আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাগদা তো-ভ রাশিয়া-১৩(দ্বীতিয় খন্ড শেষ পর্ব)

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! অনেকেই নিয়তি বা ভাগ্যকে বিশ্বাস করেননা- তার পিছনে অবশ্যই তাদের বিশেষ যুক্তি আছে। আমার রাশিয়ার জীবনে কিন্তু দূর্ভাগ্যের এই সময়টুকু আমাকে নিয়তি বা ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল। একেরপর এক ঘটনাগুলো কেন যেন সাজানো নাটকের মত মনে হচ্ছিল। কোন এক অদৃশ্য শক্তি আমাকে যেন সম্পূর্নরুপে-রিক্ত নিঃস করে দিতে চাচ্ছে। কেন কি জন্য কে জানে -হয়তো ভবিতব্যই বলে দিবে? ঠিক হল তাই-এর পরের আঘাতটা আমাকে যেন ভিখেরী বানিয়ে ফেলল; শীতের শেষ বাইরে বরফ গলতে শুরু করেছে।

নিজের ভারী বুট জুতোটা রেখে পাশের রুমের এক বন্ধুর কেড্স খানা ধার করলাম ভেজা রাস্তায় হাটতে সুবিধা হবে ভেবে। হোটেলের অনতি দুরেই এক বাসায় দাওয়াত ছিল। গল্প খাওয়া দাওয়া নাচ গান শেষে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হল। হোটেলের মুল দরজা খুলে ভিতরে উকিইদয়ে দেখি ম্যানেজার মহিলা কান্টারেরর উপর মাথা রেখে ঘুমুচ্ছেন । যাক বাঁচা গেল! উনি জেগে থাকলে একগাদা প্রশ্নের উত্তর দিতে হোত? যদিও সেগুলো জেরা নয়; বন্ধু সুলভ , কোথায় গিয়েছিলে? কেমন আড্ডা হোল? এত রাতে ফিরতে সমস্যা হয়নিতো? এইসব।

তবুও ভাল লাগছিলনা এত রাতে ভ্যাজর ভ্যাজর করতে। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে । কোমতে রুমে গিয়ে শুতে পারলেই বাঁচি। পা টিপে টিপে লিফটের কাছে এগিয়ে গিয়ে লিফটের বোতাম চাপলাম। রুমের বন্ধ দরজার সামনের আধো অন্ধকার প্যাসেজে দাড়িয়ে পকেট হাতরে চাবি বের করে কি হোলে লাগাতে গিয়েই বুকের ভিতরে ছ্যাত করে উঠল ‘আরে এখানে দেখি বড় একটা গর্ত বা হাত দিয়ে দরজাটা আলতো করে চাপ দিতেই হাট করে খুলে গেল!’ দ্রুত রুমে ঢুকে কাঁপা হাতে লাইট অন করতেই ভীষন রকম চমকে উঠলাম! কিচ্ছু নেই- সব নিয়ে গেছে! হায় দামি জিনিসপত্রতো গেছেই এমনকি অন্তর্বাস, মোজা থেকে শুরু করে বাংলা গানের ক্যাসেট পর্যন্ত ।

’ ঠিক তখনকার অনুভুতি এখন প্রকাশ করা সম্ভব নয়। শুধু এটুকই বলতে পারি বিধ্বস্ত ক্লান্ত বিষন্ন বিস্মিত হতাশ কোন চিৎকার চেঁচামেচি করলাম না-কাউকে ডেকে তুললামনা। কোন অনুযোগ নয় কোন অভিযোগ ক্লান্ত পায়ে ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে কোন মতে সেখানে বসে দু'হাতে মুখ ঢেকে বসেছিলাম ভোর অব্দি! কি ভয়ানক নিঃসঙ্গ বিষন্ন সে রাত! ভাগ্যের কি নির্মম করুন পরিহাস! সব-সবকিছুই হারালাম আমি। পায়ের জুতাখানাও ধার করা। বন্ধুদের একাংশ পরামর্শ দিল; পুলিশের কাছে যেতে আরেক অংশ নিষেধ করল কেন,না আমার নতুন পাসপোর্ট পেলেও এখনও ভিসা লাগেনি, উল্টো আমিই হয়রানির স্বীকার হব।

অগত্যা হোটেল কতৃপক্ষকে ধরে অন্য বোর্ডারের নাম করে পুলিশ ডাকানোর ব্যাবস্থা হল। পুলিশ এলে তারা বলবে যে ঐ রুমের বোর্ডার রুম তালা মেরে কিছু দিনের জন্য অন্য শহরে গেছে-এই ফাকে তস্কররা চুরি করে পালিয়েছে। পুলিশ ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই প্রকৃত অপরাধীদের না পেলেও দোসরদের বের করে ফেলল । ওরা এ হোটেলেই থাকে জাতিতে ‘গ্রুজিন ’মানে জর্জিয়ান। মারের চোটে তারা স্বীকার করল তাদের বন্ধুরা সব মালপত্র নিয়ে এতক্ষনে ট্রেনে করে জর্জিয়া চলে গেছে! অনেক দেনদরবার শেষে তারা রাজি হল বন্ধুদের পক্ষ হয়ে কিছু ক্ষতি পুরন দিতে।

কে দিল কত দিল আর কে নিল কত নিল তা আমি জানিনা। সব হয়েছিল পর্দার আড়ালে তবে আমার ভাগে সর্বসাকুল্যে পরেছিল শ’খানেক ডলার! টাকাটা হাতে পেয়ে আমার চোখে জল এসে গেল এটা দিয়ে আমি কি করব? বর্তমান রাশিয়ায় অবিশ্বাস্য উর্ধ্বমুখী এই আকড়ার বাজারে একপ্রস্ত জামা জুতো কিনতেই এই টাকা বেরিয়ে যাবে! থাকা খাওয়ার খরচ তখনও সহনসীল পর্যায়ে কিন্তু পোষাকের দাম সে তুলনায় আকাশচুম্বী! ‘ও গসপেদী’...(ও ঈশ্বর)!!! তখন আমার মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা! নিঃস্ব তো হয়েইছি নিজেকে আরো বেশী নিঃস্ব করার অভিপ্রায় একরাতে সে টাকা উড়িয়ে দিলাম। সেই ভয়ঙ্কর রাতেই প্রথম এলকোহলের স্বাদ গ্রহন। ভদকা গিলতে চেষ্টা করেছিলাম - উরে বাবা! গন্ধে নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসতে চায়! আর বিয়ার ছ্যাঃ কি তেতো-এই পানীয় মানুষ কেমনে খায়? অগত্যা বাকি সবার তাচ্ছিল্য আর বক্র হাসিকে তুচ্ছ করে দু'বোতল শ্যাম্পেন সন্ধ্যা থেকে মাঝ রাত অবধি একাই পান করেছিলাম। মাতাল হয়েছিলাম কি না বলতে পারিনা-তবে শান্তি পেয়েছিলাম।

একরাতে সবগুলো টাকা উড়িয়ে দিয়ে -কি ভীষন হালকা বোধ হচ্ছিল-গায়ের পোষাক খুলে দিগম্বর হয়ে ঘুরতে পারলে মনে হয় আরেকটু মজা পেতাম... সেদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা পরে অনেক ভেবেছি কিন্তু কোন কুল পাইনি । সেই চুরির ঘটনাটা ছিলকি কোন ফ্লুক না সাজানো ? কেননা আমাদের ফ্লোরটাতে শুধু আমরা বাঙালীরা আর সবার থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে থাকতাম । এই ফ্লোরে অন্যান্য বোর্ডাররা প্রায় আসেনা বললেই চলে । শুধু দু পাচজন আজারবাইজানী যারা আগ বাড়িয়ে আমাদের সাথে বন্ধুত্ব করে। অনেকটা আব্দার করেই রুমে আসে খেতে চায় কিন্তু কোন জর্জিয়ানের সাথে এখানে কারো বন্ধুত্ব হয়েছে বলে শুনিনি ।

সমগ্র রাশিয়ায় দুটো জাতির দুর্নাম বেশী বিশেষ করে এধরনের ছোট অপরাধে তারা শীর্ষে । এক জিপসী বেহেমিয়ান যাযাবর জাতি(সেগান) যাদের চেহারার আদল ভারতীয়দের মত ‘আমাদের দেশের বেদেনীদের মত তারা বিভিন্ন ছলাকলা হাতসাফাইয়ে পারদর্শী। দুই -আজারবাইজানী । সেই তুলনায় জর্জিয়ানদের কোন বদনাম নেই বললেই চলে । ওরা যদি চুরি করবেই তবে আগে ভাগে কি করে জানবে আমার ওই ছোট্ট রুমটাতেই সবচেয়ে বেশী মালপত্তর আছে -আর আমি সেই রাতে বাইরে যাব আসতে দেরী হবে? ওরা নিশ্চই রাতের প্রথম প্রহরে চুরি করেনি- কেননা পুরো হোটেল তখন জেগেছিল ।

কাজ সেরেছে আমি আসার কিছু আগে। তবুও এতগুলো ছেলের কি কেউই তখন জেগে ছিলনা?ক'দিন আগেই আমার এক বন্ধু জার্মানীতে বেড়াতে যাবার আগে তার পোষাক আষাক শুদ্ধ ভারি দুটো স্যুটকেস রেখে গিয়েছিল আমার জিম্মায়। কাপড় চোপড় সহ অন্যান্য জিনিসের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু আমার সেই দৈতাকৃতির প্রায় তিনমন ওজনের ভারী দুটো স্পিকার নিয়ে তারা কিভাবে পালাল? এমনও হতে পারে এসব হয়েছে যোগ সাজসে,যার মুল হোতা আমারই দেশী ভাই আর চুরি করেছে আজারবাইজানীরা। যেই জর্জিয়ান গুলোকে পুলিশ ধরেছে তাদের নিশ্চই কাগজ পত্রে কোন সমস্যা ছিল সেজন্যই বড় বিপদের হাত থেকে বাচার জন্য কল্পিত মাতাল বন্ধুদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দুয়েকশ ডলার জরিমানা দিয়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে এখনও সেই ঘটনাটা রহস্যই থেকে গেছে! কাকে দোষী কর?ব সবার দিকে তাকিয়েই মনে হত না না এ একাজ করতে পারেনা এতো আমার সবচেয়ে সত্যিকারে শুভাকাঙ্খী বন্ধু... দ্বীতিয় খন্ড শেষ পর্ব। আগের পর্বের জন্য; Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।