স্বীয় কামনা বাসনা, ব্যক্তি সত্তা, কষ্টার্জিত সম্পদ ও প্রাণাধিক প্রিয় বস্তুকে মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির সামনে সমর্পনের উদাত্ত আহ্বান নিয়ে কুরবানীর ঈদ আমাদের সামনে উপস্থিত। কুরবানী একদিকে যেমন ত্যাগের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মহান নবী হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর ত্যাগদীপ্ত সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস আমাদের স্মৃতিপটে জাগিয়ে দেয়, তেমনি প্রতিটি মুমিন অন্তরকে ঈমানী চেতনায় করে তোলে উজ্জীবিত।
কুরবানী কী?
কুরবানী শব্দের অর্থ উৎসর্গ ও নৈকট্য অর্জন। শরীয়তের পরিভাষায় জিলহজ্ব মাসের ১০,১১ ও ১২ তারিখে নির্দিষ্ট নিয়মে নির্দিষ্ট জন্তুকে মহান আল্লাহর অধিক সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে জবাই করাকে কুরবানী বলা হয়। কুরবানী আদায় করা বিত্তবানদের উপর ওয়াজিব কিন্তু দরিদ্র ব্যক্তিও ইচ্ছা করলে কুরবানী আদায় করে ছাওয়াব অর্জন করতে পারে।
কুরবানীর ফযিলত ঃ
কুরবানীর ফযিলত সীমাহীন। মহানবী (সা.) বলেছেন, “কুরবানীর সময় আল্লাহর নিকট কুরবানীর চেয়ে অধিক প্রিয় আর কোন জিনিস নেই। কুরবানীর সময় কুরবানীই সবচেয়ে বড় ইবাদাত। কুরবানী যবাহ করার সময় প্রথম যে রক্তের ফোটা পড়ে, তা মাটি পর্যন্ত পৌছার পূর্বেই কুরবানী আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। ”
মহানবী (সা.) আরও বলেছেন, “ কুরবানীর জানোয়ারের যত পশম থাকে প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে এক একটি নেকী লেখা হয়।
” অন্যত্র বলেছেন, “তোমরা মোটা ও তাজা জন্তুর দ্বারা কুরবানী কর, কারণ উহা পোলছেরাতে তোমাদের সাথী হবে। ”
কাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব?
১০ জিলহাজ্জের ফজর হতে ১২ জিলহাজ্জের সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি যদি মালিকে নিসাব (সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা কিংবা সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সমমূল্যের নগদ অর্থ অথবা কিছু স্বর্ণ, কিছু রূপা এবং কিছু নগদ অর্থ- সব মিলিয়ে যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমান হয়, এরূপ সম্পদের অধিকারী ) হয়, তবে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। স্ত্রী ও বালেগ পুত্র, বালেগা কন্যা ধনী হলে তাদের নিজ থেকেই কুরবানী করা ওয়াজিব। কিন্তু নাবালেগ পুত্র, নাবালেগ কন্যা ধনী হলেও তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে না। স্বামী যদি স্ত্রীর পক্ষ হতে তার অনুমতিক্রমে কুরবানী আদায় করে তাহলে স্ত্রীর ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে।
মুসাফিরের উপর মুসাফিরী অবস্থায় কুরবানী ওয়াজিব হবে না।
কুরবানীর সময়সীমা
১০ জিলহাজ্জের ফজর হতে ১২ জিলহাজ্জের সূর্য অস্ত যাবার পূর্বেই কুরবানী আদায় করতে হবে। এই তিন দিনের যে দিন ইচ্ছা সে দিনই কুরবানী করা যেতে পারে। তবে ঈদের নামাজের পূর্বে কুরবানী করা ঠিক নয়। অবশ্য যে স্থানে ঈদের নামাজ ও জুমুআর নামাজ আদায় হয় না, সে স্থানে ১০ জিলহাজ্জ ফযরের পরও কুরবানী করা যেতে পারে।
রাতের বেলা বা অন্ধকার স্থানে কুরবানী না করাই উত্তম।
কুরবানীর পশু
বকরী, পাঠা, খাসী, ভেড়া, দুম্বা, গাভী, ষাড়, বলদ, মহিষ, উট এই কয় প্রকার জন্তুর দ্বারা কুরবানী করা যাবে। হরিণ, বক ইত্যাদি হালাল বন্য জন্তুর দ্বারা কুরবানী আদায় হবে না। বকরী, পাঠা, খাসী, ভেড়া, দুম্বা পূর্ণ এক বছরের কম বয়সের হলে তা দ্বারা কুরবানী আদায় হবে না। তবে ৬ মাসের বেশী বয়সের দুম্বার বাচ্চা যদি মোটা তাজা হবার কারণে ১ বছরের বাচ্চার মতো মনে হয় তবে তা দ্বারা কুরবানী করা বৈধ হবে।
গরু মহিষের বয়স কমপক্ষে দু’ বছর এবং উটের বয়স ৫ বছর হতে হবে। কুরবানীর পশু সুস্থ, সবল এবং দৃষ্টি নন্দন হতে হবে। অন্ধ, কানহীন জন্তু কিংবা একটি কানের বা লেজের এক তৃতীয়াংশ বা তদাপেক্ষা বেশী কেটে গেছে, মূল হতে ভেঙ্গে যাওয়া শিং ওয়ালা জন্তুর দ্বারা কুরবানী বৈধ হবে না। অনুরূপভাবে অতি কৃশকায়, দন্তহীন জানোয়ার, তিন পায়ে ভর দিয়ে চলা খোড়া জন্তু দ্বারা কুরবানী করা বৈধ হবে না। শিং হীন জন্তু বা শিং উঠেছে কিন্তু ভেঙ্গে গেছে, খাসী বানিয়ে দেয়া জন্তু বা জন্তুর গায়ে বা কাঁধে অল্প দাদ বা খুজলি হয়েছে এরূপ জন্তু দ্বারা কুরবানী বৈধ।
ভাল পশু ক্রয় করার পর যদি কোন কারণে কুরবানী করার অনুপযুক্ত হয়ে পরে তবে অন্য একটি পশু ক্রয় করে কুরবানী করতে হবে। মালিকে নিসাব না হলে সে সে পশু দ্বারাই কুরবানী করতে পারবে।
কুরবানী কত নামে করা যাবে?
গরু, মহিষ ও উটের ক্ষেত্রে ১ হতে ৭ নাম দেয়া যেতে পারে। অন্যান্য জন্তুর ক্ষেত্রে ১ নাম দেয়া যাবে। গরু, মহিষ ও উট ক্রয় করার পূর্বে ৭জন ভাগীদার ঠিক করে নেয়া উত্তম।
যদি কেহ ক্রয় পরবর্তী ভাগীদার পাওয়ার ইচ্ছায় একা গরু, মহিষ বা উট ক্রয় করে তবে তাও বৈধ হবে। একা করার নিয়তে পশু ক্রয় করার পর মালিকে নিসাব ব্যক্তি পরবর্তীতে কাউকে ভাগীদার হিসাবে নিলে তা বৈধ হলেও উত্তম নয়, তবে ক্রেতা গরীব হলে সে অন্যকে ভাগীদার হিসাবে নিতে পারবে না।
কুরবানীদাতাদের নিয়্যত
কুরবানী একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে হতে হবে। ভাগীদারদের কারো গোশত খাবার বা লোক দেখানোর নিয়্যত থাকলে কুরবানী গ্রহণযোগ্য হবে না। কুরবানীর ক্ষেত্রে ভাগীদার থাকলে সকলের ভাগ সমান হতে হবে।
আন্দাজে ভাগ না করে পাল্লা দ্বারা মেপে সমান সমান ভাগ করতে হবে। কম বেশী হলে কুরবানী হবে না। আকীকার নিয়্যতে কেহ ভাগীদার হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে।
কুরবানী কে করবেন?
নিজের কুরবানীর পশু নিজ হাতেই যবেহ করা মুস্তাহাব। নিজে অক্ষম হলে একজন অভিজ্ঞ আলেম দ্বারা কুরবানী করানো উচিৎ।
এ সময় নিজে সামনে দাড়িয়ে থাকা ভাল। মহিলাদের সামনে উপস্থিত না থাকাই উত্তম।
কুরবানী করার নিয়ম
কুরবানীর পশুকে কেবলা রোখ করে শুইয়ে ‘বিসমিল্লাহে আল্লাহু আকবর’ বলে যবেহ করতে হবে। কুরবানী করার সময় মুখে নিয়্যত করা ও দু’আ উচ্চারণ করা জরুরী নয়। স্মরণ থাকলে কুরবানীর জন্য নির্ধারিত দু’আ পড়া যেতে পারে।
ক্রয়কৃত জন্তুর বাচ্চা হলে ঐ বাচ্চাকে কুরবানী করে গরীব মিসকিনকে দিয়ে দিতে হবে, নিজে খাওয়া যাবে না। বাচ্চাকে যবেহ না করে গরীবকে দান করে দেয়া যেতে পারে।
হারিয়ে যাওয়া পশু
কুরবানীর জীব হারিয়ে গেলে তৎপরিবর্তে অন্য পশু ক্রয় করার পর প্রথম পশুটি পাওয়া গেলে ক্রেতা মালিকে নিছাব হলে তার জন্য যে কোন একটি কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। যদি মালিকে নিছাব না হয় তবে উভয়টি কুরবানী করা ওয়াজিব হবে। একটি কুরবানী করার পর অপরটি ১২ জিলহাজ্জের পর পাওয়া গেলে গরীব লোকটি সেই পশুটিকে ছদকা করে দেবে।
গোশত ভক্ষণ ও বণ্টন
কুরবানীর পশুর গোশত পরিবার পরিজন ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে তৃপ্তি সহকারে ভক্ষণ করা যাবে। গোশত বণ্টণের মুস্তাহাব নিয়ম হচ্ছে তিন ভাগ করে এক ভাগ গরীবদের, এক ভাগ আত্মীয় স্বজন ও এক ভাগ নিজে রেখে দেওয়া। নিজের প্রয়োজনে গরীবদের দান নাু করলেও কুরবানী আদায় হয়ে যাবে।
কুরবানীর চামড়া
কুরবানীর চামড়ার প্রকৃত হকদার হচ্ছে এতিম-মিছকীন তথা গরীবরা। যদি কেহ তা বিক্রি করে তবে বিক্রিত অর্থ সম্পূর্ণটুকুই দান করে দিতে হবে, নিজের কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
পশু যবেহের বিনিময় কিংবা বানানোর পারিশ্রমিক চামড়া বিক্রির পয়সা বা গোশত দ্বারা দেয়া যাবে না। মসজিদ নির্মাণ, মেরামত কিংবা অন্য কোন নেক কাজে এই অর্থ দান করা যাবে না।
মৃত ব্যক্তির জন্য কুরবানী
মৃত্যুর পূর্বে কেহ কুরবানীর জন্য অছিয়ত করে গেলে তার অংশের সমস্ত গোশত দান করে দেয়া ওয়াজিব। তবে স্বীয় ইচ্ছায় মৃতকে সাওয়াব পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে কুরবানী করা হলে ঐ অংশের গোশত ইচ্ছা অনুযায়ী ভক্ষনও করতে পারবে দানও করতে পারবে। ওয়াজিব হওয়া ব্যক্তি যদি স্বীয় নাম বাদ দিয়ে মৃতব্যক্তি বা অন্য কারো নামে কুরবানী করেন তবে তিনি ওয়াজিব ভঙ্গের দায়ে গোনাহগার হবেন ।
শেষ কথা
শরীয়ত নির্দেশিত পথে যথাযথভাবে কুরবানী আদায়ের সাথে সত্যের অনুসরণ, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ, আত্মনিবেদন, ধৈর্য ইত্যাদি জড়িত রয়েছে। এতে আত্মার উপর প্রভাব সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর নাম নেয়ার সাথে সাথে আত্মোৎসর্গের অনুভূতি সৃষ্টি হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।