বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ সাধকানাং হিতার্থায়ৈ ব্রহ্মণে রূপকল্পনা ...
পূজা করা হয় ‘চৈতন্যময়ী’ প্রকৃতিকে। কেন করা হয়? চৈতন্যময়ী প্রকৃতিকে তুষ্ঠ করতেই পূজা করা হয়; যাতে পূজারী/ভক্তের জীবন হয়ে ওঠে আনন্দময়, হয়ে ওঠে কল্যাণময় । কিন্তু, প্রকৃতিকে কেন চৈতন্যময়ী বলে মনে করা হয় ? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা একটু পরে খুঁজব।
তার আগে বলি যে, বাংলায় ‘পূজার’ ধারণাটি অতি সুপ্রাচীন। প্রায় তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন বাংলায় ‘পূজার’ প্রাথমিক ধারণার উন্মষ বলে মনে করা হয়। কেননা, ‘পূজা’ শব্দটি কিন্তু বৈদিক আর্য দের সংস্কৃত ভাষার শব্দ নয়; ‘পূজা’ শব্দটি অস্ট্রিক ভাষার একটি শব্দ। সুপ্রাচীন বাংলার মানুষ কথা বলত ওই অস্ট্রিক ভাষায়।
সেই প্রাগৈতিহাসিক সময়ে সুপ্রাচীন বাংলায় বাস করত কিরাত ও আদি- অস্ট্রাল জাতি ।
তবে সুপ্রাচীন বঙ্গে কিরাতদের সংখ্যা ছিল কম; এদের চেহারা ছিল মঙ্গোলয়েডদের মত এবং আদি-অস্ট্রালদের সংখ্যা ছিল বেশি; এদের চেহারা ছিল অষ্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীদের মতন! এরাই ছিল বাঙালির পূর্বপুরুষ; এরাই কথা বলত ‘অষ্ট্রিক’ ভাষায়। ‘পূজা’ শব্দটি সুপ্রাচীন বাংলায় প্রচলিত এই অস্ট্রিক ভাষারই শব্দ। এরাই প্রকৃতিকে ‘চৈতন্যময়ী’ মনে করত। ‘চৈতন্যময়ী’ প্রকৃতিকে পূজা করত।
তা হলে প্রাচীন বাংলার অষ্ট্রিকভাষী কিরাত ও আদি- অস্ট্রাল জাতি ‘চৈতন্যময়ী’ প্রকৃতিকে পূজা করলেও বর্তমানে কালীপূজা এবং শারদীয় দূর্গাপূজার মন্ত্রপাঠ এবং অন্যান্য কৃত্যের ক্ষেত্রে কেন সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করা হয়? বিশেষ করে আমরা দূর্গাপূজার সময় দূর্গাকে ‘বিদ্যা রূপেণ সংস্থিতা’,কিংবা ‘জ্ঞান রূপের সংস্থিতা’ এসব অভিধায় ভূষিতা হতে শুনি।
এর কারণ কী।
খুলে বলছি। পন্ডিতদের অনুমান, বৈদিক আর্যরা প্রাচীন বাংলায় এসেছিল পশ্চিম দিক থেকে । সময়টা? ৮০০ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বের মধ্যে। কিরাত ও আদি অস্ট্রালরা অরণ্যচারী শিকারী ছিল বলেই বৈদিক আর্যরা তাদের বলত ‘নিষাদ’ ( এর মানে ‘ব্যাধ’ বা ‘শিকারী’) জাতি ।
তারপর কি হল? আর্যদের বৈদিক ধর্মীয় বিশ্বাস নিষাদরা গ্রহন করল। এর মানে প্রাচীন বাংলার নিষাদ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-আচরণ ইত্যাদি বদলে গিয়েছিল। বৈদিক ধর্মশাস্ত্র সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিল বলে এবং সেই প্রাচীন সময়ে জীবনের প্রতিটি স্তরেই ধর্মীয় বিধিনিষেধ প্রবল ছিল বলেই প্রাচীন বাংলার নিষাদরা তাদের নিজস্ব ভাষার বদলে সংস্কত ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
অবশ্য আর্যরাও অনার্য নিষাদদের ধর্মীয় চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়েছির।
অনার্য নিষাদদের আদিম ও স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মবিশ্বাস ছিল সাংখ্য, তন্ত্র এবং যোগ।
আর্যরা এই তিনটি মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন:
বৈদিক ভাষায় দেশী শব্দ যেমন গৃহীত হয়েছে, তেমনি যোগপদ্ধতিও হয়েছে প্রবিষ্ট। বস্তুত এই দ্বিবিধ প্রভাব ঋগে¦দেও সুপ্রকট। তা ছাড়া দেশী জন্মান্তরবাদ, প্রতিমা পূজা, নারী, পশু ও বৃক্ষ-দেবতার স্বীকৃতি, মন্দিরোপসনা,ধ্যান, কর্মবাদ, মায়াবাদ এবং প্রেততত্ত্ব দেশী মানস প্রসূত। কাজেই যোগ ও তন্ত্র সর্ব ভারতীয় হলেও অষ্ট্রিক,নিষাদ ও ভোট -চীনা কিরাত অধ্যূষিত বাঙলা-আসাম-নেপাল অঞ্চলেই হয়েছিল এসবের বিশেষ বিকাশ।
যোগীর দেহশুদ্ধি এবং তান্ত্রিকের ভূতশুদ্ধি মূলত অভিন্ন ও একই লক্ষ্যে নিয়োজিত। বহু ও বিভিন্ন মননের ফলে, কালে ক্রমবিকাশের ধারায় সাংখ্য, যোগ এবং তন্ত্র -তিনটে স্বতন্ত্র দর্শন ও তত্ত্বরূপে প্রতিষ্ঠা পায়। এবং প্রাচীন ভারতের আর আর ঐতিহ্যের মতো এগুলি আর্যশাস্ত্র ও দর্শনের মর্যাদা লাভ করে। (বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব; পৃষ্ঠা,৪১)
আর এভাবেই বৈদিক আর্যদের সংস্কৃত ভাষায় নিষাদদের মাতৃভাষার শব্দও গৃহিত হয়েছিল। যেমন: ‘পূজা’ শব্দটি।
‘পূজা’ শব্দের অর্থ-শ্রদ্ধা। এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এরকম।
(১ ) প্রাকৃতিক শক্তিকে ‘চৈতন্যময়ী’ বলে মনে করা;
(২) সেই চৈতন্যময়ী শক্তিকে নিষাদের মানবীয় উপলব্দির সীমানায় নিয়ে আসা;
(৩) সেই চৈতন্যময়ী শক্তির সঙ্গে মাতাপিতার সর্ম্পক স্থাপন করা; এবং
(৪) সেই চৈতন্যময়ী শক্তির পূজা করা।
এই ছিল প্রাচীন বাংলার নিষাদদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং কৃত্য (রিচুয়াল)। তবে পূজা করার আরেকটি কারণ হল: ভক্তি ।
এই বিষয়টি সহজেই বোঝা যায়। পূজারীর হৃদয়ে ভক্তি না এলে সে পূজারই-বা কি অর্থ? এই কথাটা আমরা সহজেই উপলব্দি করতে পারি। ভক্তির উন্মেষ যে সুপ্রাচীন বাংলার নিষাদসমাজেই হয়ে এটি আমরা অনুমান করতে পারি।
কিন্তু, নিষাদরা প্রকৃতিকে কেন ‘চৈতন্যময়ী’ বলে মনে করেছিল ?
নিষাদদের কৌম (গোত্রীয়) সমাজটির গড়ন ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সমাজবিকাশের অনিবার্য নিয়মে প্রথমে নিষাদসমাজ ছিল শিকারী ও খাদ্যসংগ্রকারী।
তারা বাংলার প্রাচীন অরণ্যে ফলমূল কুড়োত। পরে হাতিয়ারের উন্নতি হল; তারা বনভুমি কেটে জমি চাষ করতে থাকে। এভাবে ওদের কৃষিজীবনে উত্তরণ ঘটে । তবে অনুন্নত হাতিয়ারের (টুলস) কারণে কৃষিজীবন ছিল ভারি অনিশ্চিত। ওদিকে গোত্রের জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল।
কাজেই প্রকৃতির কৃপার ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় কী! সেই আদিম নিষাদসমাজটি মাতৃতান্ত্রিক ছিল বলেই প্রকৃতিকে তারা ‘চৈতন্যময়ী’ ভেবেছিল। তারা নারীকে জগতের আদি কারণ বলেও ভাবল । কাজেই অদৃশ্য প্রকৃতিক শক্তিটি ওদের আদিম মনে একজন দেবী হিসেবে প্রকাশ পেলেন, দেবতা হিসেবে নন। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে আর্যরা ভারতবর্ষে আসার পূর্বে শিব ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রধানতম অনার্য দেবতা। একইভাবে, প্রাচীন বাংলাতেও আর্যরা আসার পূর্বে শিব ছিলেন প্রধানতম অনার্য দেবতা।
যে কারণে প্রকৃতিকে দেবী কল্পনা করলেও শিব এর গুরুত্ব কখনওই হ্রাস পায়নি। আজও ...
সে যাই হোক। বাঙালিসমাজে পরবর্তীকালে দেবী ধারণার স্বতঃস্ফূর্ত বিবর্তন দেখতে পাই, যে দেবী ধারণার উন্মেষ ঘটেছিল সুপ্রাচীন বাংলায় নিষাদদের মাতৃতান্ত্রিক ধর্মীয় ভাবনায়। এই দেবী বাঙালিসমাজে 'শক্তি' দেবী নামে পরিচিতা। যারা শক্তি দেবীর উপাসনা করেন তারাই 'শাক্ত' বলে পরিচিত।
ধর্মতত্ত্বের ভাষায়: শাক্ত-তান্ত্রিক। শক্তিদেবী অবশ্য বাঙালিসমাজে আরও নানা নামে পরিচিতা। যেমন: কালী, কামেশ্বরী, ভীমাদেবী, জগদ্বাত্রী, গন্ধেশ্বরী, অন্নপূর্ণা, বাসুলি, বিপদনাশিনী, সন্তোষীমাতা এবং দূর্গা।
এই যে প্রকৃতিকে দেবীরূপে ভজনা- এই বিশ্বাস, সাধনা, দর্শন ও আরাধনার সমস্ত প্রক্রিয়াকে আমরা একত্রে বলতে পারি- ‘তন্ত্র’। যে তান্ত্রিক বিশ্বাসের উন্মেষ হয়েছিল নিষাদদের ধর্মীয় চেতনায় ।
কাজেই তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলায়। ( দেখুন; তন্ত্র: দুলাল ভৌমিক। বাংলাপিডিয়া)
আলোচনার এ পর্যায়ে এবার একবার মূল প্রশ্নে ফিরে যাওয়া যাক। পূজা কাকে করা হয়? এবং কেন করা হয়? পূজা করা হয় ‘চৈতন্যময়ী’ প্রকৃতিকে। কেন করা হয়? চৈতন্যময়ী প্রকৃতিকে তুষ্ঠ করতেই পূজা করা হয়; যাতে পূজারী/ভক্তের জীবন আনন্দময়, কল্যাণময় হয়ে ওঠে।
তন্ত্র হচ্ছে দর্শন বা তত্ত্ব। আর পূজা হচ্ছে পদ্ধতি। পূজার উপচার বা উপকরণ নিষাদরা তাদের নিজস্ব পরিবেশ থেকেই সংগ্রহ করেছিল। পরবর্তীকালে বাংলায় তাদের এই ধারণার (প্রকৃতি কে ‘চৈতন্যময়ী’ বলে মনে করে দেবীরূপে ভজনা করা) বিবর্তিত হয়েছিল। এবং এই নারীকেন্দ্রিক তান্ত্রিক ধারণাটি পল্লবিত হয়েছিল।
তন্ত্র সর্ম্পকে একটি ইউরোপিয় সূত্র লিখেছে,
The word "tantra" is derived from the combination of two words "tattva" and "mantra". "Tattva" means the science of cosmic principles, while "mantra" refers to the science of mystic sound and vibrations. Tantra therefore is the application of cosmic sciences with a view to attain spiritual ascendancy. In another sense, tantra also means the scripture by which the light of knowledge is spread .
তন্ত্রের প্রধান একটি সিদ্ধান্তই হল এই যে প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করা। কিন্তু, শক্তি কি? বিশ্বজগতে সবই তো শক্তির সমাহার। যে শক্তিকে বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়। আধুনিক সভ্যতা এই মূলতত্ত্বের ওপরই প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃতির সূত্র আবিস্কার করে এই শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা যৌক্তিক এই প্রশ্নও তো আজকাল উঠছে ।
এই দৃষ্টিভঙ্গি হটকারী কিনা, পরিবেশ বিপর্যয়ের মূলে এই দর্শন সক্রিয় কিনা- এসব প্রশ্নও নিয়েও তো আমরা আজ উদ্বিগ্ন।
তো, প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে তন্ত্রের সিদ্ধান্ত কি?
তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না। তার কারণ, তন্ত্র প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী জেনেছে, মা বলে জেনেছে, মায়ের দেবীপ্রতিমা কল্পনা করেছে; দেবী মা (প্রাকৃতি কে) কে একজন তান্ত্রিক নিষ্ঠাভরে ভজনা করতে চায়, আরাধনা করতে চায়, পূজা করতে চায়। পাশাপাশি একজন তান্ত্রিক মনে করেন, একজন ভক্ত চৈতন্যময়ী শক্তির অনুগত থাকলে চৈতন্যময়ী শক্তির কৃপায় তার অশেষ কল্যাণ সাধিত হতে পারে।
এই হল বিজ্ঞান এবং তন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য।
চৈতন্যময়ী প্রকৃতিরূপী নারীবাদী তন্ত্রের দেবী দূর্গা- কালী- বাসুলী - তারা- শিবানী। কিন্তু তন্ত্রের কেন্দ্রে রয়েছেন (আমি আগেই একবার ইঙ্গিত দিয়েছি) অনার্য দেবতা শিব। তন্ত্রমতে শিব তাঁর শক্তি পেয়েছে কালীর কাছ থেকে। আবার শিব- এর রয়েছে পৃথক নিজস্ব শক্তি। তন্ত্রমতে পুরুষ শক্তিলাভ করে নারীশক্তি থেকে।
শিব শক্তি লাভ করেছেন তাঁর নারীশক্তির প্রকাশ- গৌড়ীর শক্তি থেকে। তবে শিবের নিজস্ব শক্তিও স্বীকৃত। তন্ত্রসাধনার মূল উদ্দেশ্যই হল- (প্রাকৃতিক) শক্তি দেবীর সাধনা করে "শিবত্ব" লাভ তথা শক্তিমান হওয়া।
এখানেই বলে রাখি যে- প্রাচীন ও মধ্যযুগের বঙ্গবাসী পরবর্তীকালে নগর গড়ে তুললেও সে তার আদিম পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য কখনও পরিত্যাগ করেনি কিংবা বিস্মৃত হয়নি। এই বাঙালি মননের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
নগরেও পূজা হয়েছে। উপচার হল পূজার উপকরণ। এমন কী, পূজার উপচারেও দেখা যায় নিষাদ উপকরণ। আপত চাল, তিল, জল, দুধ, কুশাগ্র, দই, যব, শ্বেতসরিষা, চন্দন, বিল্বপত্র বা বেলপাতা, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, ডালিম, বেল, অশোক, মানকচু, ধান, কলাগাছ, গম, মাষকলাই, তিসি। এ সবই প্রাচীন বাংলার লোকজসমাজের কৃষিপণ্য।
এখানেই বলে রাখি যে প্রাচীন বাংলার নিষাদসমাজের তান্ত্রিক বিশ্বাস ও বাহিরাগত (আর্যরা প্রাচীন বাংলার বাইরে থেকে এসেছিল বলে) আর্যবৈদিক মতের কিছু পার্থক্য রয়েছে। বহিরাগত আর্যদের বৈদিক ধর্মবিশ্বাসটি মূলত পুরুষতান্ত্রিক; পক্ষান্তরে বাংলার অনার্যদের তান্ত্রিক মত মাতৃতান্ত্রিক। তা ছাড়া
আর্যদের বৈদিক মত হল ঋষিজ: তার মানে দার্শনিক বা ফিলোফফিক্যাল। এ কারণে মানবকল্যাণে এর ভূমিকা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। অন্যদিকে তান্ত্রিকমত মুণিজ বা বিজ্ঞান ভিত্তিক হওয়ায় জগৎসংসারে জীবজগতে এর প্রভাব প্রত্যক্ষ।
সনাতনধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিধান্ত হল- দর্শনের সামগ্রিক দৃষ্টি এবং তন্ত্রমতের খন্ডিত বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি একত্রিত হলেই জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়। এ কারণেই বেদের যজ্ঞ এবং তন্ত্রের পূজা সম্মিলিত ভাবে সনাতনধর্মকে একটি দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। (দেখুন;রণজিৎ কর; সনাতনধর্ম: মত ও মতান্তর। )
তন্ত্র থেকে তত্ত্ব। তন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বা উদ্দেশ্য হল তত্ত্বের সিদ্ধান্তকে জীবনের কর্মক্ষেত্রে রূপদান করা।
কাজেই তন্ত্রের প্রচারের মাধ্যম আচরণ বা থিউরি নয়, প্র্যাকটিস। তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ। তন্ত্রের উদ্ভব প্রাচীন বাংলার মাতৃতান্ত্রিক নিষাদসমাজে হয়েছিল বলেই এমনটাই ভাবা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল।
কিন্তু, তন্ত্রমতে কেন নারী জগতের আদি কারণ?
ঈশ্বর নিরাকার। রূপহীন।
যে কারণে প্রাচীন বৈদিক আর্যরা ঈশ্বরের রূপ বর্ণনা করেছেন এভাবে-
‘রূপংরূপ বিবর্জিতস্য ভবতো ধ্যানেন যদবর্ণিতং। ’
এর মানে হল- ‘হে রূপহীন ঈশ্বর! ধ্যানে তোমার রূপ বর্ণনা করেছি। ’
তন্ত্রমতে নারী জগতের আদি কারণ এই জন্য যে এই নিরাকার রূপহীন ইশ্বরকে যখন নারী ভাবা হয় তখন ঈশ্বরের মাহাত্ম ক্ষুন্ন হয় না। কাজেই ভক্তের মানসিক প্রবনার ওপরই মাতৃমূর্তির কল্পনা। যে কারণে বলা হয়েছে -
‘সাধকানাং হিতার্থায়ৈ ব্রহ্মণে রূপকল্পনা’
এর মানে হল- ‘সাধকের হিতের জন্য ঈশ্বরের রূপ কল্পনা করা হয়েছে।
’
সুপ্রাচীন বাংলার গুরুত্বপূর্ন এক অনার্য ধর্মীয় বিশ্বাস হল- যোগ ( যাকে আমরা ইয়োগা বলে জানি)। পূজার সঙ্গে যোগ-এর অত্যন্ত ঘনিষ্ট সর্ম্পক রয়েছে। এই বিষয়টিও আমাদের জানতে হবে। নইলে পূজা কেন করা হয়, এবং কাকে করা হয় এসব নিগুঢ় বিষয় পরিস্কার হবে না ।
আমরা জেনেছি যে তন্ত্র নারীবাদী হলেও এর কেন্দ্রে রয়েছেন শিব ; যিনি প্রধানতম অনার্য দেবতা।
এবং তন্ত্রে নারীকে জগতের আদিকারণ মনে করা হলেও বিশ্বপ্রকৃতির সমস্ত শক্তির উৎস হলেন শিব। আর এই কারণেই তো, কাজী নজরুল ইসলাম আহিরি ভৈরব রাগে রচিত তাঁর বিখ্যাত ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ গানটিতে শিব কে ‘ত্রিভূনের পতি’ বলে উল্লেখ করেছেন-
‘নবমেঘ চন্দনে ঢাকি অঙ্গজ্যোতি/
প্রিয় হয়ে দেখা দাও ত্রিভূবন পতি
বিষাণ ফেলিয়া হও বাঁশরীধারী ...
উত্তর ভারতে শিব সম্বন্ধে বলা হয়েছে-‘সত্যম’,‘শিবম’,‘সুন্দরম’। এ সমস্ত কারণে যোগ- এর উদ্দেশ্যই হল ‘শিবত্ব’ অর্জন। মধ্যযুগের বাংলায় চন্দ্রদ্বীপবাসী (বরিশালের) মীননাথ শিবপন্থি নাথধর্ম প্রচার করেছিলেন । মীননাথ-এর শিষ্যদের বলা হয় নাথযোগী।
নাথযোগীরা সাহিত্যকে আশ্রয় করে তাদের ধর্ম-দর্শন প্রচার করেছিলেন। এদের লেখা কাব্য বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রতœ বলে বিবেচিত। নাথযোগীদের লেখা ‘গোরক্ষ বিজয়’-এ লেখা রয়েছে-
‘মুন্ডে আর হাড়ে তুমি কেনে পৈর মালা
ঝলমল করে গায়ে ভস্ম ঝুলি ছালা।
পুনরপি যোগী হৈব কর্ণে কড়ি দিয়া। ’
এই চারটি চরণে আসলে একজন যোগীর ছবিই আঁকা হয়েছে।
যোগীর ছবিটি আসলে অনার্য শিবেরই ছবি। এবং কড়ি জিনিসটা অস্ট্রিকভাষী নিষাদ/ কিরাতের উপচার (উপকরণ)। এবার তাহলে বলি যোগ- এর সঙ্গে চৈতন্যময়ী মা-প্রকৃতির কী সর্ম্পক। যোগীগণ শরীরের চৈতন্যকেই প্রাণশক্তি বা আত্মা বলে মনে করতেন। দেহের বাইরে চৈতন্য যেহেতু সম্ভবপর নয়; সুতরাং, শরীর সম্বন্ধেই অনার্য যোগীঋষিরা সুপ্রাচীনকালে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন।
(পাঠক, এই সুপ্রাচীন ভাবনাকে বাউল দর্শনেরও ভিত্তি বলে মনে করতে পারেন কিন্তু) দেহকে বোঝা ও একে নিয়ন্ত্রন করে ইচ্ছে মতন পরিচালিত করা যোগসাধনার অন্যতম লক্ষ্য। ‘কায়া’ মানে শরীর। ‘কায়সাধন’ মানে শরীরের সাধনা। ‘ কায়সাধন অতি প্রাচীন দেশী শাস্ত্র, তত্ত্ব ও পদ্ধতি। ’(বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব: আহমদ শরীফ; পৃষ্ঠা ৪৩) এ ছাড়া শরীর বিষয়ক বাঙালির ধর্মতত্ত্বের একটি বড় সিদ্ধান্ত এই -
‘ব্রহ্মান্ডে য গুণাঃ সন্তি তে তিষ্টন্তি কলেবরে’।
এর মানে, ‘যা আছে ভান্ডে (মানে শরীরে/মানবদেহে) তাই আছে বিশ্বভ্রহ্মান্ডে বা ইউনিভার্সে । ’ ড.আহমদ শরীফ একবার মন্তব্য করেছিলেন: ‘বাঙালির ধর্মতত্ত্বে পাপ-পুন্যের কথা বেশি নেই। অনেক বেশি রয়েছে জীবন রহস্য জানবার বুঝবার প্রয়াস। ’ (বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব: আহমদ শরীফ পৃষ্ঠা; ৪৮) পন্ডিতের এ কথা একালেও যেমন সত্য সেই আদিম নিষাদ-যুগেও সত্য।
... বলেছিলাম তন্ত্রের একটি বিরাট সিদ্ধান্ত হল শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করা।
সেই চৈতন্যময়ী শক্তি কি কেবল প্রকৃতিতেই বিরাজ করে?
না। চৈতন্যময়ী শক্তি সর্বত্র বিরাজমান।
মানবদেহে?
অবশ্যই।
প্রাচীন বাংলার বাঙালি যোগীগণ শরীরের ভিতর যে চৈতন্যকেই প্রাণশক্তি বা আত্মা মনে করেন তিনিই সেই চৈতন্যময়ী । এই মানবচৈতন্য সেই শক্তিরই এক রূপ।
দেহের বাইরে চৈতন্য সম্ভব নয় বলেই জীবন রহস্য জানবার বুঝবার প্রয়াস প্রাচীন বাংলার বাঙালি যোগীগণ শরীর সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়েছে এবং এভাবে সুপ্রাচীন কালেই বাউল দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। ছান্দোগ্য উপনিষদেও এর সমর্থন
‘এই পৃথিবীতে দেহেরই পূজা করিবে, দেহেরই পরিচর্যা করিবে। দেহকে মহীয়ান করিলে এবং দেহের পরিচর্যা করিলেই ইহলোক ও পরলোক-এই উভয়লোকই লাভ করা যায়। (বিরোচন। ৮/৮/৪)
এবার বলি তন্ত্রমতে পূজার আধার ১১ টি।
এসব আধার পূজারীর দেহের সঙ্গে সর্ম্পকযুক্ত। দেবীপ্রতিমা, প্রজ্জ্বলিত অগ্নি, পাত্রস্থিত জল, চিহ্নিত যন্ত্র, মন্দির পরিচায়ক ছবি অংকিত বিশেষ চিহ্ন (সাত্ত্বিক চিহ্ন, ঔঁ কার চিহ্ন) মস্তক শিরোদেশ এবং পূজারীর হৃদয়।
পূজায় দুটি বিষয় রয়েছে। এক মন্ত্র ও উপচার। একটি অন্তরের দিক ও অন্যটি বাহ্যিক দিক।
মন্ত্র অন্তরের দিক, উপচার বাহ্যিক দিক। উপচার হল পূজার উপকরণ। আশ্চর্য এই যে -পূজার উপচারও দেহের সঙ্গে গভীরভাবে সর্ম্পকিত। পূজায় প্রধান হল পঞ্চোপচার। যেমন সুগন্ধ দ্রব্য, পানীয়, প্রদীপ, পাখার বাতাস ও ফুল।
এসবের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য। আসলে পঞ্চোপচার হল পূজারী দেহের প্রাণের মনের বেদনের ও অহং এর প্রতীক যা দেবীর নিকট নিবেদন করা হয়। এর মানে পূজারী তার বস্তুময় জীবনক্ষেত্র, প্রাণময় জীবনক্ষেত্র, মনোময় জীবনক্ষেত্র, বোধময় জীবনক্ষেত্র এবং আনন্দময় জীবনক্ষেত্র প্রতীক হিসেবে দেবীর কাছে নিবেদন করলেন। এর নামই আত্ম নিবেদন। এভাবে উপাসক মানুষ তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করল।
এ পোস্টের গোড়ায় এই দুটি প্রশ্ন ছিল যে পূজা কাকে করা হয়? পূজা কেন করা হয়?
বাঙালি হিন্দু তান্ত্রিক বলেই পূজা করে; বাঙালি হিন্দুর ঐতিহ্যে যোগসাধনার ভূমিকা রয়েছে বলেই তারা পূজা করে। বাঙালি হিন্দু তান্ত্রিক বলেই প্রাকৃতিক শক্তিকে চৈতন্যময়ী মনে করে। এবং সেই চৈতন্যময়ী শক্তিকে বাঙালি হিন্দুর মানবীয় উপলব্দির সীমানায় নিয়ে এসে সেই চৈতন্যময়ী শক্তির সঙ্গে মাতাপিতার সর্ম্পক স্থাপন করে, সেই চৈতন্যময়ী শক্তিকে দেবীরূপে কল্পনা করে পূজা করে। অষ্ট্রিক ভাষার শব্দ ‘পূজা’ অর্থ-শ্রদ্ধা ...
এই পোস্টটির তথ্যের উৎস:
আহমদ শরীফ; বাঙলা বাঙালি ও বাঙালীত্ব।
নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য; ধর্ম ও সংস্কৃতি; প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট
ড. এম আর দেবনাথ; সিন্ধু থেকে হিন্দু ।
রণজিৎ কর; সনাতনধর্ম: মত ও মতান্তর।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।