আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাগদা তো-ভ রাশিয়া-১৪( তৃতিয় খন্ড প্রথম পর্ব)

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! ট্রেনে আবার মাালদোভিয়া যাচ্ছি । ভগ্ন বিধ্বস্ত মন নিয়ে -কপদর্ক শুন্য রিক্ত একেবারে ঝাড়া হাত-পা ,সাথে এককখানা ব্যাগ পর্যন্ত নেই । নিজের এই দেহটা আর এই অল্প শীতে যেটকু পোষাক না হলেই নয় তাই গায়ে চড়িয়েছি । আমাদের সেই গুরু ভদ্রলোক হোটেলের খরচ দিতে না পেরে আমাকে তার বাসায় এনে রেখেছিল । তিন মাস পেরিয়ে গেছে অনেদিন আগে তবুও তার টাকা দেয়ার নাম নেই ।

আমাকে প্রতিদিন মাতাল হয়ে শান্তনার বানী শোনায় ‘এই আর সপ্তাখানেক অপেক্ষা করেন সব সমস্যা মিটে যাবে। ’ আমিও আশায় বুক বাধি অবশ্য এছাড়া আর কিবা করার আছে। মাঝে একদিন টাকা চেয়ে দেশে ফোন করতে চাইলে সে নিষেধ করল । এদিকে কর্মহীন বসে থাকতে থাকতে যেন জড় পদার্থ হয়ে যাচ্ছি । দিনরাত রান্না নিয়ে গবেষনা আর কার্ড খেলা।

ইনিস্টটিউটের এক সেমিস্টার মিস করেছি দ্বীতিয়টায় সময়ও এসে গেল প্রায় , এটাও মনে হয় যাবে .... আমার দুরবস্থার কথা শুনে মালদোভিয়ার বন্ধুরা বলল,যেহেতু হাতে অফুরন্ত সময়-আর টাকা কবে ফেরৎ পাব তারও নিশ্চয়তা নেই তাই ক'দিনের জন্য তাদের ওখানে বেড়িয়ে আসতে। ওদের ওখানে বেড়াতে যাবার প্রস্তাবে নেচে উঠলেও পরক্ষনেই চুপসে গেলাম। এখানে যাহোক সবকিছু চোখের সামনে ঘটতে দেখছি, আমি এদের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভুতের মত চেপে বসে আছি। এই গলগ্রহ ছাড়াতে পারলেই যেন এরা হাফ ছেড়ে বাঁচে! গুরুর হাতে টাকা এলে প্রথমে আমাকে দিবেন বা দিতে বাধ্য হবেন একব্যাপারে নিশ্চত কিন্তু দুরে সরে গেলে কিছুই জানতে পারবনা। ইতিমধ্যে এদের হাতে টাকা এলেও যদি অস্বীকার করে তবে কিছুই করার নেই- সেহেতু শত কস্ট হলেও এখানে পড়ে থাকা শ্রেয়ই ভাবলাম।

তবুও কেন যেন বড় ভাই আর গুরুর মুহুমুহু অনুরোধ আর প্ররোচনার কাছে আমি হার স্বীকার করতে বাধ্য হলাম। ওরা বলল রাশিয়া ভ্রমনের এমন সুযোগ ভবিষ্যতে নাও পেতে পারি -সেজন্য এই অবসরে দেশটা যেন ভাল করে ঘুরে ফিরে দেখে নেই । এভাবে ঘরের মধ্যে বসে না থেকে আমার চারিদিকে ঘুরে দেখা উচিত , খরচাপাতি নিয়ে চিন্তা নেই সব খরচ উঁনাদের। ওরা আমাকে আশ্বাস দিল, আশা করছে মাসখানেকের মধ্যে টাকার ব্যাব¯হা হয়ে যাবে আর আমার ইনিস্টিটিউটে ভর্তি নিয়ে নাকি আমার চেয়ে টেনশন তাদের কিছুমাত্র কম নয় । তারা আমাকে ঠিক আপন ভায়ের মত স্নেহ করে ! তখন বয়স কম ছিল বুদ্ধি নয় আবেগের দ্বারাই বেশী পরিচালিত হতাম বেশী।

একটু গাই গুই করে শেষমেষ ঠিকই রাজী হয়ে গেলাম। তারা আমাকে আরো বেশী আস্বস্ত করার জন্য ঘন ঘন কসম খেতে লাগল। আমিও বেকুব ফের তাদের বিশ্বাস করলাম এবং যথারীতি প্রতারািত হলাম! মালদোভিয়ায় গেলাম একমাসের জন্য ফিরে আসলাম নয়মাস বাদে । এই দীর্ঘ সময়ে আমাদেও সেই গুরু শুধু বার দুয়েক ফোন করেই কর্তব্য সেরেছে! আর হাত খরচের টাকা? তার প্রশ্নই আসে না। তবে সে বেচারার দোষই বা দিই কেমন করে লোক মুখে খবর পেয়েছিলাম সে নাকি কপর্দকহীন হয়ে তখন পথে পথে ঘোরে ।

এ’কমাস কেমন কাটল মালদোভিয়ায় ? সুখে? হ্যা সুখেই কেটেছে -মহাসুখে! (যেহেতু আমার লেখার শিরোনাম 'কাগদা তো-ভ রাশিয়া' সেহেতু এখানে শুধু আমি রাশিয়ার কথাই বলব। মালদোভিয়া তখন একদম ভিন্ন এক দেশ। ওখানে ঘটে যাওয়া কিছু ভয়ংকর কিছু ঘটনা দূর্ঘটনার কথা অন্যসময়ে বলব। তবুও সেই নয় মাসে ঘটে যাওয়া দু-য়েকটা ঘটনা নিয়ে আলোচনা না করলে গল্পের তাল কেটে যাবে। ) মলদোভিয়ায় বন্ধুদের সহচর্য আর সহমর্মিতায় বেশ আনন্দে থাকলেও পকেটের অবস্থা ভয়ানক করুন ছিল! পোষাক বলতে ছিল দু-প্রস্থ প‌্যান্ট আর এক জোড়া শার্ট মাত্র! মাস তিনেক বাদের কথা; আমার সেই বড়ভাই মস্কো প্রবাসী গুরুকে ল্যাং মেরে নিজেই পুরো দস্তুর ‘আদম বেপারী ’ সেজে ডজন খানেক আদম নিয়ে এইরুট দিয়ে পাচারের উদ্দেশ্যে মালদোভায় এসে উপস্থিত হল।

তার এই অপ্রত্যাশিত আগমনে যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত হলাম! ভাবলাম যাক এবার তাহলে কস্টের দিন শেষ হল... কিন্তু কথায় বলে ‘কপালে নেইকো ঘি ঠনঠনালে হবে কি!’ আমার বেলায় তেমনই ঘটল। মানুষ চিনতে বড্ড বেশী ভুল করেছিলাম- আমাকে দেখে সে ধারনার চাইতে অনেক বেশী উৎফুল্ল হয়ে সরল হাসি চোখ মুখ উদ্ভাসিত করে দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করল। বলতে দ্বীধা নেই, অপ্রত্যাশিত সে মুহুর্তে দুয়েক ফোটা গরম নোনা জল আমার চোখের কোলে ভিড় করে ধরনীতে আত্মাহুতি দেয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করছিল। ...তারপর গভীর রাত অবধি চলল আমাদের আড্ডা । দুজনার কারো কথাই যেন ফুরাতে চায়না।

তাকে যদিও 'বড় ভাই' বলে সন্মোধন করতাম কিন্ত আমাদের সম্পর্ক ছিল অনেক বেশী বন্ধুত্বপূর্ন। আমাদের সখ ও পছন্দের মিল ছিল বিস্ময়কর। বাকপটু সদালাপী লাস্যময় সেই বড়ভাইরুপী বন্ধুর সাথে জমত বেশ। গল্পে গল্পে মেলা রাত হয়ে গেলে সে অনুরোধ করল রাতটা সেখানে থেকে যেতে। আমারও ফিরে যাবার তাড়া নেই ।

দিনের পর দিন এক জায়গায় থাকতে থাকতে কেমন যেন একঘেয়ে লাগছিল । দুয়েক রাত একটু ভিন্ন পরিবেশে কাটাতে পারলে মন্দ কি, তাই সানন্দেই রাজী হয়ে গেলাম । সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে নিজের ডেরায় ফিরে আসার মুখে সঙ্কোচভরে আমার শোচনীয় অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে- তার কাছে আমার পাওনা টাকার ক্ষুদ্রতম একটা অংশ দিতে অনুরোধ করলাম; কথাটা বলার মুহুর্তেই লক্ষ্য করলাম তার হাসিখুশী মুখের আলো দপ করে যেন নিভে গেল । অতিকস্টে একটু কাস্ট হেসে নতুন করে শুরু করল তার সাতকাহন ’, সারমর্ম হল এই যে, আমি যা ভেবেছি তা নয় । তার অবস্থা এখন নাকি আমার থেকে শোচনীয়!!! কত কস্ট করে সে এতদিন মস্কোতে থেকে ,কত টাকা দেনা হয়েছে তার এক লম্বা ফিরিস্তি দিল।

এখন এই আদমগুলোকে কোন মতে পাঠাতে পারলে নাকি সে দেনার ভার কিছুটা লাঘব করতে পারবে। খরচের সামান্য কিছু টাকা ছাড়া এমুহুর্তে নিজের হাতে এমন কিছু অতিরিক্ত অর্থ নেই যে তা থেকে আমাকে সামান্য কিছু দিতে পারবে । আমার জন্য তার কস্ট হচ্ছে! ভিতর থেকে নাকি তাগিদ অনুভব করছে কিছু একটা করার কিন্তু নির্ভেজাল বিমর্ষ চেহারা নিয়ে বেদনাসিক্ত কন্ঠে সে জানাল ‘স্যরি!’ একেবারে কিছু না করলেই নয় এই ভেবেই হয়তো শেষ মুহুর্তে সে তার মানিব্যাগের অলিগলি খুজে ‘পাচটি(!) ডলার বের করে দলা পাকিয়ে স-সঙ্কোচে আমার হাতে গুজে দিল। সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর অপমানের পরিপেক্ষিতে বিশ্ব বিধাতাই হয়তো তার জন্য একটা ছোট্ট শাস্তি বরাদ্দ করে রেখেছিল। সপ্তাখানেক বাদেই লোকমুখে খবর পেলাম তার নাকি রুম ডাকাতি হয়েছে! সভ্য ভদ্র সেই ডাকাতদল কোন রক্তপাত না ঘটিয়েই নাকি তার গোপন দেরাজ থেকে হাজার দশেক ডলার নিয়ে চম্পট দিয়েছে এমন বিশ্বস্ত সুত্রের উড়ো খবর ‘শেলের’ মত কানে এসে বিঁধল! খবর পেয়েই ছুটে গেলাম তাকে সান্তনা দিতে , বিমর্ষ বদনে তিনি সেই রোমহর্ষক(!) ডাকাতির কাহিনি বর্ণনা করে টাকার অংকে এসে থমকে গেলেন।

অনেক চাপাচাপির পরে জানালেন সাকুল্যে নাকি শ’তিনেক(!) ডলার! আমার নিশ্চিত বিশ্বাস যে সে আমার কাছে প্রকৃত টাকার অংক চেপে গিয়েছিল। ক’দিন পরে তার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ই আমাকে চুপি চুপি বলেছিল ‘ওখানে নাকি হাজার দশেক ডলারই ছিল !’ ‘সুসময়ের ঘাড়ে প্রতিনিয়ত বিষ নিশ্বাস ফেলে দুঃসময় আর দুঃময়ের পিছু পিছু হেলে দুলে এগিয়ে আসে সুসময় বরাবরই। ' কিন্তু আমার সু-সময় বড্ড বেশী আলসে ছিল-আসবার পথে শরির এলিয়ে কার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছিল কে জানে। ....এই পর্ব শেষ দ্বীতিয় খন্ড শেষ পর্বের জন্যঃ Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।