আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাগদা তো-ভ রাশিয়া-১৬

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! আমাদের স্টেশনে যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগবে। চোখ বুজে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! ঘুম ভাঙল এক সহৃদ যাত্রীর ধাক্কায়। ‘এই তোমরা কোথায় নামবে?’ অ্যাঃ! চমকে উঠে চোখ রগড়ে দেখি আমাদের ষ্টেশনে এসে গেছি। ঘুমন্ত শিশিরকে জাগানোর সময় ছিলনা। তার হাত ধরে কোন মতে টেনে নামাতেই ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

চলন্ত সিড়ি বেয়ে যখন ভু-গর্ভস্ত মেট্রো ষ্টেশন থেকে উপরে উঠছি তখনও মনে হয় ঘুমের ঘোরে ঢলে পরছিলাম! ষ্টেশনের দরজা দিয়ে বের হয়ে আন্ডারপাস দিয়ে উল্টো দিকে বের হবার সময় মনে হল আমরা ভুল ষ্টেশনে নেমেছি। এই ট্রেন ষ্টেশনটা দেখতে অবিকল আমাদের ষ্টেশনের (অরিয়েখবা) মত। মস্কোতে একই ধরনের দুটো মেট্রো ষ্টেশন আমাদের এযাবৎ চোখে পড়েনি। ওদের প্রত্যেকটা স্টেশন একটার সাথে আরেকটার এত বেশী পার্থক্য যে, সদ্যাগত কোন পর্যটকেরও ভুল হবার কথা নয়। যাহোক ভ্রম ভাঙলে স্মরন হল আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছি ।

আমাদের গন্তব্য দু-ষ্টেশন আগে! যেপথ দিয়ে বর হয়েছি সেপথ দিয়ে আর ঢোকা যাবেন, পেরেখদ বা আন্ডার পাস দিয়ে কিছুটা ঘুর পথে এগিয়ে গিয়ে প্রবেশ পথ দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে। আন্ডারপাসের মধ্যিখানে প্রায় পুরো জায়গাটা দখল করে অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে জটলা করে আড্ডা দিচ্ছিল। শীতের দিনে এতরাতে এরকম দৃশ্য অস্বাভাবিক! কিন্তু আমাদের এসব নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই। শুধু ছেলে ছোকড়া হলে কথা ছিল কিন্তু সে আড্ডায় মেয়েদের উপস্থিতি খানিকটা স্বস্তি-ই পেয়েছিলাম। ওদের কাছাকাছি গিয়ে অনুরোধের স্বরে একটু খানি রাস্তা ছাড়ার জন্য বললাম ‘দয়া করে কি আমাদের যেতে দিবে’? ‘অবশ্যই’ বলে কয়েকজন একসাথে হো হো করে হেসে উঠল! রাস্তা ছেড়ে দেবার জন্য অনুরোধ করার প্রতি উত্তরে এভাবে উচ্চস্বরে হাসির কারন বুঝলাম না?ওদের এই আচমকা উচ্চকিত হাসি আর রহস্যপূর্ন চাহনীতে আমরা বেশ ঘাবড়ে গেলাম! দু তিনটে ছেলে ততক্ষনে দেয়ালের পাশ থেকে একটু খানি সরে দাড়িয়ে আমাদের হেটে যাবার পথ করে দিয়েছে।

প্রকম্পিত পদক্ষেপে দুপা এগুতেই ছেলেগুলো চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরল। ওদের মধ্যে থেকে সাস্থ্যবান ও দীর্ঘদেহী দু’জন এগিয়ে এসে আমাদের দু'জনকে হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা মেরে দেয়ালের দিকে আরো খানিকটা চেপে ধরে হাসি হাসি মুখে কঠিন স্বরে বলল ‘কোন রকম চেল্লা হল্লা করবা না। ভাব দেখাবে যে, তোমরা আমাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছ । ঠিক আছে?’ কাষ্ঠ হেসে শুকনো ঠোটে জ্বিহ্বা ছুইয়ে বললাম ‘যথা আজ্ঞা!’ আমাদের ঘিরে দাড়িয়ে আছে চারজন আর ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে আড্ডা দিচ্ছে দুটো মেয়ে আর তিনটে ছেলে। এদিকে ওদের কোন ভ্রুক্ষেপ-ই নেই।

কি নিখুত অভিনয়! ওদের কাছে অস্ত্র ছিল কিনা জানিনা। তবে আমাদের মত দু'জন ভেঁতো বাঙ্গালীকে পিটিয়ে মোরাব্বা বানানোর জন্য অমন দু'চারখানা পেশী বহুল হাত-ই কাফি। কোন রকম টু ফ্যা করলে চিরতরে নুলা-ন্যাংড়া হয়ে যাবার সমুহ সম্ভবনা। কি আর করার অগত্যা হাসি হাসি মুখেই ওদের সাথে গল্প জুড়লাম! -‘কোত্থেকে এসেছ?’ -‘বন্ধুর হোটেলে দাওয়াত খেয়ে । ’ -‘বাঃ বেশ।

মালটাল খেয়েছ?’ -‘ন্ না । ’ সঙ্গে সঙ্গে দু -তিনজন খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল! একজন ব্যাঙ্গাত্বক স্বরে বিশ্রী হলুদ দাতগুলো( বেশীরভাগ রাশানদের দাত-ই কিছুটা হলদেটে- আর জিহ্বা কালচে) বের করে হাসতে হাসতে বলল, -‘তাহলে কি বাবু-এখনও জুস খাও?’ পাশের কঠিন চেহারার দানব আকৃতির ছেলেটি গম্ভীর কন্ঠে বলল ‘আমরা বন্ধুরা মিলে বেরিয়েছি ড্রিঙ্ক করার জন্য। কাছে টাকা পয়সা নেই। পকেটে যা আছে বের কর?’ মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, 'এত কস্টের টাকা কয়টা এক ঝটকায় বেরিয়ে যাবে?’ তখুনি দু’জন মাঝ বয়েসি লোক গল্প করতে করতে আন্ডার পাস দিয়ে এগিয়ে আসছিল । ওদেরকে দেখেই ছেলেগুলো ,যেন অনেকদিন পরে পুরোনো বন্ধুকে ফিরে পেয়েছে,তেমনি আবেগ ভরা কন্ঠে চরম উচ্ছাসে আবোল-তাবোল গল্প জুড়ে দিল।

লোকগুলো কাছে এগিয়ে আসতেই ওরা সম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিল । ভদ্রলোক দুজন আমাদের এই উচ্ছল আড্ডার অন্তরালে অন্যকোন উদ্দেশ্য কাজ করছে এ সন্মন্ধে বিন্দু মাত্র সন্দেহ না করে নিজেদের মাঝে গল্প করতে করতে ধীর পদক্ষেপে হেটে হেটে এগিয়ে গেলেন। ও পাশ দিয়ে ওরা বেরিয়ে যেতেই আমাদের সেই ভন্ড বন্ধুদের নকল মুখোশ খুলে পড়ল। ‘পকেটে কি আছে বের কর?’ সেই দানবটা হিস হিস করে বলল। কোন ঝামেলার দরকার নাই রে বাপ! অতিদ্রুত আমরা দুজন পকেট হাতড়ে সবকিছু বের করে তাদের সামনে মেলে ধরলাম ।

... শুধু আমার কাছে অল্প কিছু টাকা দেখে হয়তো ওরা সন্তুস্ট হলনা। ‘আর কিছু নেই?’বলেই আমাদের দুজনের হাত থেকে পাসপোর্ট দুখানা নিয়ে মেলে ধওে চোখ নাচিয়ে বলল ‘কি আছে কিছু। ’ তারপর আমাদের দিকে সরাসরি চোখের দিকে চেয়ে দু হাত দিয়ে সে'দুটো টেনে ধরে ছেড়ার ভঙ্গী করল। তখুনি শিশির ভীষন ভাবে আঁতকে উঠে চিৎকার করে বলে উঠল ‘প্লিজ পাসপোট ছিড় ..’ কথা শেষ না হতেই ‘ধাপ’করে ভোঁতা শব্দে কেঁপে উঠল পুরো দেয়াল!! সেই সাথে শিশিরের ভয়ঙ্কর আর্ত চিৎকার ‘আঃ! ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হা হয়ে গেলাম! এদের কাছ থেকে এত নিঃশংসতা আমি আশা করিনি । আমি প্রচন্ড বিস্ময় ও আতঙ্ক নিয়ে তাকালাম শিশিরের দিকে ! সামনে দাড়ানো ছেলেটার ঘুষির তোড়ে তার মাথাটা প্রচন্ড জোরে দেয়ালে ঠুকে এখন গর্দানের উপর উবু হয়ে ঝুলছে।

পাথরের মেঝেতে ঝড়ে পড়ছে ফোটা ফোটা রক্ত! এবার মনে হয় আমার পালা‘ ভাবতেই ফের আতঙ্কে সারা শরীর হিম হয়ে গেল! মরিয়া হয়ে ক্ষীন কন্ঠে ওদেরকে বললাম ‘ দয়া করে অযথা মের না । আমাদের কাছে আর একটা টাকাও নেই। নিজের হাত মেলে ধরে বললাম আমাদের কাছে যা আছে সবকিছু নিয়ে যাও। পাসপোর্ট ফেলে দাও ছিড়ে ফেল যা খুশী কর কিন্তু আঘাত কোর না । ’ আমার অসহায়ত্ব ও করুনা ভিক্ষার সর্ব্বোত্তম প্রকাশ দেখে ওরা হয়তো মনে মনে খুশী হল।

কিংবা শিশিরের আঘাতটা এত মারাত্বক হবে ওরা হয়তো ভাবতে পারেনি সে কারনেই খানিকটা নরম হল কি? কে জানে? আমাকে বলল ‘বেশ! দু হাত উপরে তোল। ’ আমি হাত তুলতেই ওরা একজন চরম ক্ষিপ্রতায় পুরো শরীর চেক করে নিল। একই ভাবে শিশিরের চেক করা শেষে হতাশ হয়ে পাসপোর্ট দুটো আমার হাতে ফেরত দিয়ে বলল‘ঠিক আছে ওই টাকা গুলোই দাও । ’ আমি টাকাটা তার হাতে দিয়ে নিচু স্বরে ভয়ে ভয়ে বললাম, যদি কিছু মনে না কর একটা কথা বলি?’ ‘কি কথা?’ ‘আমাদের বাসায় ফিরে যাবার ভাড়া নেই। এত রাতে মেট্রোও পাবনা।

যদি...’ ছেলেটার কঠিন মুখ সরল হল। ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটল। পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে নিজের মনেই বলল‘বেদনী বিল্ল্যাত( অসহায় বা ভিখেরী )’। দু’শ রুবলের একটা নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল ‘যা ফোট!’ টাকাটা হাতে নিয়ে আমি তাদের ধন্যবাদ দিয়ে শিশিরের একহাত আমার কাধের উপর দিয়ে ডান হাত দিয়ে ওকে বেস্টন করে কোন মতে টেনে টেনে বাইরে নিয়ে এলাম ট্যাক্সি ধরব বলে । ...... এই পর্ব শেষ আগের পর্বের জন্য; Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।