আমি একজন পর্যটন কর্মী। বেড়াতে, বেড়ানোর উৎসাহ দিতে এবং বেড়ানোর আয়োজন করতে ভালোবাসি।
‘হামলার শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তাদের নামে মামলাও হয়েছে। তবে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেনি।
এখন তারা উল্টো হুমকি দিচ্ছে। তারা বলেছে, প্রথমবার মূর্তি ভেঙেছে। এবার সব চুরমার করে ফেলবে। ’ উখিয়া উপজেলার বিহারের ভান্তেদের সাথে আলাপকালে তারা এমনটি জানান।
উখিয়া শহরেই রাজাপালং জাদি বৌদ্ধবিহার।
স্থানীয়ভাবে এটি জাদিমুড়া নামে পরিচিত। এ বিহারসহ অন্তত ছয়টি মন্দির হামলার শিকার হয় সেখানে। কক্সবাজার জেলার ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বেশ পুরনো বলেই জানালেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী। ঘটনার দিন ৩০ সেপ্টেম্বর বের করা মিছিলে তিনি নিজেও হাজির ছিলেন। তবে দায় পুরোটাই এড়িয়ে গেছেন।
বলেছেন, তার দলের লোক জড়িত নয়। জড়িত হলে তিনি নিজেই তাদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য বলতেন।
তার অভিযোগ, হামলার আশঙ্কা আগ থেকেই ছিল। সেটি তিনি নিজেই উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন। বিকেল ৪টায় জাদিমুড়া আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি বলেছেন যাতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়।
সেটি করতে ব্যর্থ হওয়ায় ঘটনা পুরো উখিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইউএনও তাকে জানান, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক তার সাথে ১৪৪ ধারা জারির বিষয়ে একমত হতে পারেননি। তাই দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, ঘটনার পর সেনা ও বিজিবি সবাই এসেছে। ‘তবে এটি ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা যাওয়ার মতো অবস্থা। ’
সরেজমিন উখিয়া ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
কোনোভাবেই স্থানীয়দের আস্থায় নিতে পারছেন না তারা। বলছেন, এভাবে এখানে বসবাস করা কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে আমরা ভাবছি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দীপাঙ্কুর বৌদ্ধবিহারের ভান্তে বিমল জ্যোতি বলেছেন, আমার কপালে ছিল তাই এমনটি হয়েছে। সেখানে বিহারের একটি অংশের পুরোটাই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আরেকটি অংশে হামলা চালিয়ে বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংস করা হয়েছে।
এ ধ্বংসযজ্ঞ কারা চালিয়েছে, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
তার মতে, ঘটনার সময় অন্ধকার ছিল। তাই কাউকে চিনতে পারেননি। এক যুগের বেশি আগে তিনি এখানে এসেছেন ভান্তে হিসেবে। এখানকার মানুষের সাথে মিশে আছেন।
অহিংসার নীতি প্রচার করে যাচ্ছেন। কিন্তু হিংসার যে আগুনে বৌদ্ধবিহার পোড়ানো হলো, তা নিয়ে এখন রাজনীতি হচ্ছে বলে বিহার পরিচালনা পর্ষদের সেক্রেটারি অমিয় বড়–য়া জানান।
তিনি বলেন, এখন মন্দির পোড়ানোর মামলায় অহেতুক স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজালালকে জড়ানো হয়েছে। আমরা এর লিখিত প্রতিবাদ করেছি। তার একটি কপিও তিনি আমাদের হাতে দেন, যাতে লেখা রয়েছে ‘এ ঘটনাকে রাজনীতিকরণের চেষ্টা চলছে।
এর সাথে উপজেলা চেয়ারম্যানের কোনো রকমের সম্পর্ক নেই। এ সম্পর্কে আমাদের না জানিয়ে যে মামলা হয়েছে তাতে তাকে আসামি করা হয়ে্েছ। আমরা এর নিন্দা জানাই। ’ তারা আরো বলেছেন, ঘটনার সাথে জড়িতদের নামে মামলা না করে নিরীহ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। এটি কোনোভাবেই সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
আতঙ্ক কাটেনি : রামুর দিকে সবার নজর। উখিয়ায় কম। সেনা আছে। আছে বিজিবি। তবে বৌদ্ধদের প্রতি মুহূর্ত কাটছে ফের হামলার আতঙ্কে।
তারা জানান, হামলার এক সপ্তাহ পরও তারা বৌদ্ধবিহারে ধর্মীয় শিক্ষা চালু করতে পারেননি। এমনকি নিয়মিত পূজা-অর্চনা করতেও বিহারে আসছেন না বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা। খা খা করছে বিহার। জাদিমুড়ায় বিকেলে গিয়ে দেখা গেল ভান্তে তার দুই শিষ্যকে নিয়ে অলস সময় কাটাচ্ছেন। আর স্থানীয় সরকারদলীয়দের হুমকির মুখে আছেন।
আবার কখন হামলা হয়।
ভান্তে জ্যোতি শুভ নয়া দিগন্তকে বলেন, এলাকার লোকজনই এখানে হামলা করেছে। যাদের সাথে আমরা অনেক বছর ধরে এখানে উৎসব পালন করে আসছি, তারা হামলা করায় আমরা বেশি দুঃখ পেয়েছি। প্রথমে তারা ৩০ থেকে ৪০ জন আসে। পরে এ সংখ্যা দুই শতাধিকে পরিণত হয়।
ভান্তে জ্যোতি বলেন, হামলাকারীদের মধ্যে আমরা যাদের চিনতে পেরেছি, তাদের নাম উল্লেখ করেছি। তবে এখন পর্যন্ত পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেনি। এতে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় আছি। বিহারের ধ্বংসযজ্ঞের অবস্থা দেখাতে দেখাতে জ্যোতি শুভ বলেন, প্রতি শুক্রবার এখানে ধর্মীয় ক্লাস হতো। গেল শুক্রবারে আমরা শিষ্যদের জন্য অপেক্ষা করেছি।
কিন্তু কেউই আসেননি। পূজারীর সংখ্যাও কমে গেছে।
পাশের মাদরাসাটি দেখিয়ে বলেন, এখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আমাদের পূর্ণ সহায়তা দিয়েছেন। নইলে আমরা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতাম।
৩০ সেপ্টেম্বর যে মামলাটি করা হয় তাতে বলা হয়েছে, বিহারটি মূল ফটক, বৌদ্ধবিহারের সব আসবাব ভাঙচুর করা হয়েছে।
পাঁচটি পিতলের মূর্তিসহ অন্তত সাতটি মূর্তি ভাঙচুর ও লুট করা হয়েছে।
জাদিমুড়া বিহারের পরিচালনা পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক অরুণ বড়–য়া স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তারা সবাই স্থানীয় রাজাপালং ইউনিয়নের ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকর্মী। তারা হলেন মোহাম্মদ আলম, টিটু, জিয়াউদ্দিন, রুবেল, কামাল উদ্দিন, টিপুসহ অজ্ঞাত আরো ২০০ জন। তবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের কেউ এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হননি।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সালাউদ্দিন নয়া দিগন্তকে বলেন, এ হামলার সাথে তার দলের লোক জড়িত নয়।
তিনি নিজে বৌদ্ধদের নিয়ে পালা করে বিহার পাহারা দিচ্ছেন। তার মতে, যে সম্প্রীতি নষ্ট হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
ক্ষতিগ্রস্ত পশ্চিম রতনা শাসন তীর্থ সুদর্শন বিহারের গিয়ে দেখা যায়, অনেক লোকসমাগম সেখানে। তাতে হলুদিয়া পালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মিন্টুও রয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা বিস্মিত যে ঘটনার সময় আমরা এলাম, কিন্তু বিএনপি ও জামায়াতের কোনো লোক এলো না।
এদের প্রটেক্ট করার জন্য তাদের আসা উচিত ছিল বলে তিনি মনে করেন।
তিনি জানান, ঘটনার সময় তিনি এখানে ছিলেন। তার গাড়িও হামলার শিকার হয়েছে। ওই বিহারের পরিচালনা পর্ষদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি মধুসূদন বড়–য়া বলেছেন, হামলায় মিয়ানমারের লোক জড়িত ছিল। হাফপ্যান্ট পরে সবুজ শার্ট পরা কিছু লোক ওই হামলায় যোগ দেয়।
তাদের ছাড়া তিনি কাউকে খুব একটা চিনতে পারেননি।
তার মতে, তখন জান বাঁচানোর জন্য তিনি দ্রুত এলাকা ত্যাগ করেছেন। বিহারে শত শত ঢিল ছোড়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটি খুবই পরিকল্পিত একটি ঘটনা। তবে পুলিশের হস্তক্ষেপে রেহাই পায় মধ্যম রতœা রতœাংকুর বৌদ্ধবিহার। সেখানে গেলে পটল বড়–য়া নয়া দিগন্তকে বলেন, এখানেও হামলা করতে চেয়েছিল।
তবে পুলিশের গুলির কারণে হামলা চালাতে পারেনি। মিছিল আসার পরপরই আমরা সবাই পালিয়ে যেতে সক্ষম হই।
দীপাঙ্কুর বৌদ্ধবিহারের ভান্তে বিমল জ্যোতি বড়–য়া নয়া দিগন্তকে বলেন, এখন পুলিশ আছে, সেনাবাহিনী আছে, আছে বিজিবি। কিন্তু এরপর আমাদের কী হবে। আতঙ্কের মধ্যে আছি আমরা।
এ আতঙ্ক কাটাতে হবে। সে জন্য আমরা প্রার্থনা করছি।
শ্যামলের কাণ্ড : উখিয়া থানার এসআই শ্যামল উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজালাল চৌধুরীর স্ত্রী, মেয়ে, বোন ও তার সহমর্মী নারীদের সাথে খারাপ আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন হাসিনা চৌধুরী।
তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, গতকাল শনিবার বিকেলে তিনি বিএনপির তদন্ত দলের সাথে কথা বলার জন্য কয়েকজন নারীকে সাথে নিয়ে গেলে শ্যামল তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। তিনি উপজেলার চেয়ারম্যান বৌদ্ধবিহারে হামলা করেছেন উল্লেখ করে বলেন, শাহজালাল চৌধুরীকে সামলান।
এখান থেকে যান। তিনি তাদের ওপর অ্যাকশন চালানোর হুমকি দেন।
একই সাথে নারীদের সাথে অশোভন আচরণ করার কথা উল্লেখ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন কয়েকজন নারী। স্থানীয় সাংবাদিকেরা জানান, শ্যামলের এমন আচরণ পুরনো। শ্যামল বলে থাকেন তাকে আর কী করা হবে? সর্বোচ্চ বদলি করা হবে।
এতে তার আপত্তি নেই। এসব বিষয়ে শ্যামলের সাথে আলাপের জন্য থানায় গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।
ঘটনা যেভাবে : ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর উখিয়াতে সতর্ক থাকার কথা ছিল। কিন্তু তেমনটি ঘটেনি। সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ নেতারা মাইকিং করে কোর্ট বাজারের জমায়েত হতে ‘ধর্মপ্রাণ’ মুসলিমদের আমন্ত্রণ জানান।
সেখান থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। যে মিছিলে আওয়ামী লীগের উপজেলা সাধারণ সম্পাদক হামিদুল হক চৌধুরী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মাহামুদুল হক চৌধুরী, হলুদিয়া পালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা কামাল উদ্দিন মিন্টু প্রমুখ ছিলেন। তারা এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বরও একটি মিছিল করেন। সেটি করা হয়েছিল আমেরিকায় নির্মিত ও ইন্টারনেটে প্রচারিত ইনোসেন্স অব মুসলিমসের প্রতিবাদে। সেই সময় থেকেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত দাবি করে স্থানীয় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক তহিদুল আলম তহিদ নয়া দিগন্তকে বলেন, আগ থেকেই আওয়ামী লীগ মাঠ উত্তপ্ত করে রেখেছে।
৩০ তারিখে ফাইনাল শোডাউন করে তারা। এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা। এটি একেবারেই রাজনৈতিক উদ্দেশে করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
কেন এমন একটি হামলা ঘটেছে তার জবাবে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হামিদুল হক চৌধুরী নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করেছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, তারা কোনো রকমের গাফিলতি করেননি।
বিকেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে সন্ধ্যার পরে বিস্ফোরণ ঘটে।
তার মতে, হঠাৎ ১৪৪ জারি করা সম্ভব হয় না। তবে তারা বড় ধরনের অ্যাকশনে গেছেন, যেটি ১৪৪ ধারার চেয়েও কঠোর ছিল।
এ ঘটনার কারণ জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, এর কারণ বহুমুখী।
ব্যাখ্যা করা কঠিন। এখানে একটা সেন্টিমেন্ট ছিল। আমরা সেটিকে প্রশমিত করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ বিস্ফোরণ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ে।
বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে উল্লেখ করে ইউএনও বলেন, এখন সিচুয়েশন আন্ডার কন্ট্রোল।
দিনে দিনে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
সূত্র: নয়া দিগন্ত অনলাইন ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।