আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাগদা তো-ভ রাশিয়া-৯

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! আমার প্রথম হাজতবাস অত মন্দ হয়নি! দু'দিকে ছাদ উচু বেশ মোটা শিক দিয়ে ঘেরা অল্প পরিসরের বেশ খোলামেলা হাজতখানা। শীতের দিনে বাতাসের দরকার কার-ইবা আছে তবে প্রচুর আলো ছিল সেখানটায়। হাততের মধ্যে আমার সাথে জনা ছয়েক বাংলাদেশী আর দুজন মাত্র আজেরবাইজানী যুবক। আমাদের সবার চোখে মুখে অসহায়ত্ব আর ভয়ের ছায়া থাকলেও ওদের ভয়হীন চেহারা ভীষন বিরক্ত মনে হচ্ছিল। অনুচ্চস্বরে রাশিয়ার পুলিশের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে গালিগালাজ করছিল।

আজেরবাইজানে আমার অনেক বন্ধুরা থাকলেও আমার কখনো যাবার সৌভাগ্য হয়নি। আমি রাশিয়ার ও উক্রাইনে যেসব আজেরবাইজানী পুরুষদের দেখেছি(পাঠক চাইলে আমার এই লেখাটা পড়তে পারেন; এক ওসমান-আজেরবাইজানী যুবকের কথা)তাদের বেশীরভাগের-ই যেন কথার ফাঁকে দু'চারটে অশ্লীল শব্দ না বললে যেন খাবার হজম হয়না। রুশ ভাষাটা গাপ-গুপ করে কিছুটা বিকৃত করে বলে! বেশীরভাগ আজেরবাইজানী পুরুষদের রাশিয়ানদের সাথে যেন ঠিক সাপে-নেউলে সম্পর্ক! সলপ বসনা কোন রুশ তরুণীকে দেখলে বেশ স-শব্দেই টিজ করে। রাশিয়ানরা সভ্য জাতি-ওদের পছন্দ না করলেও মুখ ফুটে প্রকাশ করেনা- কপাল কুচকে কিংবা হাত বাতাসে ঘুরিয়ে তাচ্ছিল্য করে! কিন্তু ওদের সেই লাজ শরম নেই! আমাদের হাজতের গা ঘেষেই জনা চারেক পুলিশ আড্ডায় মশগুল। আজেরবাইজানী দুই যুবকদের নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই-মাঝে মধ্যে হেসে হেসে আমাদের সাথে গল্প করছে।

এখানে আমি ছাড়া বাকি সবাই সদ্য আসা আদম(এরা অন্যদেশে ডাঙ্কি দেবার ধান্দায় এদেশে এসেছে)। ব্যাপারী সময় মতো পার্সেল করতে পারেনি বলে ওদের পাসপোর্ট এর ভিসা শেষ হয়ে গেছে। স্বভাবতই তাদের ভাষা জ্ঞান শুধুমাত্র দা- নিয়েত এ সীমাবদ্ধ! গল্প গুজব যা হচ্ছে মুলত আমার সাথে-আমার পাসপোর্ট হারানোর গল্প শুনে তারাও মনে হল বেশ ব্যাথিত। কিন্তু আইন বলে কথা; চাইলেও আমাকে কিংবা আমার মত অন্যদেরকে এ মূহুর্তে ছেড়ে দিতে পারছে না। রাশিয়ার শীতকালে সন্ধ্যেতো সারাদিন-ই।

তবুও দীর্ঘ আট ঘন্টা হাজতবাসের পরে ছাড়া পেলাম সময় হিসেবে সন্ধ্যে নাগাদ! বন্ধুদের দেন দরবার আর কিছু উৎকোচ দিয়ে ভাশেষে মুক্তি মিলল। ফিরে আসার সময়ে ওদেরকে অনুরোধ করলাম,ফিরে আসার সময় একগাদা ধন্যবাদ দিয়ে অনেক বিনয় করে ওদের অনুরোধ করলাম এখানে সপ্তাখানেক থাকার অনুমতি সাপেক্ষে একটা পারমিশন পেপার দিতে? কেননা পাসপোর্ট পেতেতো নিদেন পক্ষে সপ্তা খানেক সময় লাগবেই তদ্দিন যেন ‘খোলে আম মে ঘুমতে পারি। ’ ওরা হেসে বলল‘আমাদের আইন বড় সাংঘাতিক হে ভায়া! টোকেন ফোকেন দেয়ার কোন সিস্টেম নেই। ভিসা ছাড়া তুমি এখানে থাকতে পারবে না বের হতেও পারবে না--বোঝ ঠ্যালা! এখান থেকে বের হয়ে রাস্তায় আবার আরেক পুলিশের খপ্পরে পড়লে ফিরে এই হাজতেই ঢুকতে হবে আল্লা-খোদার নাম নিতে নিতে যাও যাতে অন্য পুলিশের খপ্পরে না পড়। পরিস্থিতি যতটা ভয়াবহ ভেবেছিলাম তার থেকেও দেখি কয়েকগুন খারাপ! পরে অনেক ঘুরেছি ওদেশ থেকে বেরিয়ে আসার একটা ছাড়পত্র পেতে কিন্তু সে চেস্টা ছিল নিস্ফলা।

আবার সেই হোটেলেই ফিরে আসলাম। রিসেপশন কাউন্টার থেকে ফোন করলাম মস্কোর এক প্রভাবশালী বড় ভাইকে(তিনি এখানকার অনেকেরই গড ফাদার ছিলেন তখন)। তিনি আমাকে সবিশেষ স্নেহ করতেন। খবর পেতেই তিনি ছুটে আসলেন। ভদ্রণোক তার তার প্রভাব খাটিয়ে সপ্তাখানেকের মধ্যে পাসপোর্ট পাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ম্যানেজার মহিলাকে রাজী করালেন।

অবশ্য রাজী না হয়ে মহিলার উপায় ছিলনা কেননা এই হোটেলের শতাধিক বাঙ্গালীর প্রায় সবাই ইঁনার বিশেষ ভক্ত। ইনি অনুরোধ তার অনুরোধ আদেশের মত ছিল)করলে একঘন্টার মধ্যে সবাই রুম ছেড়ে অন্য ঠিকানা খুজে নিবে। সিঙ্গেল বেডের একটা রুম অবশেষে ম্যানেজ হল। মালদোভিয়া বেড়াতে যাবার সময় আমার কয়েক বন্ধুর রুমে বিশাল লটবহর ভাগ করে রেখে গিয়েছিলাম । তন্মধ্যে একটা রাশিয়ার বিখ্যাত বেগা ডেকসেট ছিল- যার দুটো স্পিকারের ওজনই ছিল প্রায় ষাট কেজির মত।

এছাড়া অনুবিক্ষন যন্ত্র টেলিস্কোপ, প্রজেক্টর সহ পোষাক আশাক ভর্তি তালামারা এক বিশাল স্যুটকেস এনে জড় করলাম সেই রুমটায়। নিজের আলাদা একখানা রুম পেয়ে অবসরে একেলা আমার পরবর্তী কর্মযজ্ঞ নিয়ে ভাবতে বসলাম; পুরোনো পাসপোর্ট ফিরে পাওয়ার কোন আশা নেই বললেই চলে সেহেতু নতুন একটা পাসপোর্ট করতে হবে। আমি এমন মহা আহাম্মুক যে, পাসপোর্ট থেকে শুরু করে অন্য কোন ডকুমেন্টের-ই কপি রাখিনি! হয়তো ভেবেছিলাম আমি না হারালে এইগুলো হারানোর কোন শংকা নেই। মলদোভিয়া যাবার আগে বেশ বড় একটা ক্যাচাল হয়েছিল আমার পুরনো ভার্সিটির সাথে। সেই প্রসংগে দুটো কথা না বললেই নয়;আমাদের প্রথম ও দ্বীতিয় বর্ষের যে টিউশন ফি ছিল তৃতিয় বর্ষে এসে সেটা আচমকা চার গুন বেড়ে গেল! অতি অল্প খরচে উচ্চশিক্ষার লোভে কিংবা অতি সহজ লভ্য রুশীয় নারী আর মদের আকর্ষনে বিভিন্ন দেশ থেকে বানের জলের মত শিক্ষার্থীরা ঢুকছিল রাশিয়াতে।

তাদের অনেকেই মস্কো কিংবা পিতারবূর্গে সুযোগ না পেয়ে ছুটছিল মফস্বলের ভাল ভার্সিটিগুলোতে। সেইসব ছাত্র কিংবা অ-ছাত্রদের পকেটে কড়কড়ে নগদ ডলার! সেই ডলারের লোভ সংবরন করতে পারেনি অনেক ভার্সিটি কতৃপক্ষ। আমাদের তাম্বুভ ভার্সিটি কতৃপক্ষের লোভের জিভেও আঠালো জারক রস। বাধ্য হয়ে আমরা গেলাম আন্দোলনে-তারাও আমাদের হুমকি দিল হয় বর্ধিত এই টিউশন ফি দিয়ে পড় নাহলে নতুন ফি এর হিসেবে এই কয় মাসের টাকা দিয়ে ভাগো! তাদের সাথে আমাদের সেই ঠান্ডা লড়াই চলেছিল মাস চারেক। শেষ মেষ ওরা পুলিশের সরনাপন্ন হয়-আমাদের সবগুলো ছাত্রের বিরুদ্ধে কেস করে।

পুলিশের ভয়ে আমরা সবাই রণে ভঙ্গ দিয়ে তল্পি-তল্পা নিয়ে ভেগে গেলাম! ওখানে যাবার পথ রুদ্ধ! আমি যে এখানে ছাত্র ছিলাম তার কোন প্রমান পত্র নেই আমার কাছে। বাংলাদেশ এ্যম্বাসী যদি কোন কাগজ পত্র চায়-তাহলেতো গ্যাড়াকলে পড়ে যাব। তবে সান্তনা যে, নিজের দেশের এ্যম্বাসী। নিজের ভাষায় চরম মর্মস্পর্শী কাহিনী ফেঁদে হাতে পায়ে ধরলে হয়তো একটা সুরাহা হয়ে যাবে। তাছাড়া আমাদের সেই বড় ভায়ের যে দাপট সারা মস্কো জুড়ে-তার প্রভাবে হয়তো বাধ্য হবে পাসপোর্ট দিতে।

কিন্তু ইতিহাস বলে অন্য কথা! এদেশে জন্মই হয়তো আমাদের আজন্ম পাপ। ডিসেম্বরের কঠিন বরফের আস্তরে ডুবে থাকা সেই বাংলাদেশ এ্যম্বাসীর কর্ম-কর্তাদের হৃদয় যেন ভয়ানক কঠিন। কাজকর্মতো বটেই -কথা বলতেও তাদের ভীষন অনীহা। ও হরি! এ দেখি আরেক তেলেসমাতি। আমার পুরো গপ্পো না শুনেই প্রথমে তারা বললেন, বৎস তুমি যে বাংলাদেশী তার প্রমান কি? আমি গড় গড় আউড়ে যাই বাপ দাদার চৌদ্দ গুষ্টির নাম ঠিকানা আর পদবী।

জলজ্যান্ত প্রমান এনে হাজির করি-নবী রাসুল আর ধর্মের দোহাই দিয়ে আর কিরা কসম কেটে যত বোঝাতে চেষ্টা করি ততই তারা কঠিন চেহারায় বলেন, ডকুমেন্ট চাই ডকুমেন্ট! ...এই পর্ব শেষ আগের পর্বের জন্য; Click This Link প্রথম পর্বের জন্য; Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।