সংকটকে পুজি করে ব্যাবসা ফেদে বসার প্রতিভায় ড.ইউনুসের যে কোন জুড়ি নেই, সেটা তিনি আবারও প্রমাণ করলেন গার্মেন্টস শ্রমিকদের চলমান কাঠামোগত গণহত্যার (ইউনুস সাহেবের ভাষায় ‘গণমৃত্যু’) প্রেক্ষিতে মালিক শ্রেণী, সরকার এবং বিদেশী ক্রেতাদের ভাবমূর্তি সংকটের মুশকিল আসান হিসেবে ‘গ্রামীণ বা ব্র্যাক পোশাকশিল্প শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট’ এর প্রস্তাবনা হাজির করে। ‘সাভার ট্র্যাজেডি, পোশাকশিল্প ও বাংলাদেশ’ নামে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ড.ইউনুসের প্রস্তাবনা অনুসারে রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে তারা ভাষায় আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে ‘বিশাল ফাটল’ ধরা পড়েছে, তার সমাধান হিসেবে সিটিজেন অ্যাকশান গ্রুপ, ঘন্টায় ৫০ সেন্ট ন্যূনতম মজুরী এবং পোশাক প্রতি বিদেশী ক্রেতাদের ৫০ সেন্ট করে সহায়তায় গঠিত ‘গ্রামীণ বা ব্র্যাক পোশাকশিল্প শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট’ বা ‘অন্য কোনো আন্তর্জাতিক আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান’কে উপস্থাপন করেছেন।
ড.ইউনুসের প্রস্তাবনা অনুসারে- “এই অতিরিক্ত ৫০ সেন্ট দিয়ে যদি আমি উন্নত বিশ্বের কনজ্যুমারদের কাছে পরিচিত ও আস্থাভাজন একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় বাংলাদেশে একটি ‘গ্রামীণ বা ব্র্যাক পোশাকশিল্প শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন করতে পারি, তাহলে শ্রমিকের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তার শারীরিক নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, অবসরকালীন নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সন্তানের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সন্তানের দেখাশোনা, উপার্জন, ভ্রমণ—সবকিছু এর মাধ্যমে করা সম্ভব। ……
কোনো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান যদি বলে, এর ফলে আমার বিক্রি কমে যাবে, আমার লাভ কমে যাবে, তাদের আমি বলব, এর জন্য যাতে আপনার বিক্রি না কমে, বরং যাতে বাড়ে, সে ব্যবস্থাও করা যায়।
আপনার জামায় আমরা একটা ট্যাগ লাগিয়ে দেব: এতে লেখা থাকবে From the Happy Workers of Bangladesh, with Pleasure. Workers wellbeing being Managed by Grameen অথবা BRAC অথবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে সুন্দর একটা লোগো থাকবে, দেখলেই বুঝতে হবে, এই কারখানার শ্রমিকেরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে, উষ্ণতার সঙ্গে, এই জামা তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য অতিপরিচিত এবং আস্থাভাজন একটি প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিয়েছে। ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এটা তাদের বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করতে পারবে। “
গার্মেন্টস এ আগুণ লেগে, ভবন ধ্বসে যখন একের পর এক শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটছে, যখন দেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের বিভিন্ন কাঠামোগত সমস্যা যেমন: শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করতে না দেয়া, কারখানার কর্মপরিবেশ রক্ষায় রাষ্ট্রের ন্যূনতম ভূমিকা না থাকা, মালিকের মুনাফাবাজিতে শ্রমিক নিরাপত্তায় অবহেলা, বিদেশী ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার স্বার্থে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের দাস শ্রমিকে রুপান্তর ইত্যাদি প্রসঙ্গ যখন সামনে আসছে, যখন শ্রমিকরা সোচ্চার হচ্ছে তখন শ্রমিকের ট্রেডইউনিয়নের অধিকার কিংবা রাষ্ট্রীয় তদারকি কঠোর করার বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে বেসরকারি শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট স্থাপনের প্রস্তাবটা গার্মেন্টস মালিক, মালিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী শাসকদের জন্য বেশ স্বস্তি দায়কই হতে পারে!
প্রথমত, কারখানার ভবনের নকশা ঠিক আছে কিনা, ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যাবস্থা যথাযথ কিনা ইত্যাদি শ্রমিক নিরাপত্তা মূলক ব্যাবস্থা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও আইন কানুন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রয়োজন।
এর সাথে অর্থকড়ির সম্পর্ক সামান্যই। ফলে কোন এক গ্রামীণ শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট কে বিদেশী ক্রেতারা কাপড় প্রতি ৫০ সেন্ট করে দিলেই এই কাঠামোগত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এতদিন আমাদেরকে শোনানো হয়েছে, বেসরকারি খাত ব্যাবসা করবে, সরকারি খাত নিয়ন্ত্রণের কাজটা করবে। বেসরকারি খাতের লুটপাট আর শ্রম শোষণে শ্রমিকদের জীবন যখন বিপন্ন , সরকারি খাত যখণ মালিক শ্রেণীর স্বার্থ দেখতেই ব্যাস্ত, তখন আবার বেসরকারিখাতের নিয়ন্ত্রণের জন্য আরেক বেসরকারি খাত, শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্টের কথা বলা হচ্ছে! জনাব, ঐ শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্টকে কে নিয়ন্ত্রণ করবে?
দ্বিতীয়ত, কারখানা জিনিসটা বাংলাদেশে নতুন না, সারা দুনিয়াতেই আছে। সেসব দেশে বাংলাদেশের মতো অবহেলাজাত দুর্ঘটনা(অর্থাৎ হত্যাকান্ড) না ঘটার কারণ বেসরকারিখাতে শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট জাতীয় প্রতিষ্ঠান নয়, বরং শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন।
শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমেই পৃথিবীর দেশে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি মজবুত হয়েছে, মালিকরা বাধ্য হয়েছে কারখানায় নূন্যতম কর্মপরিবেশ বজায় রাখতে। ইউনুস সাহেব তার লেখায় ‘দাসের মত’ শ্রমিকদের নিয়ে এত কাদুনি গাইলেন কিন্তু শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিয়ে একটা কথাও বললেন না!
তৃতীয়ত, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট শ্রমিকদের সকল মুশকিল আসান করবে, তাহলেও সমস্যা হলো তার প্রস্তাবিত এই শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট একটা ঐচ্ছিক ব্যাবস্থা যা বিদেশী ক্রেতাদের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করবে। তীব্র ব্যাবসায়িক প্রতিযোগীতার এই দুনিয়ায় সমস্ত ছোট বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইউনুসের আহবানে সাড়া দিয়ে কাপড়ের গায়ে “হ্যাপি বাংলাদেশী ওয়ার্কার” ট্যাগের বিনিময়ে কাপড় প্রতি ৫০ সেন্ট করে বাড়তি দিতে রাজী হয়ে যাবে, এটা ড. ইউনুসের স্বপ্ন বিলাস ছাড়া আর কিছু নয়। কর্পোরেট স্যোসাল রেসপন্সিবিলিটির নামে দুই একটা বড় প্রতিষ্ঠান হয়তো ইউনুসের ইমেজে আকৃষ্ট হয়ে নিজেদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়াতে এই উদ্যোগে সাড়া দিতে পারে, যা নিয়ে হয় ড. ইউনুস সারা দুনিয়ায় লেকচার দিয়েও বেড়াতে পারেন। কিন্তু তিনি যখন এই দুই একটি দৃষ্ঠান্ত নিয়ে সারা দুনিয়ায় তার স্বপ্ন ব্যাবসা করবেন, তখন দেশের আনাচা কানাচে ছোট বড় কন্ট্রাক্টিং সাবকন্ট্রাক্টিং গার্মেন্টস এর শ্রমিকরা পুড়ে মরবে, ভবন ধ্বসে চিড়ে চ্যাপ্টা হবে।
চতুর্থত, দারিদ্র বিমোচন এবং কর্মসংস্থান যেমন রাষ্ট্রের দ্বায়িত্ব,ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে যেমন এই কাঠামোগত সমস্যার সমাধান হয় না, তেমনি কারখানায় কর্ম পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা, মজুরী ইত্যাদি সম্পর্কিত কাঠামোগত সমস্যা সমাধানেরও দ্বায়িত্ব রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রীয় দ্বায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে, মালিক শ্রেণীর দ্বায়িত্বকে এড়িয়ে গিয়ে কোন বেসরকারি তথাকথিত শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট এর মাধ্যমে এই কাঠামোগত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণ মডেলে আত্মকর্মসংস্থান কিংবা সামাজিক ব্যাবসা দিয়ে দারিদ্র বিমোচন সম্ভব হলে গ্রামের নারীদেরকে গার্মেন্টস পুড়ে কিংবা ভবন ধ্বসে মরতে আসতে হতো না, শ্রম দাস হিসেবে মানবেতর জীবন যাপন করতে হতো না।
পঞ্চমত, ইউনুস সাহেবকে ধন্যবাদ ন্যূনতম মজুরীর কথাটা তোলার জন্য । তবে তিনি যেভাবে ২৫ সেন্ট থেকে ৫০ সেন্ট বাড়ানোর কথা বলেছেন, আমরা এরকম কোন ঐচ্ছিক প্রকৃয়ার সাথে একমত নই। আমরা মনে করি,শ্রমিকের নূন্যতম মজুরী হবে বাচার মতো মজুরী, ফলে একবার মজুরী যা ইচ্ছা তাই বাড়ালেই হবে না, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার দর, শ্রমিক পরিবারের আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বাবদ খরচ হিসেব করে সেই মজুরী নির্ধারণ করতে হবে এবং বছর বছর সমন্বয় করতে হবে।
ষষ্ঠত, ড. ইউনুস প্রস্তাবিত ‘সিটিজেন্স অ্যাকশন গ্রুপ ফর প্রটেক্টিং গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’ গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্বার্থে কাজে আসতে পারে তবে তা ইউনুস প্রস্তাবিত বিদেশী ক্রেতা প্রতিষ্ঠান, বিদেশী সরকার, দেশের ভেতরে মালিক ও সরকার পক্ষের কাছে আবেদন নিবেদন করে চিঠি লেখার মাধ্যমে সেরকম কিছু ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার কোন নাগরিক কমিটি যদি শ্রমিকদের সাথে নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেতে পারে, যদি সরকার ও মালিক পক্ষের উপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে পারে তাহলেই সেটা সত্যিকার অর্থে শ্রমিকে অধিকার নিশ্চিত করতে নাগরিকদের তরফে দ্বায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে। কিন্তু ইউনুসের মতো শ্রমিক আন্দোলনের বিকল্প হিসেবে দাড় করাতে চাইলে নাগরিক কমিটি ওয়াচ ডগের নামে আসলে পোষা বিড়ালই হবে।
ড.ইউনুস তার প্রস্তাবনায় শ্রমিকের ‘শারীরিক নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, অবসরকালীন নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সন্তানের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সন্তানের দেখাশোনা, উপার্জন, ভ্রমণ’- ইত্যাদি যেসব সমস্যার সমাধানের কথা বলেছেন, তা শ্রমিকের অধিকার, বিদ্যমান পুজিবাদি ব্যাবস্থায় যার ব্যাবস্থা করার দ্বায়িত্ব কারখানা মালিকের আর তদারকির দ্বায়িত্ব রাষ্ট্রের। পুজিবাদি রাষ্ট্রের যেখানেই এই সবের ন্যূনতম অধিকার যেখানে যতটুকু আদায় করা সম্ভব হয়েছে, তা হয়েছে শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও মালিক শ্রেণীকে বাধ্য করার মাধ্যমে, ক্রেতাদের দয়ায় কোন বেসরকারি শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে নয়।
যে রাষ্ট্র ব্যাবস্থা শ্রমিকের এই ন্যূনতম অধিকার গুলো নিশ্চিত করতে পারে না, সে রাষ্ট্রের চরিত্র আমুল পাল্টানো ছাড়া উপায় নাই।
ভবনের ফাটলে চুন-সুড়কি গুজে যেমন ভবন ধ্বস ঠেকানো যায় না, তেমনি রাষ্ট্র কাঠামোর বিশাল ফাটলেও গ্রামীণ বা ব্র্যাক পোশাকশিল্প শ্রমিক কল্যাণ ট্রাস্ট জাতীয় প্রতিষ্ঠান গুজে দিয়েও রাষ্ট্র ব্যাবস্থার ধ্বস ঠেকানো যাবে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।