আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চতুর্থ পর্বঃ দেবীর অভিশাপ

নিজের সম্পর্কে কিছুই লিখার নাই। নিজের এমন রেপ্লিকা দেখে ভীষণ ভড়কে গিয়েছি। মাথার সব চিন্তাভাবনা অকেজো হয়ে গেছে, কিন্তু তারপরেও নিজেকে সুস্থির রাখার চেষ্টা করলাম প্রানপনে। আসার পর থেকে অদ্ভুত সব ঘটনা দেখতে দেখতে মনের সবগুলো অনুভূতি ভোতা হয়ে গেছে ততদিনে। আর তাছাড়া আমি এর আগেও বড় চাচার সাথে মাঝ সমুদ্রের উত্তাল ঝড় পারি দিয়েছি।

আমার সহ্য শক্তি দেখে আমি নিজেই নিজেকে নিয়ে অবাক হয়ে যাচ্ছি। ছোট বেলা থেকেই সবার ধারনা আমি মেয়েটা ভীষণ ডানপিঠে এবং সাহসী। আগে না মানলেও সেটা যে সত্যি, সেটা এখন টের পাচ্ছি। আমি কালি এবং ডঃ শিধু রায়ের দিকে তাকালাম, ওরা দুজনেই একদম শান্ত, চেহারা দেখে মনে হল একদম চমকায়নি। বুঝতে পারছি ওরা এটা আগেই দেখেছে, সেই সাথে অনেক কিছুই পরিস্কার হয়ে আসছে আমার কাছে।

এই আদিবাসীরা কেন আমাকে দেবী ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু আমি তো দেবী নই, এটা আমার থেকে বেশি আর কে জানে? আমি ধীর পায়ে এগিয়ে চলি মূর্তিটির দিকে। এক হাতে মুঠি করে রাখা সামনের দিকে যেন কাউকে ভীষণ ক্রোধে হত্যার হুমকি দিচ্ছে আর অন্য হাতে একটা তরবারি। ঠিক এরকম একটা আমার কাছেই আছে এখন। তবে ধীরে ধীরে বেশ কিছু অমিল পেতে শুরু করলাম।

আমার চোখের মনি দুটো কুচকুচে কালো আর মূর্তির চোখে দুটো আলাদা রঙের পাথর বসানো। মূর্তির মেয়েটির বা হাতে একটা আঙ্গুল কম দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আমার হাতে সব গুলোই আছে। দেখা হতেই সরে আসলাম। সবাই মিলে সামনের একটা বারান্দায় বসে আছি, এখান থেকেই অনেক দূরের পর্বতের গায়ে বরফ দেখা যাচ্ছে, আমরা এমনকি বাতাসে ভেসে বেড়ানো মেঘ দেখতে পাচ্ছি। সবাই চুপ করে আছে।

কারো মুখেই কোন কথা নাই। তবে শায়লা আপুই প্রথম মুখ খুলল। পুনি এখানে কি হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে আমার বিন্দু মাত্র মাথা ব্যাথা নেই, আমরা আজকেই এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আপুর অবস্থা বুঝতে পারছি, আমার নিরাপত্তা নিয়ে আপু এবং ভাইয়া দুজনেই চিন্তিত। এমতাবস্থায় চিন্তা না করেও অবশ্য উপায় নেই।

আপুর জায়গায় অন্য যে কেউ এই কথাই বলত। আমিও ততক্ষন নিজের বিপদ টের পাচ্ছিলাম। ভয়ে ভয়ে কালির দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর অস্বচ্ছ ঘোলা দৃষ্টি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে ও এই মুহূর্তে একটা উন্মাদ বৈ কিছু নয়।

আপু কিছুই বুঝতে পারেনি তবে ভাইয়া আর শীধু রায় টের পেয়েছে কালির মনোভাব। আপু বলেই চলল কে পুনি ওঠে দাড়া আমরা এক্ষুনি যাবো এখান থেকে। আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করলেও চলবে না। কিন্তু কালি উঠে দাঁড়ালো আপুর আগেই আর স্পষ্ট বাংলায় বলল, মা আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবেন না, আমরা হাজার বছর ধরে মায়ের জন্যে অপেক্ষা করেছি। ভীষণ চটে গেলো আপু।

বলেই ফেলল তোমাদের কুসংস্কারের বলির পাঁঠা হবে আমার বোন? কি করে ভাবলে? তোমার সাহস তো কম নয়? এক্ষুনি এখানে ইন্ডিয়ান আর্মি কে আনাবার ব্যবস্থা করতে পারি আমি তুমি জানো ছেলে? আপুর বাবা ইন্ডিয়াতে বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত হিসেবে অনেক দিন ছিলেন তাই এখানের আর্মিতেও উনার অনেক বন্ধু আছে। আর আমাদের পরিবার যে আমাকে এবং আপুকে রক্ষা করতে তাদের সমস্ত যোগাযোগ ব্যবহার করবে সে তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু অরধশিক্ষিত কালি সে কথা কি করে বুঝবে? সে সোজা জানিয়ে দিলো মা কোথাও যাচ্ছেন না। উনি আমাদের গ্রাম কে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবেন তবেই তিনি যাবেন। এবার মারমুখো ভঙ্গীতে আপুও উঠে দাঁড়ালো।

কিন্তু এর মাঝেই ভীষণ দানবীয় চিৎকারে আমরা কুকড়ে গেলাম আতংকে। কল্পিত কতগুলো জীব আমাদের চারপাশে হাতে বল্লম নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এদের আমি স্বপ্নে দেখেছি। আপু তো কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না এমনকি প্রবীণ শীধু রায় তো হতবাক হয়ে দাড়িয়ে আছে, আর ভাইয়াও। শুধু কালির মাঝেই রণহুংকার।

সে বিশাল একটা লাঠি আগেই সাথে করে নিয়ে এসেছিলো সেটা দিয়ে আক্রমন করে বসলো ঐ পশু গুলোর উপর। কিন্তু আট ফুটি একেকটা দানবের সাথে কিভাবে লড়াই করবে সে? মারাত্মক আহত হল কালি। ওরা হয়তো মেরেই ফেলত কালিকে কিন্তু আমার মুখ থেকে বেড়িয়ে গেল "ওকে মেরো না"। কখন জানি কালি আমার মধ্যে একটা মায়ার স্থান দখল করে নিয়েছিলো। কিন্তু আমার চিৎকারে একেকদলের একেক প্রতিক্রিয়া হলো।

পশু গুলো হাটু মুড়ে বসে পরলো। আর আপুর মুখ সাদা হয়ে গেলো। ডঃ আর ভাইয়া অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভাইয়া কে জিজ্ঞেস করলাম কালির চিকিৎসা দরকার নইলে মরে যাবে। ভাইয়া তারপরেও আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে যেন বুঝতে পারছে না আমি কি বলছি।

এবার একটু জোরেই বললাম ওভাবে হা করে তাকিয়ে না থেকে কিছু একটা করো নয়ত কালি মরে যাবে। ভাইয়ার মধ্যে এবার যেন একটু বিকার ফিরে এলো। সে দ্রুত এগিয়ে গেলো কালির অবস্থা দেখতে। আপু এসে আমার মুখ শক্ত করে ধরলো। এই পুনি একটু আগে তুই অদ্ভুত কি বলেছিস? কি ভাষা এটা? আর এই ইয়েতি গুলো তোর কথায় অমন চুপ মেরেছে কিভাবে? এবার আমার অবাক হবার পালা।

আসলেই তো আমি অদ্ভুত কি ভাষায় জানি কথা গুলো বলেছি। আমি আপুকে এড়িয়ে গেলাম। কালির দিকে ছুটে গেলাম। একটা ইয়েতিও এলো, ভাইয়া ইয়েতিটা দেখে ভয়ে সরে গেলো কিন্তু ইয়েতিটা এসে কী একটা বাশের তৈরি একটা কৌটো বের করলো, ওটার মধ্যে থেকেই বের করলো একধরনের ক্রিম সেটা কালির সমস্ত ক্ষতে মাখিয়ে দিচ্ছে। মনে হল ব্যথায় ও জ্ঞান হারিয়েছে।

চিকিৎসা পর্ব শেষ হতেই ওরা আবার আমাদের চারপাশে ঘিরে দাঁড়ালো। মনে হচ্ছে ঐ চিকিৎসা জানা ইয়েতিটাই ওদের দলনেতা। সে আমার সামনে এসে দাড়ালো। এবং সেই অদ্ভুত ভাষায় কথা বলতে লাগলো। এবং কি আশ্চর্য প্রতিটা কথাই আমি বুঝতে পারছি।

মা আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে, হাজার হাজার বছর ধরে যে অভিশাপ আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি একমাত্র আপনিই পারেন আমাদের সেই অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে। আমরা আপনার জন্যে হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করে চলেছি। আপনি অবশেষে আমাদের মাঝে ফিরে এলেন দেখে খুবই ভালো লাগছে। এবার আমরা আমাদের হারানো সন্মান ফিরে পাবো, ফিরে পাবো আমাদের সেই রূপ। আমি বাংলায় তর্জমা করে আপুকে বললাম সব।

আপু বলল না পুনি ওদের সাথে কোথাও যাওয়া হচ্ছে না তোর। আমরা আজই এখান থেকে চলে যাবো, নইলে চাচা চাচি, আব্বু আম্মু কারো কাছেই আমি মুখ দেখাতে পারবো না। তারপর আমি পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললাম। ওদের সাথে না যেতে চাইলে ওরা আমাদের জোর করবে বলেই মনে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে না যেতে চেয়ে বন্দী হওয়াটা ভালো কিছু হবে না।

আমাদের যাওয়াটাই উচিত হবে এখন। আমার সাথে ডঃ আর ভাইয়াও একমত হল। আপু বুঝতে পারছে আমার কথায় যুক্তি আছে কিন্তু বেচারা ভাইয়াকে দোষ দিতে ছাড়ল না। জানি আপু ভাইয়া একজন অন্যজনকে ভীষণ পছন্দ করে। তাই এতো ঝামেলার মধ্যেও হাসি পেয়ে গেলো।

ইতিমধ্যে কালিও উঠে বসেছে, ওকেও আবার সব বলতে হলো। ও শুধু বলল মা আপনি যেখানেই যাবেন আমিও সেখানেই আপনার সাথে যাবো। আমি শুধু বুঝতে পারছি এই মা ডাকটা ভালো লাগছে না। কেমন নিজেকে অনেক বড় বড় মনে হয়। একটা জিনিস আমাকে ভাবিয়ে তুলল, আমরা তো সামনের সিড়ি পথেই বসে ছিলাম তাহলে এই ইয়েতি গুলো এলো কিভাবে? কখন এলো? নাকি আরো আগে থেকেই আমাদের জন্যে এখানে অপেক্ষা করেছিলো? একটু পরেই বুঝতে পারলাম।

আসলে এই মন্দিরে আসার হাজারো চোরাপথ আছে। আমরা মন্দিরটা ভালো করে আগে লক্ষ করিইনি। মন্দিরের ভিতর দিকে অনেকরকম গলি ঘুপচি ধরে এগোচ্ছি। আর তার মাঝেই চোখে পড়ছে নানান রকম ঘর। কোনটা মাকড়সাদের স্বাধীন বাসা কোনটা সাপেদের কোনটা আবার পাখি কিংবা বুনো জন্ত জানোয়ায়ের।

তবে এসবের চেয়েও অবাক বেশি হয়েছি ইয়েতি গুলোকে মানুষের মতো করে কথা বলতে দেখে, মনে হচ্ছে ওরা কোন জন্তু নয় যেন মানুষ। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা গুহার মধ্যে চলে এলাম, ক্রমশ ঢালু পথে বেশ বোঝা যাচ্ছিলো নিচের দিকেই নামছি আমরা। একসময় গুহামুখের বাহিরে আলো চোখে পড়লো। ধীরে ধীরে বের হয়ে এলাম গুহা থেকে সমতলে। ওরা আহত কালির জন্যে দুটো ডাল দিয়ে একটা স্ট্রেচার বানিয়ে ফেললো।

আর সবচেয়ে অবাক করলো যেটা সেটা হচ্ছে একটা পালকি। চমৎকার কারুকার্য করা এই পালকির চারপাশে স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া। এন্টিক ভ্যালু অনেক হবার কথা, দেখলেই বুঝা যায় এটা শতাব্দী প্রাচীন। আসলে আমার ধারনা পরবর্তীতে ভুল প্রমানিত হয়েছিলো। ওটা আসলে হাজার হাজার বছর পূর্বের।

ওদের দলনেতা আমাকে অনুরোধ করলো পালকি তে চড়তে, কিন্তু আমি তাকে বললাম আমি একা নই আমার সাথে আপুকেও সাথে নিতে চাই। অতবড় একটা পালকিতে আমাদের দুজনের স্থান সংকুলান না হবার কোন কারন দেখছি না। অতঃপর আপু আর আমি চড়ে বসলাম। আর সাথে সাথে দুলে উঠলো পালকি। আপুর দিকে তাকিয়ে বলেই ফেললাম, এবার দারুন একটা এডভেঞ্চার হবে কি বলো? আপু ভয় পেলেও এবার রোমাঞ্চ অনুভব করতে শুরু করলো।

আর শুরু হলো আমাদের যাত্রা অচেনা পথে। ______________________________________________ অফ টপিকঃ দিস লেখা ইজ আন্ডার কন্সট্রাকশন। যেকোনো পজিটিভ সমালোচনা কাম্য। এবং পরবর্তী পোস্ট রবিবার এই সময়ে দেয়া হইবেক। কেউ যদি ভাবগত অথবা বানানগত ভুল পেয়ে থাকেন তবে শুদ্ধসহ মন্তব্যে জানিয়ে দিবেন।

কৃতজ্ঞ থাকবো। ধন্যবাদ সবাইকেই। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.