ছুটির জার্নাল
টোকন ঠাকুর
.............................
দেখতে দেখতে দিন পেরিয়ে যায়। পেরোয় মাস, বছর। পেরিয়ে কোথায় যায়? দেখতে দেখতে বাল্যকাল পেরিয়ে যায়। বাল্যকাল কোথায় যায়? পেরিয়ে যাওয়া পথ পেছনে চলে যায়। পেরিয়ে যাওয়া মাঠ কোথায় যায়? পেরিয়ে যাওয়া হাট-নদী-বন্দর-গঞ্জ-শহরও কি পেছনে চলে যায়?
জানলা দিয়ে দেখা মাঠ, মাঠের মধ্যে এক বটগাছ আর বটতলার জীবন_ সবই কি তবে পেছনে চলে যায়? ঘণ্টাধ্বনি বাজলেই চোখ ফেরাই জানলা থেকে।
স্কুল ছুটি। ধুপধাপ বইখাতা গুছিয়ে নিয়ে দৌড়। বাড়ি ফেরার আনন্দ। সেই আনন্দ পেয়েছি বটে, সেই ছুটি পেয়েছি অনেক, তবু মুক্তি মেলেনি। মুক্তির নেশায় বাড়ি থেকে ফের ছুটে বেরিয়ে পড়েছি।
বাড়ি থেকে ছুটি চেয়েছি। শৃঙ্খলা থেকে ছুটি চেয়েছি। নিয়মনীতির বেড়াজাল থেকে ছুটি চেয়েছি। ছুটি চেয়েছি ঘুমোতে ঘুমোতে, হাঁটতে হাঁটতে, দৌড়ূতে দৌড়ূতে। ছুটি চেয়েছি ছুটতে ছুটতে।
তাহলে ছুটছি কোথায়?
কে জানে, হয়তো ছুটছি ছুটির আনন্দের নেশায়! ছুটির আনন্দ? সেই আনন্দ কেমন করে পায় মানুষ, কীভাবে পাই আমি? সেবার স্কুল ছুটির পর গিয়েছিলাম সুহাসিনী গাঁয়ে। জানতাম, সুহাসিনীতে সব্বাই হাসে, কেউ কাঁদে না। কেউ সেখানে মলিন কিম্বা বিষাদগ্রস্ত নয়। কেউ সেখানে ঝগড়া-বিবাদ, কলহপ্রবণ নয়। শুনলাম, সুহাসিনীতে কেউ ছুটি নিতে পারে না।
তাদের জীবনে কোনো ছুটি নেই, তাদের জীবনে কোনো অবসর নেই। তাদের হাসিমাখা জীবন বড্ড সুখের। অতএব, সুখ থেকে কোনো ছুটি নেই। অনন্ত সুখের একেকটি জীবন সেই গাঁয়ের মানুষের একমাত্র নিয়তি। ধুর! তা আবার হয় নাকি? এটা একটা কথার কথা।
সুহাসিনী বলে কোনো গ্রাম আছে নাকি? যদি সুহাসিনী না থাকে তাহলে সেই হাসির গপ্পোও সত্যি না। তাহলে তাদেরও ছুটি আছে। তারাও ছুটি চায়। ছুটি চাই আমরাও। ছুটতে ছুটতে, ছুটতে ছুটতে একদিন ছুটি চাই।
ছুটির আনন্দে ফুটিতে চাই।
২.
সীমান্তরেখার ওপার থেকে আসে হাওয়া। ওপারের হাওয়া আসে এপারে, ছুটিতে। এপারের হাওয়া যায় ওপারে, ছুটিতে। সীমান্তরেখার এপারে দাঁড়িয়ে, বন্দুক হাতে পাহারা দেয় সীমান্তপ্রহরী যেন চোরাচালানির ব্যবস্থা জেঁকে না বসে।
ফলে সীমান্তপ্রহরীর ছুটি মেলে না ইচ্ছেমতো। প্রহরীরা ছুটি চাইলেও কর্তৃপক্ষের অনুমতি আসে না। রাত জেগে বসে থাকে প্রহরী, কোনো দূরগ্রামে রাত জেগে নির্ঘুম থাকে প্রহরীর নববিবাহিত বধূ। কিন্তু স্বামীর তো ছুটি মেলে না। স্বামী তাই ঘরে ফেরে না বহুদিন।
সীমান্তপ্রহরীর জীবনে 'ছুটি' তাই ছুটিমাত্র নয়, অনেক কিছু। কিন্তু জীবন যেমন অনেক কিছু, জীবন তেমন অনেক কিছুই নয়। জীবন হয়তো কিছু কিছু। কিছু কিছু জীবনের দিকে তাকাই আমরা। কী দেখি? দেখি যে, মার্কিন সৈন্য যুদ্ধ করতে আসে বাগদাদে, কান্দাহারে।
সহসা তার ছুটি মেলে না। ছুটি মেলে না বলে মেলে না দেশে ফেরা, যেমন আমাদের শ্রমিকরা যায় দেশে দেশে। ইচ্ছে করলেও তাদের ইচ্ছেমতো ছুটি মেলে না। আমাদের পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা, প্রধানত নারীরা, তাদেরও কি ছুটি আছে? 'যে জীবন দোয়েলের, ফড়িঙের' কত সহজেই তাদের ছুটি মেলে। ডানা মেলে দেয় তারা সর্বদা ছুটির আনন্দে, সেই ছোট্ট দোয়েল-ফড়িঙের জীবনও পায় না আমাদের মেয়েগুলো, মাগুলো, বোনগুলো।
বরং জীবনে বেঁচে থাকার আশায় ছুটিহীন থাকতে থাকতে একদিন তারা কারখানায় আগুন লেগে মরে, কারখানার বিল্ডিং ধসে গিয়ে মরে এবং সেই মৃত্যুই তাদের ছুটি দেয়। সেই মৃত্যুই তাদের মুক্তি দেয়। তবু দেয় কি? যে বোন, যে নারী তার কোলের সন্তান রেখে পুড়ে গেল পোশাকশিল্পের কারখানায় বা চাপা খেয়ে মরে গেল সাভারে, তার সন্তান ও প্রিয়জনদের তো ছুটি মেলেনি! তাহলে 'ছুটি' বলতে যা বোঝায়, যা ধারণা করা হয়, তা কোথায়? নাকি কম মজুরির শ্রমিকের জীবনে ছুটি মানেই মৃত্যু? ছুটি মানে চলমান পৃথিবী থেকে নির্মমভাবে হারিয়ে যাওয়া?
৩.
'মেঘেরও রয়েছে কাজ, মেঘ ছুটি চায়', প্রভু মেঘকে দাও ছুটি। তাহলে কি বলা যাবে, পথেরও প্রয়োজন অবসর, প্রভু পথেরও দাও ছুটি? বলা যাবে, বাতাসেরও ছুটি প্রয়োজন? সূর্যেরও ছুটি প্রয়োজন? নাকি কারো কারো ছুটি আর সহজে মিলবে না, সহস্র আলোকবর্ষ পরেও? ছুটি শুধু মানুষের প্রয়োজন?
'অপূর্ব ছুটি পাইয়া গ্রামে আসিল। মা দেখিল, ইহাই উপযুক্ত সময়।
মা স্থির করিল, কোনোভাবেই আর দেরি করা ঠিক হইবে না। অপূর্ব বড় হইয়াছে। কলিকাতায় চাকুরি করিতেছে। সমস্ত দিক বিবেচনা করিয়া, পাত্রীপক্ষের সঙ্গে কথা বলিয়া মা অপূর্বের বিবাহ সম্বন্ধ ঠিক করিয়া মৃণ্ময়ীর সহিত পুত্রকে আটকাইয়া ফেলিল। কলিকাতার চাকুরি হইতে পুত্র আবার কবে ছুটি পাইবে কে জানে? অপূর্ব আর মৃণ্ময়ীর বিবাহ হইল।
ক'দিন বাদেই, অপূর্বের ছুটি শেষ হইল কিন্তু বধূ মৃণ্ময়ীর সহিত তাহার সে রকম ভাব-ভালোবাসা হইল না। অপূর্ব কলিকাতায় চলিয়া গেল। মৃণ্ময়ী কী ভাবিল, তাহা উপস্থিত কাহারও পক্ষে ঠিকমতো অনুধাবন করা সম্ভব হইল না। অপূর্বেরও মনের অবস্থা আমাদের পক্ষে সেইক্ষণে জানা সম্ভব হইল না। অপূর্ব কলিকাতায় চলিয়া যাইবার পর মৃণ্ময়ীর মনের অবস্থার পরিবর্তন শুরু হইল।
সেই পরিবর্তন যাহাই হউক, অপূর্ব চাকরি করে, তাহার ছুটি ছাড়া সে বাড়িতে আসিতে পারিবে না, সে কথা আমরা জানি। তাহলে মৃণ্ময়ীর কী হইবে? অপূর্বেরই বা কী হইবে? এইসব ভাবিয়া আমরা বুঝিতে পারিলাম, চাকুরির জীবনে ছুটি বলিতে কী বুঝায়? ছুটি না পাইলে কী রকম লাগে?'
৪.
এক বৃদ্ধাশ্রমের গল্প বলি। বৃদ্ধাশ্রমে যারা অবস্থান করছেন, প্রত্যেকেরই বয়স সত্তরের ওপরে। নারী-পুরুষ সবারই বয়স কারো পঁচাত্তর, কারো বা আশি। তাদের কোনো ছুটি নেই।
প্রতিটি দিন বেঁচে পার করতে হয়, খেতে হয়, শুতে হয়, ঘুমোতে হয়। স্বপ্নও দেখতে হয়। স্বপ্ন ছাড়া তো বেঁচে থাকা হয় না। একদিন দেখা গেল, বৃদ্ধাশ্রমের খোলা মাঠে এক অদ্ভুত কাণ্ড। কয়েকজন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা দৌড়াদৌড়ি করছেন।
খুশিতে উৎফুল্ল। কী ব্যাপার? কর্তৃপক্ষ কিছু বুঝে উঠবার আগেই দেখা গেল সেই কাণ্ড। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা দলবেঁধে একসঙ্গে জমায়েত হলেন। পরস্পর হাতে হাত দিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালেন। বৃদ্ধদের দেখে মনে হলো, তারা সব্বাই শেষ বয়সের রবীন্দ্রনাথ, বৃদ্ধারা হয়তো ইন্দির ঠাকরণ।
তারা নাচ শুরু করলেন, গান শুরু করলেন। তারা নাচের সঙ্গে গাইলেন এমন একটি গান, যা শুনলে আমাদের বিশ্বাসই হবে না যে, এই বয়সেও কেউ এ রকম করে গাইতে পারেন, নাচতে পারেন। তারা গাইলেন_ 'মেঘের কোলে রোদ হেসেছে, বাদল গেছে টুটি। / আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি। / কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন্ বনে যাই, কোন্ মাঠে যে ছুুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি।
/... আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি...'
প্রথমত, হয়তো আমাদের বিশ্বাসই হবে না যে, এমনটি হতে পারে। বৃদ্ধাশ্রমের এক দল বুড়া-বুড়ি কি এমন সারিবদ্ধভাবে পরস্পর হাত ধরে গাইতে পারেন_ 'আজ আমাদের ছুটি'?
পারেন। এ রকম একটি দৃশ্যচিত্র আমি স্বপ্নে দেখেছি। দেখেছি, ছুটির জন্য মানুষের কী ব্যাকুলতা, কী ব্যাপ্ত আকুলতা! স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি তার পঁচাত্তর বছর বয়সে এই গান গাইতে গাইতে নেচেছেন জোড়াসাঁকোর বাড়ির ছাদে। এ কথা বলেছিল সনাতন।
সনাতন আমাদের বন্ধু। চিত্রকর। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে আমাদের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেছে আর ছবি আঁকবে না বলে। সুকান্ত ভট্টাচার্য ছুটি নিয়েছেন মাত্র ২১ বছর বয়সে। আবুল হাসান ২৭ বছর বয়সে।
সেই কালো যুবক, প্রেমিক কবি সিরাজুল হাসান মান্নাকে মনে পড়ে। মাত্র ২৩ বছরেই ছুটি নিয়ে চলে গেল পহরডাঙায়?
সম্প্রতি মাত্র ৪৯ বছরেই ছুটি নিয়ে নিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। সত্যি সত্যি বড় চলচ্চিত্রকার। এ রকম ছুটি নেওয়া আমাদের ভালো লাগে না। এ রকম ছুটি দিতে ইচ্ছে করে না।
এ রকম চলে যাওয়া কষ্ট হয়ে বিঁধে থাকে মনে। 'কাঁটা' হয়ে বিদ্ধ হয় আমাদের প্রাণে। চাই, এ রকম ছুটি নেওয়া বন্ধ হোক। দেখতে চাই, ঋতুপর্ণ আবার ছবি বানাচ্ছেন কলকাতায়, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কবিতা লিখছেন ঢাকায়। তারা চাইলেও তাদের ছুটি মিলছে না_ এ যদি হতো।
খুব ভালো হতো। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই তো দেখি, খুব ভালো হয় না, খুব খারাপ হয়। খুব কষ্ট হয়। খুব কান্না এসে গলায় আটকে যায়। এ রকম বেদনাদায়ক ছুটি বাতিল হোক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা রিপোর্ট করছি।
রিপোর্ট গৃহীত হোক, কার্যকর হোক। আমরা বিক্রম সিংকে ছুটি দিতে চাই না, ফালগুনী রায়, অনন্য রায়কে ছুটি দিতে চাই না।
৫.
আমরা কেউ-ই চাইনি, তবু চলচ্চিত্রকার-পর্বতারোহী সজল খালিদ হিমালয়ে গিয়ে ছুটি নিলেন সেদিন। সজল আর ফিরবেন না। তার ছবি 'কাজলের দিনরাত্রি' মুক্তি পাবে হয়তো সহসাই, দর্শক দেখবে, প্রতিক্রিয়া জানাবে কিন্তু সে প্রতিক্রিয়া দেখতে পাবেন না সজল খালিদ।
তার এ রকম ছুটি নেওয়া আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। 'ছুটি'র এ লেখাটি যখন পাঠক পড়বেন সমকালের 'কালের খেয়া'তে, তখন আমিও থাকব পাহাড়ে, সমুদ্রের ধারে। সমুদ্রে স্নান করব, পাহাড়ে উঠব। আমার বাবা-মা ও আমার মামা বর্ষাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াব কয়েকটা দিন। এই বয়সে বাবা-মা তো পাহাড়ে উঠতে পারবেন না, পাহাড়ে উঠব আমি ও বর্ষা।
হয়তো চিম্বুকের উপরে উঠব, নীলগিরিতে থাকব দু'একদিন। থাকব হিমছড়িতে। এই নাগরিক জীবন থেকে কয়েকদিনের ছুটির অবকাশ পালন করব। সত্যি কথা কী, এ রকম ছুটিও ইচ্ছে করলেই মেলে না, আর আমার মা-বাবাও এখন পর্যন্ত টিভি স্ক্রিনের বাইরে সমুদ্র দ্যাখেননি, পাহাড় দ্যাখেননি। তাদের পাহাড়-সমুদ্র দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।
বর্ষাকে বলেছি, 'চল মামা, এই বর্ষায় পাহাড়ে চল, সমুদ্রে চল। ' পাঠক, আপনি পড়ছেন যখন এ লেখা, আমরা আছি সমুদ্রে, আমরা আছি পাহাড়ে। রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার ডেকেছে, তাই ছুটি বের করে নিয়েছি। কয়েকটা দিন ছুটি কাটাচ্ছি... ঝিরিঝিরি হাওয়ায় নিজেদের মেলে ধরতে এসেছি।
তারপর একদিন আমরাও ছুটি নিয়ে চলে যাব এমন এক গন্তব্যে, আর ফিরব না।
তবে সে রকম ছুটির আগে আরও লিখব, ছবি বানাব এবং ছবি আঁকব। ছবি হয়ে থেকে যাব তোমাদের চোখে, লেখা হয়ে রয়ে যাব তোমাদের অন্তরে অন্তরে...
..............
কালের খেয়া, সমকাল, ৭জুন ২০১৩ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।