আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রসঙ্গ: সালমান শাহ...বেঁচে থাকলে এতদিনে তুমিও লেডিস শাহ হয়ে যেতে

বাংলাদেশী সিনেমার অভিনেতারা তাদের নিজ নাম ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের নামে পরিচিত হন। এদের মধ্যে শাকিব খান সম্ভবত সবচে বেশী পরিচিত। মাত্র চারটে সিনেমায় অভিনয় করে অনন্তও বর্তমানে 'অনন্তা' হিসেবে ট্যাগড হচ্ছেন। হাবিবউল্যাহ নামে একজন বাংলা সিনেমাপ্রেমী ব্লগার যিনি বর্তমানে প্রবাসী তার এই ট্যাগিঙ সংস্কৃতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন - জনপ্রিয় অভিনেতা সালমান শাহ যদি এতদিন বেচে থাকতেন তবে তিনিও 'লেডিস শাহ' নামে পরিচিত হয়ে যেতেন। তিনি তার এ মন্তব্যের ব্যাখ্যাও করেছেন যার সাথে দ্বিমত পোষন করে বিভিন্ন রকম মতামত অন্যান্য ব্লগাররা জানিয়েছেন, তারা বাংলাদেশী সিনেমা সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যা তুলে ধরেছেন।

দর্শকের ট্যাগিং প্রবণতার কারণ চিহ্নিত করতে পারলে উত্তর পাওয়া সহজতর হবে - এমনটা বিশ্বাস করি। এক্ষেত্রে প্রধান প্রশ্ন হল, দর্শক কেন বাংলা সিনেমার নায়কদের বিভিন্ন ট্যাগে ভূষিত (!) করেন এবং কেন করেন না? মূলত, এই পোস্টে বাংলাদেশী সিনেমার অভিনেতাদের ট্যাগ করার কারণ খুজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, সালমান শাহ সম্পর্কে প্রায় একই রকম মন্তব্য পূর্বের একটি পোস্টে করেছিলাম। প্রয়োজনে সেই পোস্টটিও পড়ে নেয়া যেতে পারে। বাংলা সিনেমার দর্শকদের কেউ কেউ অভিনেতাদের বিভিন্ন শব্দে ট্যাগড করেন, কেউ করেন না।

কেন করেন? কেন করেন না? করেন, কারণ অভিনেতারা ট্যাগড হওয়ার মত কাজ করছেন। করেন না, কারণ অভিনেতারা ট্যাগড হওয়ার মত কাজ করছেন না। একই অভিনেতার জন্য দুই ধরনের মতামত দেখা যাচ্ছে, এর কারন সেই লোকটা নন, বরং যারা মন্তব্য করছেন তারা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, একই দর্শক একই ব্যক্তিকে একবার ট্যাগড এবং আরেকবার আনট্যাগড করেন না। অর্থ্যাৎ, দর্শক মানসিকতার বিভিন্নতার কারনেই এই ট্যাগড বা আনট্যাগড পরিস্থিতি।

দর্শক মানসিকতার একটা ব্যপক পরিবর্তন ঘটে গেছে গত দশ বছরে, অশ্লীলতা যুগের আগে ও পরের সময়ে। তখনও সিনেমার অভিনেতার সমালোচনা হত, প্রায় নিরীহ কিছু ট্যাগিং ও চলতো, কিন্তু যারা ট্যাগ করতো তাদের নিজেদের পছন্দেরও একজন অভিনেতা থাকত, ফলে ট্যাগিংটা হত অনেকটা প্রতিপক্ষকে আক্রমনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বর্তমান সময়ে, ট্যাগিংটা হয় গনহারে - প্রায় সব বাংলাদেশী সিনেমার অভিনেতার প্রতি। মাত্রাছাড়া এই ট্যাগিং এ যারা লিপ্ত তারা নিয়মিত বাংলা সিনেমার দর্শক, তা নয়, বেশীরভাগের দৌড়ই ইউটিউবে, টেলিভিশনে, বা ল্যাপটপে সিনেমার ক্লিপ পর্যন্ত, সম্পূর্ন সিনেমাও নয়। প্রশ্ন হল মানসিকতায় কি এমন পরিবর্তন ঘটলো যে ট্যাগিং-করার মত যোগ্য (!) অবস্থানে আসীন হয়েছে বাংলাদেশী সিনেমার অভিনেতারা? ব্যক্তিগতভাবে কারিগরী দিক, গল্প, অভিনয়, পরিচালনা দক্ষতা ইত্যাদি দৃষ্টিকোন থেকে বিশ বছর আগের সিনেমার সাথে বর্তমান সিনেমার খুব পার্থক্য দেখি না।

আগের সিনেমা অনেক ভালো ছিল, এখনকার সিনেমা অনেক খারাপ - এমনটা নয়। আগে সিনেমা দেখতে যাওয়াকে যতটা খারাপ মনে করা হত, এখন বাংলাদেশী সিনেমা দেখতে যাওয়াকে তার চেয়ে অনেক বেশী খারাপ মনে করা হয়। আমার দৃষ্টিতে এই কারনেই দর্শক মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে, ট্যাগিং-প্রীতি বেড়েছে। এবং, মানসিকতার এই পরিবর্তনে 'অশ্লীল সিনেমার যুগ' একটা ভালো ভূমিকা রেখেছে। এমন না যে বেশীরভাগ দর্শক কখনোই, আড়ালে বা প্রকাশ্যে, নোংরা ছবি দেখেন না।

অশ্লীল যুগের নোংরা ছবির তুলনায় অনেক বেশী নোংরা ছবিও দেখার সুযোগ বর্তমানে আছে, অনেক দর্শক তা গ্রহণও করেন। কিন্তু প্রকাশ্যে নোংরা ছবি দর্শনের যে সামাজিক প্রভাব তা একাকী দর্শনের বেলায় খাটে না এবং সিনেমাহলে গিয়ে নোংরা ছবি উপভোগের অভ্যাস-কে স্বাভাবিকভাবেই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা শুরু হয়। পরবর্তীতে, হলে গিয়ে 'নোংরা বাংলাদেশী সিনেমা' নয় বরং হলে গিয়ে 'বাংলাদেশী সিনেমা' দেখাটাই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর আওতায় চলে আসে। এই দৃষ্টিভঙ্গী-ই বর্তমান সময়ে গনহারে ট্যাগিং-প্রীতি তৈরী করেছে বলে ধারনা করছি। ফলে, হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখাটাই এখন নেতিবাচক, সে সিনেমায় 'নোংরা দৃশ্য' কি পরিমান আছে বা নেই, সেটা মূখ্য নয়, বরং, 'লোকে কি বলবে' তা এখন অনেক গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠেছে ব্যক্তিমানুষের কাছে।

পুরোপুরি, অশ্লীল সিনেমার উপর দোষ চাপিয়ে দেয়াও অন্যায় হবে। প্রযুক্তিগত উন্নতি ও সহজলভ্যতাকে এ ক্ষেত্রে অংশীদার করে নেয়া যেতে পারে। অশ্লীল যুগ শুরু হওয়ার বেশ কয়েকবছর আগেই ডিশ এন্টেনার ব্যবহার শুরু হয়েছিল দেশে এবং অশ্লীল যুগের সময় এর ব্যবহার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সিনেমা দেখার জন্য দর্শকের যে আগ্রহ, তা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, ফলে আগ্রহ পরিতৃপ্তির জন্য ভিন্ন পন্থা টেলিভিশনকেই বেছে নিয়েছে দর্শকরা। বর্তমান সময়ে ডিশএন্টেনা বা কেবল কানেকশন টেলিভিশন সেট থেকে ভিন্ন কিছু নয়।

কেবল কানেকশন ছাড়াও ভিসিপি/ভিসিআর/ভিডিডি প্লেয়ার/ডিভিডি প্লেয়ার এক্ষেত্রে ভালো ভূমিকা রেখেছে। ডিশ এন্টেনা এবং এ সকল প্লেয়ারের মাধ্যমে ভারতীয় সিনেমার পাশাপাশি ইংরেজি সিনেমাও দর্শক তালিকায় স্থান পেয়েছে। সর্বশেষ, কম্পিউটার ইন্টারনেটের ব্যবহার দর্শক তালিকা থেকে বাংলা সিনেমাকে প্রায় পুরোপুরি বাদ দিয়েছে, অনেক দর্শকের তালিকা থেকে ভারতীয় সিনেমাও বাদ পড়েছে, সেখানে জায়গা করে নিয়েছে হলিউডের সিনেমার বাহিরে ইউরোপিয়ান ও ওরিয়েন্টাল সিনেমা। ফলে, কোন দিক থেকেই এই সকল সিনেমার সমপর্যায়ে উন্নীত না হওয়া বাংলাদেশী সিনেমা-র প্রতি বিমুখ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। শুরুতে বলেছিলাম, বিশ বছর আগেও ট্যাগিং হত এবং যারা করতো তাদের নিজ পছন্দের কোন অভিনেতা থাকতো এবং অনেকটা আক্রমনের উদ্দেশ্যে বা অন্যের তুলনায় নিজ পছন্দের অভিনেতার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে।

এই মানসিকতা এখনো বর্তমান - বিশেষ করে রিয়েল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফুটবল খেলার উদাহরনগুলো দেখলে বোঝা যায়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশী সিনেমার বিপক্ষে আছে ভারতীয় সহ প্রায় সকল দেশের সিনেমা। এই ট্যাগিং কর্মের পেছনে আছে পছন্দের সিনেমার শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ, আছে আক্রমণের উদ্দেশ্য। এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ। দর্শক হিসেবে আমার চাওয়া যাই হোক না কেন, সিনেমার নির্মাতারা বোঝেন ব্যবসা।

প্রায় কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিতে যদি ব্যবসা সম্ভব হয় তবে কেন বেশী ঝুঁকি নেয়া? অশ্লীল যুগ বলেন আর বর্তমান, ছবিগুলো কম বেশী ব্যবসা করেছে, রোমান্টিক ছবি সামাজিক ছবির তুলনায় বেশী ব্যবসা করেছে এবং করছে - সুতরাং প্রযোজকের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এই পরিবর্তনটা খুব প্রয়োজনীয় নয়। অধিকতর ঝুঁকি নিয়ে ভিন্ন কিছু করার মাধ্যমে যদি কোন প্রযোজক ব্যবসা করে উদাহরণ তৈরী করতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে আরও লোক এগিয়ে আসবে - বর্তমান সময়ে ঠিক তাই হচ্ছে। ডিজিটাল মাধ্যমে অনেকগুলো সিনেমা তৈরী হচ্ছে যার গতানুগতিক বাণিজ্যিক সিনেমার চেয়ে প্রায় সব দিক থেকেই ভিন্ন। হচ্ছে, কারণ আগের ডিজিটাল সিনেমাগুলো পুজি তুলে এনে ব্যবসার ক্ষেত্র দেখিয়ে দিয়েছে। সিনেমাহলে পরিবেশ নিয়ে নানা মত আছে।

পরিবেশ উন্নত করা দরকার - খুবই যৌক্তিক দাবী। বাস্তবতা হল, সিনেমাহল গুলো এত ব্যবসা করে না যে হলগুলো যত্ন পরিচর্যা চালিয়ে যেতে পারবে। আমি হলেই যাই না, তাহলে ব্যবসা হবে কোত্থেকে? হলে যাওয়া শুরু করি, ব্যবসা হওয়া শুরু হবে, সার্ভিসের মানও উন্নত হতে থাকবে। সুখের বিষয়, সরকার এ ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগে সহযোগিতা করছে। ভালোমানের সিনেমা হলে ভালো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু দর্শক হিসেবে আমি দেখতে যাই নি, যেতে পারিনি - এরকম ঘটনা প্রচুর ঘটে।

ভালো সিনেমার সংজ্ঞা নিরূপনে যদি গতানুগতিক বাণিজ্যিক সিনেমার কথা মাথায় রাখা হয়, তবে ভালো সিনেমা চিহ্নিত করা সহজ হবে। কিন্তু ভালো সিনেমার সংজ্ঞায়নে ইউরোপ-আমেরিকা-ভারতীয় সিনেমাকে আদর্শ রাখলে ভালো সিনেমা চিহ্নিত করতে আমাদের আরও এক যুগ অপেক্ষা করতে হতে পারে। সার কথা একটাই, যদি আমি দর্শক হই, তবে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির উন্নয়নে আমার কর্তব্য হল অপেক্ষাকৃত ভালো সিনেমাগুলো হলে গিয়ে দেখা, বন্ধুবান্ধবকে সাথে নিয়ে দেখতে যাওয়া। আর আমি যদি নির্মাতা হই? আমি তো জানি-ই দর্শক কি চায়। সবশেষে সেই একই কথা - আগুনের দিন শেষ হবে একদিন, ঝর্ণার সাথে গান হবে একদিন।

গুডলাক বাংলাদেশী সিনেমা। [পোস্ট নয়, হাবিবউল্যাহ ভাইয়ের পোস্টে একটি মন্তব্য হিসেবে লিখেছিলাম, পোস্ট আকারে প্রকাশিত হল। ] দারাশিকো ডট কম এ আমন্ত্রন ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।