আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ূন আহমেদ এবং আমি

আমার ভাবনাগুলোর চিত্ররূপ হলো আমার চলচ্চিত্র আর বর্ণরূপ হলো এই ব্লগ॥ চাঁদনি পসর রাত আর বর্ষার প্রথম বৃষ্টির সাথে আমার প্রেম অনেক দিনের। পাহাড়, নদী, সমুদ্রের প্রেমেও পরেছি বুঝতে শেখার পর থেকেই। কৈশোরের শেষের দিকে আসার পর জোছনা রাতে চাঁদের আলোতে গা' ভেজাতে গেলে, সমুদ্রের সাথে একান্তে কথা বলতে বসলে কিম্বা হিমালয়ের শরীর আরোহনের সময় নিজেকে নিতান্তই তুচ্ছ মনে হতো। কখনো কখনো কেমন যেন মরনের নেশায় পেয়ে বসতো। মনে হতো, 'হতো'ই বা বলছি কেন? এখনও তো হয়।

মনে হয় এতো তুচ্ছ জীবন ও সঙ্কীর্ন মনকে সঙ্গে করে সমুদ্র আর পাহাড়ের বিশালতা এবং আকাশের ঔদার্য নিয়ে বসে থাকা প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পন করি। এক কথায় মাথা নত করে নিজেকে বিসর্জন দেই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য আর ক্ষমতার কাছে। সূর্য সেন হলের ৪৬৮ নম্বর রুমের গ্রীল বিহীন জানলা দিয়ে নিচে লাফিয়ে পরতে চেয়েও পরিনি, উত্তাল বঙ্গোপসাগর বা ভারত মহাসাগরের বুকের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতেও যাইনি রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, দার্জিলিং, কালিম্পঙ, পোখাড়া বা পারোতে পাহাড় থেকে পাখির মতো উড়ে উড়ে আরো সুদূরে চলে যেতে চেয়েও যাইনি এমন পূর্ণিমার সংখা একেবারে কম নয় আমার বিশ্ববিদ্যালয় বা কর্মজীবনে। আর বৃষ্টিতে ভিজে নেয়ে মরতে বসার উপক্রমতো বোধ করি আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই দুই/একবার অন্তত হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ পড়তে গিয়ে, দেখতে গিয়ে বার বার তাঁকেও আবিষ্কার করেছি ঠিক আমারই মতো করে।

আমিও তাঁর মতো কদম ফুল ভালো বাসি। ভুত-প্রেতে অবিশ্বাস করি, আবার প্যারানরমাল গল্প শুনে দারুনভাবে রোমাঞ্চিতও হই। আমাদের ভালোবাসাগুলো এক, ভালো লাগাগুলো এক। ভাবনাগুলোও অনেক কাছাকাছি, তাই এই অতি সাধারন কিন্তু অসামান্য মানুষটি এবং তার অতুলনীয় সৃষ্টিগুচ্ছের প্রেমে পরতেও সময় লাগলোনা মোটে। সম্পর্কে তিনি আমার বাবার আপন খালাত বোনের ছেলে, সেই হিসেবে আমার ফুপাত ভাই।

আত্মীয় হিসেবে অনেক কাছের কিন্তু পারিবারিক যোগাযোগটা এক পর্যায়ে সেইভাবে ছিলোনা বোধ হয় আমাদের আগের প্রজন্ম থেকেই। তবে একটা পর্যায়ে আমাদের সাথেও তাঁর যোগাযোগটা আত্মীয়ের চেয়েও বেশী হয়ে গেলো মনের দিক থেকে, তাঁর লেখা, নাটক এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। মাঝখানে ব্যক্তিজীবনের নানান ঘোর-প্যাঁচে কিছুটা যে তাঁর উপর মন খারাপ করিনি তাও না। কিন্তু সেটাও বেশী দিনের জন্যে নয়। আরেকটু যখন বড় হলাম, জগৎ-সংসারকে যখন আরেকটু বেশী করে জানলাম, বুঝলাম তখন বরং শ্রদ্ধাবোধটা বেড়ে গেলো আগের চেয়েও বেশী।

বুঝতে সুবিধা হলো যে এই পঙ্কিলতার যুগে একটা মানুষ নিজের কাছে অনেক বেশী সৎ বলেই তিনি ভনিতা করেননি, নিজের দূর্বলতা লুকিয়ে রাখেননি। একটা জাগতিক সম্পর্কের কাগুজে দায়-বদ্ধতার কারনে তিনি একটা প্রাণের সম্পর্ককে উপেক্ষা করেননি। বেঁচে থাকাকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে ভালোবাসেন বলে জীবনের মূল্যবান একটা মূহুর্তও আসলে অপচয় করতে চাননি তিনি। গুলতেকীন এর জীবন থেকে শাওনের জীবনে তাঁর পথ পরিক্রমায় খনিকের জন্যে হয়ত আমাদের মধ্যবিত্ত ধ্যান-ধারনাগুলো আহত হয়েছিল ঠিক কিন্তু নিজেকে উৎসর্গের মহত্বের চেয়েও কপটতাহীন সরলতার সৌন্দর্যটা একটা সময়ে আমাদের কাছে নিশ্চয়ই একটু হলেও সমাদৃতই হয়েছে। লেখক, কবি, গীতিকার, গায়ক, আঁকিয়ে, অভিনেতা, নির্মাতা সকলের অভিন্ন পরিচয় তাঁরা শিল্পী আর একেকজন শিল্পী হলেন একেকজন স্রষ্টা।

তিনিও সৃষ্টি করেছেন একের পর এক বাকের ভাই, হিমু, শুভ্র, মিসির আলী'র মতো চরিত্র, নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, দুই দুয়ারী, আমার আছে জল এর মতো উপন্যাস, এইসব দিন রাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, অয়োময় এর মতো নাটক, আগুনের পরশমনি, শ্রাবনমেঘের দিন, চন্দ্রকথা, ঘেঁটুপুত্র কমলা'র মতো চলচ্চিত্র, একটা ছিলো সোনার কন্যা, যদি ডেকে বলি, যদি মন কাঁদে, বরষার প্রথম দিনে, ও আমার উড়ালপঙ্খী'র মতো গান যাদের মধ্যে আমরা সবাই নিজেকে, নিজের ছায়া এবং জীবনকে খুঁজে পাই। যা ভাবি মনে, মুখে তাই উচ্চারন করবার সততা, যা করতে ইচ্ছে করে, তাই করে ফেলার নির্ভীকতা, যা হওয়া উচিৎ, তাই ঘটিয়ে দেয়ার অবিচলতা ক'জনের মধ্যেই বা পেয়েছি আমরা? এত সহজ করে যে কথা বলতে পারেননি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, সে কথাও কত সহজেই না বলে গেছেন মিষ্টভাষী এই সহজ মানুষটি। তাই বলে আবার জাতীয় দূর্যোগ এবং আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের কারনে অস্থির হয়ে ওঠা সময়গুলোতে কিন্তু তল্পীবাহক তথাতথিত বুদ্ধিজীবিদের মতো গা' বাঁচিয়ে চলেননি তিনি। সারা জীবন রাজনীতির বাইরে থেকেও রাজনীতি সচেতন হয়ে তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবেই পালন করে গেছেন। যে 'উচিৎ কথা' কোন 'মহাপুরুষ' এর মুখ দিয়েও বের হতে শুনিনি কয়েক যুগে, সে কথাও কি অবলীলায় অহরহই বেরিয়ে এসেছে তাঁর কলম, তাঁর সৃষ্ট চরিত্র এবং নিজের মুখ থেকে।

হুমায়ূন আহমেদ এর রস এবং পরিমিতিবোধের কথাতো বলাই হলোনা। নাটকে, উপন্যাসে, চলচ্চিত্রে গানের উল্লেখ এবং ব্যবহার এতদ্বেশীয় অঞ্চলে নতুন কিছু নয় কিন্তু গানের এমন যথোপযুক্ত ব্যবহার আমার মনে হয়না তাঁর আগে পরে কেউ করতে পেরেছেন। বিশেষ করে রবীন্দ্র নাথ এর গান। এত উপযুক্ত জায়গায়, মেজাজ এবং পরিবেশ অনুযায়ী নানান আঙ্গিকের গান- কথা এবং সুর-লয় সবকিছু বিচার করে তিনি এত নিপুণভাবে রবীন্দ্র নাথের গানকে ব্যবহার করেছেন যে যদি কেউ না জানে যে এটা রবীন্দ্র সঙ্গীত তবে সে ধরেই নেবে এই গানটা এই পরিস্থিতিকে মাথায় নিয়েই লেখা এবং সুর করা। হাসন রাজা এবং উকিল মুন্সী'র গানের ব্যবহারও তিনি করেছেন অসাধারনভাবে।

প্রতিভা এবং শিল্পের এক অনন্য আবিষ্কারকও ছিলেন তিনি। 'মরিলে কান্দিসনা আমার দায়'- এই গান এবং এর গীতিকার-সুরকার গিয়াস উদ্দিন কে বাংলাদেশ টেলিভিশনে গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করিয়ে সম্মানিত করা এবং এই মর্মস্পর্শী গানটিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া থেকে শুরু করে কুদ্দুস বয়াতী, মোজাম্মেল হক ও চ্যালেঞ্জার ভাই এর মতো কত গুনী মানুষ আর তাঁদের গুনকে যে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার আসলে ইয়ত্তা নেই কোন। এত সব কারণ ছিলো লোকটিকে ভালোবাসবার। তাঁর দেখিয়ে যাওয়া সহজ ও সুন্দর জীবন-দর্শনকে আপন করে নেবার। তাঁর মতো স্পষ্টভাষী ও সাহসী হতে চাওয়ার।

জীবনকে যেমন অনেক বেশী ভালোবাসতেন তিনি, তেমনি মৃত্যুকেও জানতেন অমোঘ এবং অনিবার্য হিসেবে তাই জীবনের সম্পূর্ণ স্বাদ নিংড়ে নিংড়ে আস্বাদন করেছেন ঠিকই কিন্তু মৃত্যভাবনাকে মোটেও এড়িয়ে যাননি তিনি। শুধু একটি সুন্দর কাব্যময় প্রস্থান চেয়েছিলেন হয়ত। তাঁর সে চাওয়া পূর্ণ হয়েছে কিনা জানিনা তবে নিশ্চয়ই তিনি পরলোক নামক সেই হীমপুরীতে যেতে যেতে কোটি মানুষের ভালোবাসা আর অশ্রুর ওমটুকু পেয়ে সামান্য হলেও ঊষ্ঞ বোধ করছেন। আজ এই বিদায়ের করুণ ক্ষণে আমার একটাই আফসোস একই জগতের বাসিন্দা হয়েও, একই জেলার সন্তান হয়েও, এত কাছের আত্মীয় হয়েও, নিছকই হেলায় সমসাময়িক এই কিংবদন্তির সান্নিধ্যবঞ্চিত হলাম আমি। আসলে বুঝতেই পারিনি ভাই আপনি এই শ্রাবণেই আমাদের ছেড়ে মেঘের উপরে চলে যাবেন॥ - মেহ্দী খান জেহাদ ২৩/০৭/২০১২ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.