বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ খুরশিদা বেগম। ঢাকা তো দূরের কথা- টেকনাফের কেরোনতলী গ্রামের খুরশিদা বেগম নাকি এর আগে কখনও ৭০ কিলোমিটার উত্তরে কক্সবাজার শহরেও যাননি; অথচ ১৭ লক্ষ টাকা মূল্যের জাতিসংঘের পুরস্কার নিতে তিনি এ মাসেই ইতালির রাজধানী রোম যাচ্ছেন। কেন? কারণ এই মহৎ নারী অত্যন্ত সাহসীকতার সঙ্গে তাঁর গন্ডী অতিক্রম করে যে সব অসাধারণ কাজ করেছেন বিশ্বাবাসী তাতে অভিভূত হয়েছে।
পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের রক্ষণশীল প্রত্যন্ত গ্রামের নারীরাও যে পিছিয়ে নেই, বিশ্বের দরবারে টেকনাফের কেরোনতলী গ্রামের এই মহৎ নারী তা প্রমান করেছেন।
খুরশিদা বেগম- এর জন্ম কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে টেকনাফের কেরোনতলী নামে একটি গ্রামে। পরিবারটি দরিদ্র। বাবার নাম লোকমান হাকিম। খুরশিদা বেগম জন্মের পর থেকে গ্রামের সীমানায় গর্জন গাছের গহীন অরণ্য দেখেছেন।
দেখেছেন সে গহীন গর্জন অরণ্যের ঘোর অন্ধকারে হিংস্র পশুর আনাগোনা। ভয়ে গ্রামের মানুষ সে বনে যায় না। তারপর কিশোরী বয়সে দেখলেন মানুষের লোভের কারণে অবস্থা অনেকটা বদলে গেছে। বনদস্যুরা অর্জুনবনে ঢুকে গাছপালা সব কেটে ফেলছে। শিকার করছে হরিণ; বনের পাখি।
এই পরিস্থিতি কিশোরীর মনপূঃত হয়নি। পরিস্থিতি বদলে দেওয়া শপথ নিল কিশোরী। বদলে দিল। তবে আরও কিছুকাল পরে। সেটা গ্রামের যুবক মোহম্মদ ইসলাম এর সঙ্গে বিয়ের পর।
যা হোক। টেকনাফের কেরোনতলী গ্রামে স্কুল নেই। খুরশিদা বেগম এর মনে পড়াশোনা তীব্র ইচ্ছে। টেকনাফ শহরে স্কুল আছে। ক্লাস এইট অবধি পড়লেন সে স্কুলে।
এরপর নেমে এল বিপর্যয়। বাবা মারা গেলেন। সংসারে অভাব-অনটন। পড়ালেখা আর এগুলো না। তারপর আরও কিছু কাল পরে মোহম্মদ ইসলাম এর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল।
খুরশিদা বেগম বিয়ের পর ঘরসংসার করছেন। দুটি ছেলেও হল। কিন্তু, কেরোনতলী গ্রামে স্কুল নেই ... এই ভাবনা তাঁর মনে শান্তি দেয় না। গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা না -করে বনের জ্বালানী কাঠপাতা কুড়ায়। খুরশিদা বেগম কেরোনতলী গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার কথা ভাবলেন।
স্বামী মোহম্মদ ইসলাম কে সে কথা খুলে বললেন। গ্রামবাসীর সঙ্গে এ ব্যাপারে উঠান-বৈঠকও করলেন। কিন্তু, সমস্যা হল গ্রামে স্কুল নির্মাণের জমি নেই। গ্রামের বেশির ভাগ জমিই বনবিভাগের...
খুরশিদা বেগম আজ বাংলাদেশে কিংবা বিশ্বে এক অনুকরণযোগ্য নারী হয়ে উঠেছেন।
কেরোনতলী গ্রামে একটি বেসরকারি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুযোগ এল।
অন্যভাবে। ২০০৪ সাল। টেকনাফ নিসর্গ বনরক্ষা সহব্যবস্থাপনা কমিটি-তে একজন সদস্য হিসেবে যোগ দিলেন খুরশিদা বেগম। এরপর বাঁশে বেড়া ও গোলপাতার ছাউনি দিয়ে তৈরি হল ‘কেরোনতলী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ’ খুরশিদা বেগম এবং তাঁর স্বামী মোহম্মদ ইসলাম বিদ্যালয়ে বিনা বেতনে পড়াতে লাগলেন।
২০১০ সালে স্বামী মোহম্মদ ইসলাম মারা যান। খুরশিদা বেগম আজও বিদ্যালয়টিতে পড়িয়ে যাচ্ছেন। বিনা বেতনে। বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৩০০।
এবার বলি খুরশিদা বেগম কেন ইতালিতে পুরস্কার নিতে যাচ্ছেন।
বনদস্যু দের থাবা থেকে এলাকার বনভূমিকে বাঁচানোর জন্য খুরশিদা বেগম ২০০৬ সালে মেয়েদের নিয়ে একটি 'বন পাহারাদার দল' গঠন করেন। দলটির সদস্য সংখ্যা ২৮ জন। সদস্যরা সবাই কেরোনতলী গ্রামের নারী। এটিই প্রথম বাংলাদেশে মহিলা বন পাহারাদার দল। বোঝাই যায় এই বন পাহারা কাজে প্রথম-প্রথম হাজারও সমস্যা ছিল।
এলাকার রক্ষণশীল লোকজন বাড়ির মেয়েরা বনে পাহারা দিতে যাচ্ছে ... এই ব্যাপারটা একেবারে পছন্দ করত না। তাছাড়া বনদস্যুদের চোরাগোপ্তা আক্রমনে আশঙ্কা ছিল। বন্যপ্রাণির আক্রমনের ঝুঁকি ছিল। তবে এই সাহসী নারী দমে যান নি। গ্রামের মানুষদের বুঝিয়েছেন।
তাদের সঙ্গে বসে উঠান বৈঠক করেছেন দিনের পর দিন । এভাবে ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরি করেছেন।
খুরশিদা বেগম এবং তাঁর নেতৃত্বে নারী বন পাহারাদার দল। এই নারীদলের অধীনে রয়েছে টেকনাফ এর প্রায় পাঁচ হাজার একরেরও বেশি বনাঞ্চল। দলের মেয়েদের কাছে খুরশিদা বেগম আর্দশ।
দলের বয়স্করাও এই মহৎ নারী কে গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করে।
নারী বন পাহারাদার দলটি কঠোর পরিশ্রম করে সকাল-বিকাল পালাক্রম করে বন পাহারা দিয়েছে । এবং এর জন্য তারা কোনও বেতন পাননি। খুরশিদা বেগম এর নেতৃত্বে নারী বন পাহারাদার দলটি ওই এলাকার বন পাহারা দেওয়ার পর থেকে বন থেকে গাছ চুরি বন্ধ হয়েছে। বন্ধ হয়েছে বন্য পশুপাখি শিকার।
খুরশিদা বেগম এবং তাঁর নারী বন পাহারাদার দলের কাজ এলাকার মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। তিনি এলাকার মানুষের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত টেকনাফ সদর ইউপির ৯ নম্বর ওর্য়াড থেকে দাঁড়িয়ে খুরশিদা বেগম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচন করেন । ফলাফল বুঝতেই পারছেন। তিনি চারজন পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন।
এটি খুরশিদা বেগম এর প্রতি এলাকার জনগনের পুরস্কার।
আর বিশ্ববাসীর পক্ষ থেকেও টেকনাফ এর এই ‘এইট পাস’ নারী সম্মানজনক পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন। তিনি এ মাসের শেষে ইতালির রাজধানী রোমে বিশ্বসেরা নারী হিসেবে ১৭ লক্ষ টাকার ‘ওয়াংগারি মাথাই’ পুরস্কার নিতে যাচ্ছেন। পুরস্কার লাভের সংবাদ শুনে খুরশিদা বেগম অভিভূত। তিনি পুরস্কারের টাকা বন পাহারাদার দলের নারীদের মধ্যে ভাগ করে দেবেন।
তাঁর এই অসাধারণ অর্জন সম্বন্ধে খুরশিদা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুরুষশাসিত সমাজে আমাদের মা-দাদিরা আজন্ম গুটিয়ে ছিলেন। সমাজে আজ বড় দুঃসময়। নারীদের এখন পুরুষের সমানতালে এগোতে হবে। ’
ছবি। ইন্টারনেট।
তথ্যসূত্র:
প্রথম আলো। ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২।
Click This Link
Click This Link
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।