আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পোশাকশিল্প মালিকদের প্রতিপত্তির নেপথ্যে

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার অনেক মালিক পশ্চিমা ব্যবসায়ীদের মতো ধনাঢ্য। তাঁদের জীবনযাপনও বিলাসবহুল। কিন্তু নিজ কারখানার শ্রমিকদের অনেক কম মজুরি ও বেতন দেন তাঁরা।
মালিকদের দাবি, বিশ্বের নামী-দামী ব্র্যান্ডগুলো অনেক কম দামে তাঁদের কাছ থেকে পণ্য কেনে বলে শ্রমিকদের বেশি বেতন দেওয়া সম্ভব হয় না। তাঁরা আরও উচ্চমূল্যে পণ্য কিনতে বিদেশি ক্রেতাদের প্রায়ই আহ্বান জানান।

আজ শনিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের এসব তথ্য তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিবেদনে ধনকুবের ব্যবসায়ী ও জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সাংসদ মোহাম্মদ ফজলুল আজিমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের রমরমা অবস্থা ফজলুল আজিমকে ধনী বানিয়েছে। তিন দশক আগে একটি মাত্র কারখানা দিয়ে তাঁর ব্যবসা জীবনের যাত্রা শুরু। এখন তাঁর বেশ কিছু কারখানা আছে, যেখানে অন্তত ২৬ হাজার কর্মী কাজ করেন।

বছরে তাঁর আয় ২০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি নীতির সুফল ভোগ করে স্বতন্ত্র সাংসদ হয়েও ব্যবসার মাধ্যমে ফজলুল আজিম বিশ্ববাজারে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। ঢাকা শহরে তাঁর বড় সুইমিং পুলসহ বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। তবে ফজলুল আজিমের অভিযোগ, গত কয়েক বছরে পণ্য প্রস্তুতের খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তিনি মনে করেন, বিশ্বের যেসব নামী-দামী ব্র্যান্ডের কাছে পণ্য বিক্রি করা হয়, তাদের আরও বেশি মূল্যে তৈরি পোশাক কেনার সময় হয়েছে।

এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, ‘ক্রেতারা কিছু দেন না। তাঁরা শুধু বলে উত্পাদন বাড়ান। ’
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা বিশ্বের যেকোনো দেশের এই খাতের শ্রমিকদের চেয়ে কম বেতন পান। কর্মপরিবেশও নিরাপদ নয়। তবে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নতুন আসা শিল্প পুলিশের মাধ্যমে শ্রমিক অসন্তোষকে দমিয়ে রাখা হয়।


গত ২৪ এপ্রিল রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারে রানা প্লাজা ভবনধসের ঘিটনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে কয়েকটি তৈরি পোশাক কারখানা ছিল। এই বিপর্যয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, কর্তৃপক্ষ, মালিক ও ক্রেতাদের সম্মিলিত ব্যর্থতায় কত বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। সস্তা শ্রম মানেই বিপদজনক পরিবেশে কাজ করার ঝুঁকি নয়। এখানকারই আরেকটি তৈরি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনার পর কর্মস্থলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও শ্রম অবস্থা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার ছয় মাসের মধ্যেই আবার ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। তৈরি পোশাক কারখানায় নিয়োজিত ৪৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিকের বেতন বাড়ানো ও উন্নত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত আছে।


প্রতিবেদনে বলা হয়, সাংসদদের অন্তত ৩০ জন তৈরি পোশাক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ধসে পড়া রানা প্লাজার মালিক মোহাম্মদ সোহেল রানার রাজনৈতিক খুঁটির জোর বেশ শক্ত। তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন যুবলীগের স্থানীয় পর্যায়ের একজন নেতা।
শ্রম অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নেতা বুলবুল আখতার দাবি করেন, সাংসদদের অন্তত ৫০ শতাংশ এমন কোনো না কোন ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর অভিযোগ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তাঁরা শ্রমিকদের কম মজুরি দেন।

শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের জেরে তিন বছর আগে তাঁকে জেলে ঢোকানো হয়। এখনো গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাঁর গতিবিধির ওপর নজর রাখছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে যারা তৈরি পোশাকখাতের শ্রমিকদের ভালো বেতন ও উন্নত কর্মপরিবেশের দাবিতে সোচ্চার, রাষ্ট্র তাদের অনেক সময় শত্রু হিসেবেই বিবেচনা করে। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার আমিনুল ইসলামকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
এমন অভিযোগের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সরকারি কর্মকর্তা মঈনুদ্দীন খন্দকার বলেন, বুলবুল আখতারের ওপর নজরদারির কোনো কারণ নেই।

এ ধরনের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।
বিশ্বব্যাংকের ২০১০ সালের তথ্য অনুসারে, তৈরি পোশাক খাতের সবচেয়ে সস্তা শ্রম বাজার বাংলাদেশ। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার জ্যেষ্ঠ বেতন বিশেষজ্ঞ মাল্টে লুবকের বলেন, এই বেতন কমের মধ্যেও কম।
গড়ে প্রতিদিন দুই ডলারের কম আয়ের পোশাক শ্রমিকদের জীবনযাপন যখন মানবেতর এবং পোশাক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি যখন এমন, তখন কীভাবে টিকে থাকবে দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশ জোগান দেওয়া এই খাতটি?
২০০৪ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পোশাকের ক্ষেত্রে কিছু কোটা সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে সুফল পেয়েছে বাংলাদেশ।

তৈরি পোশাক খাতে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। তবে সস্তা শ্রমের কারণে ক্রেতারা চীনের চেয়ে বাংলাদেশের প্রতিউ বেশি আগ্রহী।
পশ্চিমা নামী ব্র্যান্ডগুলো যে দামে বাংলাদেশের কাছ থেকে পণ্য কেনে, এর চেয়ে অন্তত ১০ গুণ দামে বিক্রি করে। অর্থাত্, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তারা এ খাতের বড় বড় ব্যবসায়ী ও সোহেল রানার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছ থেকে ফায়দা লোটে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের ৬০ শতাংশ ইউরোপে ও ২৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে যায়।


২০১০ সালে তীব্র শ্রমিক অসন্তোষের পর তাঁদের সর্বনিম্ন মাসিক মজুরি তিন হাজার টাকা করা হয়। ছোট কারখানাগুলোকে এই সর্বনিম্ন মজুরির বিধান মানতে কড়াভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়। অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান জানায়, তাঁরা সর্বনিম্ন মজুরি হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা দেয়। চীনে এই মজুরি বাংলাদেশের চেয়ে আড়াই থেকে সাড়ে তিন গুণ বেশি।
ইপিজেড এলাকায় অবস্থিত চেরি বডি ফ্যাশনসের মহাব্যবস্থাপক ওয়ালেস চু জানান, হংকংয়ের এই প্রতিষ্ঠানটির ১০ বছর আগে চীনের কারখানায় সাড়ে তিন হাজার শ্রমিক ছিল।

এখন চীনের কারখানায় তাদের শ্রমিক ২০০ আর বাংলাদেশে তাদের কারখানায় শ্রমিক আড়াই হাজার। প্রতিষ্ঠানটি টিকে থাকার তাগিদে এখানে তাদের ব্যবসা আরও সম্প্রসারণ করবেন বলে তিনি জানান।
শ্রমিকদের মজুরি ও কর্ম পরিবেশ উন্নত করার ব্যাপারে পশ্চিমা ব্র্যান্ডগুলোর ক্রমাগত চাপ সম্পর্কে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা মিখাইল শিপার বলেন, তারা সর্বনিম্ন মজুরি বাড়ানোর কথা বলে। কিন্তু তারা বেশি দামে পণ্য কেনার ঘোষণা দেয় না।
তৈরি পোশাক কারখানার এক মালিক জানান, ২০১১ সালে একজন ক্রেতা তাঁকে শার্ট-প্রতি পাঁচ মার্কিন ডলার করে দিতেন।

পরের বছর একই পণ্যের জন্য ওই ক্রেতা সাড়ে চার মার্কিন ডলার করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। দুই বছর ধরে এখানকার তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারীদের অন্তত ৪০ শতাংশ কম মূল্যে কাজ নিতে হচ্ছে।
২০টিরও বেশি কারখানার মালিক আব্দুল মান্নান বেশ ক্ষোভ নিয়েই বললেন, ‘তাঁরা ভিক্ষুকের মতো অর্থ দেবে, অথচ রাজার মতো মান চাইবে। ’
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষিতে যেতে চান না মালিকেরা। কারণ, বড় কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ ফিরিয়ে দিলে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো সেগুলো লুফে নেওয়ার তালে থাকে।


একটি অলাভজনক তদবিরকারী প্রতিষ্ঠান ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে অনেক শ্রমিক সর্বনিম্ম মজুরির চেয়েও কম পান। বোনাসও অনেক কম তাঁদের।
মিনারা নামের একজন পোশাককর্মীর ভাষ্য, জানালাহীন ছোট্ট একটা ঘরে স্বামী আর ১৫ বছরের মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। তাঁর মেয়েও পোশাক কারখানায় সহকারী হিসেবে কাজ করে। মা-মেয়ে মিলে সাত হাজার টাকার চেয়ে একটু বেশি আয় করেন, যার অর্ধেকটাই চলে যায় বাড়িভাড়ায়।

মিনারর দাবি, বিদেশে তাঁর বানানো একটা পোশাক যে অর্থে বিক্রি হয়, তিনি সারা মাস খেটে ওই অর্থ আয় করেন। তাঁর মতে, সরকার যদি এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থ নেয়, যথাযথ মজুরির ব্যাপারে মালিকদেরকে নির্দেশ দেয়, তাহলে তাঁরা আরেকটু ভালোভাবে জীবিকা চালাতে পারতেন।
শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ২০১০ সালে প্রায় তিন হাজার সদস্য নিয়ে শিল্প পুলিশ গঠন করে। শ্রমিক অধিকার কর্মী বুলবুল আখতার বলেন, শ্রমিকেরা দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামলে শিল্প পুলিশ সদস্যরা এসে তাদের কাজে ফিরে যেতে বলে। যদি শ্রমিকেরা তা না করে, তাহলে লাঠিপেটা শুরু হয়।


তবে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম জানালেন, সরকার শ্রমিক ইউনিয়ন সমর্থন করে। সরকার চায়, তারা আরও জোরালো ভূমিকা পালন করুক। একইসঙ্গে তাঁর দাবি, সরকার শ্রমিকপন্থী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ফজলুল আজিমের মতো মালিকেরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার অধিকারী হলেও শ্রমিকদের উন্নয়নে কোনো বিষয়ে সংসদে তাদের আলোচনা করতে দেখা যায় না। বিষয়টি সমর্থন করে একজন কারখানার কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি তাদের কখনো শিল্প-কারখানার বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতে বা বিল উত্থাপন করতে দেখিনি।

’।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.