদক, পরবর্তীতে প্রক্ষ্যাত স্পাইন সার্জন ইদ্রিস আলী মন্জু।
সেই থেকে বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান আন্দোলনের শুরু। পরবর্তীতে রেডক্রিসেন্ট, বাঁধন, কোয়ান্টাম, মেডিসিন ক্লাব সহ অনেক সংগঠন এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে।
সন্ধানী প্রধানত মানুষকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করে। ২০০৪ সালের দিকে রোগীর প্রয়োজনে আত্মীয় স্বজনদের দানকৃত রক্তের পরিমান ছিল শতকরা প্রায় ৪০ শতাংশ, ২০১১ তে এসে তা এখন প্রায় ৬৮ শতাংশ।
এটাও আমাদের এ আন্দোলনের এক বড় সাফল্য।
প্রিয়জনের প্রয়োজনে আপনি নিজেই রক্ত দিন। এটি সন্ধানীর একটি শ্লোগান।
একজন মানুষের জীবন বাঁচানর জন্য আপনাকে ডাক্তার হবার প্রয়োজন নেই। একটি ব্যাগ রক্তদানের মাধ্যমেই আপনি তা করতে পারেন।
স্বেচ্ছায় রক্তদাতার মত মহান একজন ব্যাক্তির প্রতি সম্মান জানাতে, এবং কার্ল ল্যান্ডস্টেইনারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে WHO ৫৮ তম বিশ্ব কনভেনশনে ১৪ জুনকে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে ঘোষনা করে।
২০০৫ সাল থেকে দিবসটি সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশেও স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমকে পূর্ণ সমর্থন দিতে, স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সম্মানিত করতে এবং স্বেচ্ছায় রক্তদান আন্দোলনে সন্ধানীর অগ্রনী ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৪ সালে, ২ রা নভেম্বরকে জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরনোত্তর চক্ষুদান দিবস হিসেবে ঘোষনা করেন তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সেই থেকে দিবসটি জাতীয়ভাবে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালের এই দিনে বাংলাদেশে প্রথম স্বেচ্ছায় রক্তদান অনুষ্ঠান আয়োজন করে সন্ধানী।
এবার ও জাতীয়ভাবে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধকারী সংগঠনগুলো দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করেছে এবং করছে।
রক্তদানের ওপর সন্ধানীর প্রকাশিত একটি ছোট্ট ই-বুক লিংক দিলাম...আশা করি আপনাদের ভাল লাগবে।
http://www.mediafire.com/?7yum7yutt894gm6
সবাই ভাল থাকবেন।
ধৈর্য সহকারে শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
ভ্রাতৃত্ব দৃঢ় হোক সহযোগিতার বন্ধনে।
ডা. মেজবাহ্ উদ্দিন আহমেদ
উপদেষ্টা
সন্ধানী কেন্দ্রীয় পরিষদ
ও
সন্ধানী সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ইউনিট।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।