নিজের সম্পর্কে কিছুই লিখার নাই। আমার নাম আয়েশা আহমেদ। আমি জানি না আমার জীবনে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা আর কারও জীবনে ঘটেছে কি না, আমি জানি না আমাকে যে সব ঘটনার মাঝ দিয়ে যেতে হযেছে, তা আর কাউকে দেখতে হয়েছে কি না। আমি এখন বসে আছি এক দুর্গে, কাপছি অসহ্য ঠান্ডায়। সময় কাটাবার জন্যেই হোক আর আমার কথা সারা পৃথিবীকে জানাবার জন্যই হোক, এই লেখার সুচনা।
আমি জানি না, এ লেখা কোন দিন সভ্য পৃথিবীতে পৌছাবে কি না, যদি পৌছায়, পৃথিবীর মানুষ নি:সন্দেহে একটা বিশাল ধাক্কা খাবে।
বাবা একজন সরকারী কর্মকর্তা সেই সুবাদে দেশের অনেক জেলা ঘুরেছি। আর ঘোরাঘুরি আমার রক্তেই মিশে আছে, আমার ছোট চাচা এই জন্যে জাহাজে চাকরি নিয়েছে। ছোট চাচার সাথে আমিও অনেক জায়গা ঘুরেছি। আমার কাজিন শায়লা আহমেদ।
বড় চাচার মেয়ে। সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় হলেও আমরা ছিলাম বন্ধুর মতোই। আবার আপন বোনের চেয়েও ঘনিস্ট। আপুর সাথেও আমি অনেক ঘুরেছি।
২০০৩ সালের মে মাসের চমৎকার একটা মেঘলা দিনে আমি আর শায়লা আপু ঘরে বন্দী থেকে থেকে একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছি।
আমার HSC পরীক্ষা শেষ হয়েছে, আপুর মাস্টার্স শেষ হয়েছে, রেজাল্টও দিয়েছে। আপু ঢাবি থেকে প্রানিবিদ্যার উপর পড়াশুনা করেছে। আমরা ভেবেছিলাম এই সময়ে অনেক ঘুরবো, প্লান ছিলো কক্সবাজারের ওদিকের জঙ্গলের উপর একটা সার্ভে করবে আপু আর আমি তার সহকারী হবো। কিন্তু নাসাকা আর বিডিয়ারের মাঝে কি যেন সমস্যা হয়েছে তাই কাগজপত্র কিছুই হাতে পাইনি। আর তাই প্রতিদিন দুপুরে আম্মু আর চাচির হাতের বিভিন্ন ব্যর্থ এক্সপেরিমেন্টের নামের অখাদ্য খেয়ে খেয়ে ত্যক্ত বিরক্ত হচ্ছি।
এর মাঝেই এলো সুখবর। আপুর বন্ধু শাহেদ ভাইয়া ফোন দিয়ে বলল ভারতের গোর্খাল্যান্ডে আদিবাসীদের মাঝে অদ্ভুত কিছু চেঞ্জ এসেছে। তারা ঠিক স্বাভাবিক আচরন করছে না। এটা নিয়েই একটা এক্সপিডিশনের ব্যবস্থা করেছেন আন্তর্জাতিক নৃবিজ্ঞানী ডঃ শিধু রায়। শাহেদ ভাইয়া আসলে উনার আন্ডারেই থিসিস করতেছে।
তো শাহেদ ভাইয়া আপুকে বলল তাদের এক্সপিডিশন টিমের সাথে যাবে কিনা। আপু তো এক কথায় রাজি হলো, কিন্তু ওখানে একজন প্রানিবিদ্যার ছাত্রী কি করবে? আপু জিজ্ঞেস করলো। ভাইয়া বলল ওখানে প্রানিবিদ্যার ছাত্রী হিসেবে তার কাজ হচ্ছে এই আদিবাসি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা গুজব রটেছে বিশেষ একটা প্রানী নিয়ে। সেজন্যেই আপু কে দরকার। আপু সন্তুষ্ট হয়ে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো, আমিও সঙ্গী হতে পারি কিনা।
শাহেদ ভাইয়া আমার সম্পর্কে আগে থেকেই জানে। এও জানে আপু গেলে আমিও তার সঙ্গী হবো আর তাই আগেই এসব ম্যানেজ করে ফেলেছিলো।
ফোন কেটে দিয়ে দুই বোন মিলে কয়েক পাক নেচে নিলাম খুশিতে। আমাদের ভিসা আর সব কাগজ ঠিক করতে সময় নিলাম সাত দিন, আর মাঝেই ওখানে যাবার জন্যে দরকারি শীতের পোশাক আর ফার্স্ট এইড কিটের সব কিছু কিনে নিলাম। তারপর এক সন্ধ্যায় চড়ে বসলাম কলকাতাগামী বাসে।
রাতে গান শুনে আর ঘুমিয়ে পার করেছি, দিনে বই পড়ে ঐ অঞ্চলের। এই অভ্যাসটা আমাদের দুই বোনকে শিখিয়েছে আমাদের ছোট চাচা। চাচা বলেন যেখানেই যাও সেখান সম্পর্কে আগে থেকেই জেনে নাও ভালো করে।
গোর্খা নেপাল ও উত্তর ভারতের একটি জাতিগোষ্ঠী। গোর্খা নামটির উৎপত্তি অষ্টম শতাব্দীর হিন্দু যোদ্ধা-সন্ত গুরু গোরক্ষনাথের নাম থেকে।
তাঁর শিষ্য বাপ্পা রাওয়াল রাজপুতানার (রাজস্থান) মেবার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। বাপ্পা রাওয়ালের পরবর্তী উত্তরাধিকারগণ আরও পূর্বে চলে এসে গোর্খা বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
গোর্খাল্যান্ড এটি ভারতের দার্জিলিঙে অবস্থিত একটা পাহাড়ী অধ্যুষিত অঞ্চল। এখানেই রয়েছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের চা বাগান। এই চা বাগান গুলো মূলত ডুয়ারসে অবস্থিত।
আর গোর্খাদের প্রধান ভাষা হচ্ছে নেপালী। গোর্খারা মূলত মঙ্গোলদের উত্তরসূরি। ওরা হাজার বছর আগে তিব্বতের মালভূমি ছেড়ে এসেছে সেখানের নানান রাজনৈতিক অথবা ভিন্ন ভিন্ন কারনে। বর্তমানে গোর্খারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের স্বাধীনতার জন্যে। এমনিতে গোর্খারা অনেক কর্মঠ এবং অতিথিপরায়ন।
আমি নোট নিচ্ছি ওখানকার সম্পর্কে। আর আপু ওখানকার প্রাণীদের সম্পর্কে নোট নিচ্ছে।
এই পুনি শোন ওদিকে আগে বিভিন্ন রকম প্রানী ছিলো। আমার ডাক নাম পুনি। তো আপু আমাকে পড়ে শোনাতে থাকে গোর্খা রাজ্যের প্রানীজ সম্পদের ব্যাপারে।
আমি আপুকে জিজ্ঞেস করলাম কি কি ছিলো? ওখানে আগেকার দিনে সাদা ভাল্লুক, সাদা বাঘ ছিলো। আমি অবাক হই। আর ভাবতে থাকি মানুষের অত্যাচারে পৃথিবী থেকে কিভাবে কমে যাচ্ছে এইসব প্রানী। এরা আমাদের পৃথিবীর ইকো সিস্টেমের জন্যে অমুল্য সম্পদ।
পরের দিন আমরা পৌঁছে গেলাম কলকাতা, সেখান থেকেই রেলে করে দার্জিলিং হয়ে শিলিগুরি, জলপাইগুড়ি।
আর পথে দেখতে থাকি অপরূপ সৌন্দর্য। আমরা দুই বোন যেন হারিয়ে গেলাম অন্য এক পৃথিবীতে। আমাদের এই যাত্রা পথের কোথাও যে সমস্যা হয় নি সেটাই হলো জলপাইগুড়িতে গিয়ে। আমাদের জিন্স প্যান্ট আর টিশার্ট পরিহিতা মেয়েদের ওরা যেন ঠিক ভাবে নিচ্ছে না। কেমন বাকা চোখে তাকিয়ে আছে।
অবশ্য একটু পরেই সন্ধ্যার আলোতে আমরা দেখলাম শাহেদ ভাইয়া চলে এসেছে, উনার সাথেই চলে এলাম এক গোর্খা সর্দারের বাসায়। ওদের মাঝে এখনো সর্দার প্রথা আছে এটা ভেবেই বেশ মজা পাচ্ছিলাম আমি।
ভাইয়া আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন গোর্খা সর্দার কালভোজ এবং ডঃ শিধু রায়ের সাথে। ভদ্রলোক আমাকে দেখেই কেন জানি চমকে উঠলেন এটা আমার চোখ এড়ালো না। আমার ডাক নাম যখন শুনলেন পুনি তখন আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলেন আর এটা আপুও লক্ষ্য করলো।
অবশ্য গোর্খা সর্দার নিজেও আমাকে দেখে চমকে গিয়েছিলো। কেন যে চমকালো এটা আমি জেনেছিলাম মাত্র দুই দিন পর। তখন আমি নিজেও চমকে গিয়েছি। না আমি চমকে যাইনি আমি আসলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম।
সেদিন রাতে বনমোরগের মাংস রান্না করলো গোর্খা সর্দারের বউ, দারুন রান্নার হাত মহিলার।
আপু আর আমি প্রচুর পরিমানে খেয়েদেয়ে ঘুমাতে গেলাম একটু তাড়াতাড়িই। আর হটাত করেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে। আমি দেখলাম আমাকে ঘিরে একদল মানুষ মন্ত্র পাঠ করছে। আর অনেক মানুষ সামনে বসে আছে। আমার গায়ে রাজকীয় এবং বিভিন্ন রকম কারুকার্যমন্ডিত সোনালী রঙের একটা লেহেঙ্গা আর আমার পাশে ছয়জন সহচরী তাদের পরনে সাদা লেহেঙ্গা।
মনে হচ্ছিলো আমাকে সবাই পুজো দিচ্ছে। মনে হচ্ছিলো আমি মানুষ নই, একজন দেবী। আর ঐ মানুষগুলোর মুখে বিচিত্র রঙ বেরঙ্গের নকশা আঁকা। সামান্য নেংটি পরিহিতি মানুষ গুলো চোখে যেন ঘোর লেগে আছে। আমার আরো মনে হচ্ছিলো আমি যেন ওদের উপর অধিস্টিত হতে যাচ্ছি।
আর তারপর দৃশ্যপট বদলে গেলো। আমি দেখলাম অসংখ্য দানব কিংবা মানুষরূপী জানোয়ার যাদের সারা শরীর সাদা লোমে আবৃত। ওরা পড়ে রয়েছে বরফের উপর, কেউ মৃত, কেউ আহত। আর বরফের উপর শুধু জমাট বাধা রক্ত, কি অদ্ভুত একটা ঘ্রান পাচ্ছিলাম আমি। এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
পরপর দুই গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম, আমার অস্থিরতা আপু টের পেয়েছে কিনা জানিনা কিন্তু আপুও ঘুম থেকে উঠে বসলো। তারপর আমাকে বলল কি হয়েছে? আপুকে সব খুলে বললাম। সব শুনে আপু বলল যে প্রানীটা তুই দেখেছিস ওটার নাম হচ্ছে ইয়েতি, বাস্তবে ইয়েতি আছে কিনা এটা প্রমান করা যায়নি তবে হিমালয়ের আশেপাশের মানুষের মধ্যে একটা গুজব আছে এটা নিয়ে। আমি আপুকে জিজ্ঞেস করলাম যেটার নামই শুনিনি সেটা আমি দেখলাম কি করে স্বপ্নে? আপু আমাকে ব্যাখ্যা দেয়ার চেস্টা করলো, হয়তো কোথাও পড়েছিস এখন মনে নেই। আমি তখন আপুকে বললাম তুমি কি আজ দেখেছিলে গোর্খা সর্দার আর শীধু রায় আমার দিকে কেমন তাকিয়ে ছিলো।
এমনকি আজ যত গোর্খা আমাদের দেখেছে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো, অথচ জিন্স টিশার্ট কিন্তু তুমি পরেছো। আপু আমার দিকে চিন্তিত ভাবে তাকিয়ে থাকে। আমি প্রোগ্রাম ক্যান্সেলের ভয়ে তাড়াতাড়ি বলি, থাক বাদ দাও, এটা নিছক একটা স্বপ্ন। আমাদের ঘুমাতে হবে কাল অনেক কাজ আছে তোমার। আপুও সায় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
আমি শুয়ে পড়ি যদিও ঘুম আসে না আমার।
বিঃ দ্রঃ পরের পর্ব রবিবার এই সময়ে দেয়া হবে। আর আমি এখনো এই লেখা এডিট করিনি। কেউ যদি বানান ভুল পেয়ে থাকেন তবে আমাকে শুদ্ধ বানানসহ জানিয়ে যাবেন মন্তব্যে। ধন্যবাদ সবাইকে
পরের পর্ব ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।