জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট বুঝাতে বলতে হয়, সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কোথা? উচ্চ শিক্ষার প্রসারে ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাবে ১৯৯২ সালে ৪৫০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে যাত্রা শুরু করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ রয়েছে ২ হাজার ২১৬টি। প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে পারে প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থী। একসাথে প্রায় ১২ লাখ শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। এ বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উচ্চশিক্ষার শতকরা ৮০ ভাগ দায়িত্ব পালন করে থাকে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ২০১২ সালে যাদের অনার্স ফাইনাল রেজাল্ট দিয়েছে তাদের প্রত্যেকের সনদ পত্রে লিখা হয়েছে যে তারা ২০০৯ সালে পাস করেছে!!! এই তিন বছর নষ্টের দায় কার? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট একটি গুরুতর সমস্যা। এখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করতে একজন শিক্ষার্থীর জীবনের মূল্যবান ৭-৮টি বছর চলে যায়। ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া এক শিক্ষার্থীর পাঠ ২০১২ সালেও শেষ হয়নি। ভর্তি পরীক্ষা, ক্লাস, পরীক্ষা, ফল প্রকাশ কোনো কিছুই সময়মতো হয় না। এসবের কারণে শিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকে না।
প্রচুর শিক্ষার্থী এসময় ঝড়ে যায়। শিক্ষার্থীরা চরম হতাশায় ভোগেন। অনেকে বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত হয়। এসময়টাতে আয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ফটকা কারবারে জড়িয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। এমএলএম, শেয়ার বাজার ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করেন।
আবার অল্প বয়সেই এঁরা সর্বস্ব হারান। অনেকে অসামাজিক কর্মকান্ডের নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।
নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির বেড়াজালে বন্দী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় প্রতিটি উপাচার্যের বিরুদ্ধেই ছিলো দূর্নীতির হাজারো অভিযোগ। কিন্তু কোনোটিরই সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি।
নিয়োগে অনিয়ম, দলীয়করণ সহ চলছে চরম নৈরাজ্য। হাইকোর্টের রায়ে সর্বশেষ চারদলীয় জোট সরকারের আমলসহ পরবর্তীতে সকল নিয়োগকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার সে ঘোষণার আংশিক বাস্তবায়ন করে নিজ দলীয়দের চাকরিচ্যুত করেনি।
পরীক্ষার হলের অভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোতে ডিগ্রী, অনার্স, মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরাও শ্রেণিকক্ষ সংকটে ভোগে। ক্লাস হয় না বললেই চলে।
বছরে সব মিলিয়ে ৮০-৯০ দিন মাত্র ক্লাস হয়। এ কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার উপর নির্ভর করতে হয়।
কলেজগুলোতে ভর্তি, শিক্ষার্থী নিবন্ধন, কোর্স কারিকুলাম নির্ধারণ, পরীক্ষা গ্রহণ ও সনদপত্র প্রদানসহ সব কার্যক্রম এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। অথচ এসব কলেজে শিক্ষার অন্যতম উপকরণ যেমন, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের বদলি, অধ্যক্ষ নিয়োগ, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ কোনো কিছুই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজগুলোর মধ্যে সরকারি কলেজ রয়েছে মাত্র ২৫৩টি।
বাকি কলেজগুলো বেসরকারি অধিভুক্ত কলেজ। সরকারি কলেজের শিক্ষক নিয়োগ হয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরিচালিত বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে। এসব শিক্ষকের বদলি নিয়ন্ত্রণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। অন্যদিকে বেসরকারি কলেজের শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামো নির্মাণসহ সার্বিক পরিচালনার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কলেজ পরিচালনা পর্ষদের (গভর্নিং বডি)। অবশ্য শিক্ষক নিয়োগ কমিটিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত একজন বিষয় বিশেষজ্ঞ (সাবজেক্ট স্পেশালিস্ট) থাকেন মাত্র।
তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার ক্ষমতা গৌণ।
বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এমন কোনো কলেজ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে শিক্ষক সংকট নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সংক্রান্ত সংশোধন রেগুলেশন ২০০০-এর ৩(১)-এ বলা আছে, 'কোনো কলেজে কোনো বিষয়ে ডিগ্রি (পাস ও অনার্স) এবং স্নাতকোত্তর কোর্স থাকলে উক্ত বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগুলেশন অনুযায়ী শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ১২ জন শিক্ষক/শিক্ষিকা কর্মরত থাকতে হবে। ' কোনো কলেজই এ নিয়মটি মানছে না। শহরের কলেজগুলোর চাইতে গ্রাম ও মফস্বলের কলেজগুলোর দশা আরো করুন।
সেখানে প্রতি বিভাগে ৩-৪ জন শিক্ষক দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে কোনোভাবে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষকদের বেতন ভাতা নিয়ে রয়েছে অসন্তোষ।
শিক্ষার্থীদের আবাসন সঙ্কট চরম। বেশিরভাগ কলেজের আবাসন ব্যবস্থা নেই। যে কয়টা ক্যাম্পাসে আছে সেগুলো আবার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন কর্তৃক দখল হয়ে আছে।
এছাড়া কলেজগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা অবরুদ্ধ। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়াতে বিভিন্ন কলেজ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন কর্তৃক দখল হয়ে আছে। ছাত্রদের হাজারো সমস্যা থাকলেও এ সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের তাতে কোনো মাথা ব্যথা নেই। এরা মূলত নিজ সংগঠনের নাম ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা গ্রহণেই ব্যস্ত। অন্য বাম সংগঠনগুলো আন্দোলন করতে চাইলে উল্টো তাদের উপর বিভিন্ন হামলা-হুমকি-ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন এখন ধ্বংসের মুখে। শিক্ষার্থীদের অবস্থা “ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে”র মত। প্রতিটি সরকার এই সত্য শিকার করে এর পূনর্গঠনের কথা বললেও উল্টো নিজেরা বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত করেই দায়িত্ব ছাড়েন।
লিখেছেন - তৌহিদ টিপু
তৌহিদ টিপুর পরিচয় ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।