চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি এরিক হবসবম (৯ জুন ১৯১৭ -১ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের অন্যতম খ্যাতনামা ঐতিহাসিক হিসেবে গোটা দুনিয়ার সব মহলেই নন্দিত ছিলেন। এমনকী যারা মার্কসবাদের সমর্থক নন, তাঁরাও এই আনখশির মার্কসবাদী ঐতিহাসিকের অসামান্য অবদানকে মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন। হবসবম জন্মেছিলেন রুশ বিপ্লবের বছরে, ১৯১৭ সালে। তাঁর পরিবার তখন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়াতে। হবসবমের জন্মের দু বছর পর তাঁরা প্রথমে চলে আসেন জার্মানীর ভিয়েনায়, অতঃপর বার্লিনে।
১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর হবসবম চলে আসেন ইংলণ্ডে এবং বাকী জীবন সেখানেই থাকেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পি এইচ ডি করেন, গবেষণার বিষয় ছিল ফেবিয়ান সমাজ। সারা জীবন ইতিহাসের অধ্যাপণার পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী। ১৯৩৬ সালে তিনি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন এবং ১৯৯১ সালে পার্টি বিলুপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি এর সভ্য ছিলেন। ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরীতে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর তাঁর বেশিরভাগ সহযোগী বন্ধু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করলেও তিনি পার্টির সাথেই যুক্ত থাকেন।
পাশাপাশি সোভিয়েত রাশিয়ার স্খলনগুলি নিয়েও তিনি সে সময় সোচ্চার হন। হাঙ্গেরী এবং পোলাণ্ড এর বিদ্রোহকে সমর্থন করে তিনি একে বলেছিলেন, ‘আমলাতন্ত্র ও ছদ্ম কমিউনিস্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবীদের বিক্ষোভ’। কমিউনিস্ট মতাদর্শে অবিচল থেকেও তার ভুল কোন প্রয়োগের সম্পর্কে আপোষহীন সমালোচনা আমরা কিছুদিন আগেও তাঁর থেকে পেয়েছি আমাদের রাজ্যের প্রসঙ্গে। সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্বে পশ্চিমবঙ্গে সি পি আই (এম) নেতৃত্বাধীন সরকার এর জমি অধিগ্রহণ নীতি, কৃষকহত্যার মত ঘটনা যে তাদের প্রবলভাবে জনবিচ্ছিন্ন করবে – বামেদের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়েও একথা বলতে তাঁর দ্বিধা হয় নি। মতাদর্শের প্রতি নিষ্ঠাই যে যেকোন ভুল প্রয়োগের তীক্ষ্ণ সমালোচনার প্রয়োজন রাখে, হবসবম তাঁর উদাহরণ হিসেবে আমাদের সামনে থাকবেন।
প্রি ক্যাপিটালিস্ট ইকনমিক ফর্মেশন, ইণ্ডাস্ট্রি অ্যাণ্ড এম্পায়ার, রিভোলিউশনারিস, নেশনস অ্যাণ্ড ন্যশানিলজম, অন হিস্ট্রি বা সাম্প্রতিকালে লেখা ইন্টারেস্টিং টাইমস : এ টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরী লাইফ, গ্লোবাইলাইজেশন, ডেমোক্রেসি অ্যাণ্ড টেররিজম, হাউ টু চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড এর মতো বহু সাড়া জাগানো বইয়ের লেখক হলেও হবসবম সারা বিশ্বের মননশীল পাঠকের কাছে বিখ্যাত হয়ে আছেন চার পর্ব জুড়ে বিশ্লেষিত ইউরোপ তথা বিশ্বের আধুনিকতার ইতিহাসের অনবদ্য আখ্যানের জন্য।
এজ অব রিভোলিউশন (১৭৮৯-১৮৪৮), এজ অব ক্যাপিটাল (১৮৪৮-১৮৭৫), এজ অব এম্পায়ার (১৮৭৫-১৯১৪), এজ অব এক্সট্রিমস (১৯১৪-১৯৯১) সম্মিলিতভাবে আধুনিক সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষ্য হিসেবেই পরিগণিত হয়।
এজ অব রিভোলিউশন ফরাসী বিপ্লব ও ইংলণ্ডের শিল্প বিপ্লবের সূত্র ধরে আধুনিক ইউরোপের বহুস্তরিক নির্মাণপর্বের শুরুর দিনগুলোর অসামান্য ভাষ্য। আমরা স্মরণ করতে পারি বইয়ের প্রথম চমকপ্রদ বাক্যটি। ‘প্রথমেই নজরে পড়ে ১৭৮০ র দশকের পৃথিবী আমাদের আজকের পৃথিবীর তুলনায় একইসঙ্গে ছিল অনেক ছোট এবং অনেক বড়’।
অতঃপর হবসবম আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে দেখান ভৌগলিক সীমা সংক্রান্ত জ্ঞানের প্রেক্ষিতেই হোক বা লোকসংখ্যার নিরিখে, কেমন ছোট ছিল সে সময়ের পৃথিবী। আবার যোগাযোগ ব্যবস্থার তখনকার অপ্রতুল অবস্থা এই ছোট পৃথিবীকেই আজকের তুলনায় বড় করে দেখাত। হবসবম আমাদের দেখান শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে ইউরোপ তথা পৃথিবী কীভাবে নতুন নতুন ভৌগলিক ভূখণ্ডের সাথে নিবিড়ভাবে ক্রমশ পরিচিত হচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে ধারণাগত আঞ্চলিক সীমা, আবার যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব বিকাশ কীভাবে দূরকে করে তুলছে নিকট। শিল্প বিপ্লব এবং ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস, বিশ্বজোড়া তার তাৎপর্য, যা আগামী দিনগুলিকে সারা বিশ্বের জন্যই বদলে দেবে, তাঁর আসামান্য ভাষ্য রচনার পর হবসবম মতাদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদের উত্থানের ইতিহাস আলোচনা করেন। বিজ্ঞান ও সাহিত্য সংস্কৃতির অসামান্য বিকাশের পাশাপাশি গরীব শ্রমজীবী মানুষের একটি শ্রেণি হিসেবে কীভাবে তৈরি হয়ে উঠছে সে কথাও তোলেন হবসবম।
এজ অব ক্যাপিটাল বইটি ইউরোপীয় পুঁজিবাদের দুর্মর বিকাশ ও বিশ্বজোড়া তার প্রভাবের ইতিহাসকে তুলে ধরেছে। প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে বারবার এসেছেন মার্কস, এসেছে তার ক্যাপিটাল ও অন্যান্য বইয়ের প্রসঙ্গ। হবসবম আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন মার্কস এবং এঙ্গেলস যেমন বলেছিলেন, ‘ ইউরোপ একটা ভূত দেখছে, কমিউনিজমের ভূত’, তেমনি অন্য অনেকেও কেমন এরকমটাই বলছিলেন, যদিও ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে। ১৮৪৮ এ কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো লেখার বছরেই ফরাসী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বিশিষ্ট রাজনীতিক আলেক্সি দ্য তকুইভিল সবার মনের ভাব প্রকাশ করছিলেন, ‘আমরা কি একটা আগ্নেগিরির ওপর দাঁড়িয়ে নেই? আমরা কি বুঝতে পারছি না জগৎটা কাঁপছে? বিপ্লবের হাওয়া বইছে, দিগন্তে দেখা যাচ্ছে ঝড়। ’ পুঁজিবাদের বিকাশের পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণির বিকাশ ও প্রতিস্পর্ধিতার গৌরবময় নানা প্রচেষ্টা, দ্বন্দ্বের ঝোড়ো হাওয়ার ইতিহাস এই বইটিতে হবসবম তুলে আনেন।
এজ অব এম্পায়ার বইটি শুরু হয় ১৮৫৭ র অর্থনৈতিক মন্দার পর্বটি দিয়ে। ইউরোপীয় পুঁজিবাদ দ্রুতই এই মন্দার দশা কাটিয়ে ওঠে, কিন্তু এই সময়েই আমেরিকান ও জার্মান অর্থনীতি ব্রিটিশ অর্থনীতিকে টেক্কা দিতে থাকে। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ পণ্য চলাচলকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়, বাড়তে থাকে জীবনযাত্রার মান। অন্যদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে এবং দেশগুলির ভেতর বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে অসাম্য পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে এশিয়া আফ্রিকা লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর উপনিবেশ বাড়ানোর চেষ্টা।
আপাত শান্তির পরিবেশে ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলি অস্ত্রসম্ভার বাড়িয়ে যেতে থাকে। সময়ের মধ্যে নিহিত এইসব মৌলিক দ্বন্দ্ব শেষপর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো এক তীব্র সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে। লেনিনের মত অনেকেই মনে করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়ে যাবে। হবসবম স্বীকার করেন পুঁজিবাদ নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। তবে তা পারলেও অষ্টাদশ শতকের শেষে শিল্প বিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লবের উত্তরাধিকারজাত যে চরিত্র নিয়ে সে পথ চলা শুরু করেছিল তার সে চরিত্র বহুলাংশে বদলে গেছে।
অনেক সমাজতান্ত্রিক দাবীকে নিজের মধ্যে অঙ্গীভূত করে ‘কল্যাণমূলক রাষ্ট্র’ নামক এক ব্যবস্থার জন্ম দিতে সে বাধ্য হয়েছে।
এজ অব এক্সট্রিমস প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের সময়কাল থেকে ১৯৯১ এ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অবসানপর্ব পর্যন্ত সময়ের দলিল। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের দ্বন্দ্বর বিশ্বজনীন চেহারা ছাড়াও উপনিবেশগুলেতে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জন বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে সমাজতন্ত্র, তার নির্মাণ, বিকাশ, জটিলতা, পুঁজিবাদের সাথে তার দ্বন্দ্ব ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন নিশ্চিতভাবেই এই বইয়ের মূল মেরুদণ্ড। হবসবম মনে করেছেন রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাজতন্ত্র শুরু থেকেই সমাজতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মৌলিক কিছু মতাদর্শের সাথে সংঘাতে উপনীত হয়।
সমাজতন্ত্রের মধ্যে নিহিত গণতন্ত্রের প্রশ্নটিকে অনেক সময়েই অবহেলিত থাকতে হয়েছে। যুগস্লাভিয়া, আলবেনিয়া বা চিনের মত অনেক দেশের বিপ্লব শেষপর্যন্ত সোভিয়েত পরামর্শের চেয়ে ভিন্নপথে হেঁটেই অর্জিত হয়েছে। যেমন মাও স্টালিন নির্দেশিত পন্থাকে অতিক্রম করে নিজের দেশকালের অনুগ নিজস্ব পথ তৈরি করেছিলেন। কমিউনিস্টদের নিজস্ব কার্যক্রম সীমিত রেখে ফ্যাসিবিরোধী মঞ্চেই সব প্রয়াস উন্মুক্ত করার কমিন্টার্নপ্রেরিত নির্দেশিকা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট আন্দোলনে অনেক সময়েই ভালো ফল দেয় নি। একুশ শতকের এই সময়ে আমরা যখন পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধি লড়াইকে নতুন চেহারায় নতুন প্রেক্ষিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবি, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম এর মতাদর্শকে শাণিত করতে চাই, তখন হবসবম এর তোলা বিতর্কগুলি আমাদের চিন্তাকে বহুলাংশে সমৃদ্ধ করে।
বিশ্ব রাজনীতি তথা পুঁজিবাদ সমাজবাদের বিকাশ দ্বন্দ্বর যে বহুমাত্রিক ইতিহাসে বিপ্লবী কর্মীর জারিত, অভিজ্ঞ হওয়া একান্ত প্রয়োজন –তাঁর অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার হিসেবে এরিক হবসবম স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।