আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাগদা তো-ভ রাশিয়া ১০

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! রাষ্ট্রদুত সাহেব তখন ছুটিতে -তার অবর্তমানে যিনি ছিলেন তার সাথে দেখা করতেই সপ্তাখানেক লেগে গেল! চরম ব্যস্ত মানুষ তিনি -যখন তখন যার তার দর্শন দেননা। তিনি অধঃস্তনের কথা নতুন করে আউড়ে গেলেন! তবে ভদ্রলোক আমাকে ব্যখ্যা করলেন, নতুন পাসপোর্ট দেবার ব্যাপারে কেন তারা এত কঠোর হলেন; রাশিয়াতে ডুপ্লিকেট একটা পাসপোর্ট করতে ব্যায় হত মাত্র আশি রুবল। যার মুল্য আগে বেশী থাকলেও এখন(১৯৯৩ সাল) পঁচিশ সেন্টের সামান্য বেশী! পেরেস্ত্রোইকার সময় থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে কিছু ছাত্র নামধারী অ-ছাত্ররা বানের জলের মত এদেশে ঢুকে পড়েছে অন্যদেশে যাবার ধান্দায় তাদের কিছু অংশ ইউ এস এ যাবার বাসনায় ঘন ঘন সেই অ্যাম্বাসীতে ধর্ণা দিয়েছে। একবার ভিসা না পেলে পাসপোর্টের এককোন একটা 'প্রত্যাখ্যানের ছাপ'। পরের ছ'মাস ওমুখো হওয়া বারণ! কেউ একজন পথ দেখিয়েছে বাকিরা ছুটেছে অন্ধের মত সেই পথে; পাসপোর্টে সীল দিয়েছে তাতে কি? দৌড়ে গেছে নিজের অ্যাম্বাসীতে।

মাত্র আশি রুবলে নতুন একখানা পাসপোর্ট-ফের অ্যাম্বাসীতে দৌড়। বিফল হলে আবার নতুন পাসপোর্ট! ধূর্তামী আর জালিয়াতি করে কতদিন চলে? অল্প ক'দিনেই তাদের এই চালাকি ধরে ফেললেন আমেরিকা অ্যাম্বাসীর ত্যাদোড় ভিসা অফিসাররা। রেড পড়ল বাংলাদেশীদের হোস্টেলগুলোতে। কারো কারো কাছ থেকে বের হল চার-পাঁচখানা পাসপোর্ট! কি ভয়াবহ ব্যাপার! রুশ কতৃপক্ষ জরুরী তলব করল বাংলাদেশের রাষ্ট্রদুতকে। বেচারা সত্যিই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন।

এরপর থেকে এই কড়াকড়ি। উঁনার গল্প শুনে আমার ক্ষোভ খানিকটা প্রশমিত হল। তিনি সব সত্য কথা শুনে বিশেষ দয়াপরবশত; আমাকে একটা পরামর্শ দিলেন: যেন তেন ভাবে যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সেকানকার ছাত্রের একটা প্রমানপত্র এনে দিলে তিনি চেষ্টা করবেন। অনেক ভেবেচিন্তে এর ওর সাথে শলা পরামর্শ করে অবশেষে আমার অতি শ্রদ্ধাভাজন সেই বড় ভাইকে গিয়ে ধরলাম। তিনি সব শুনে তার বিখ্যাত হাসি দিয়ে বললেন কোন সমস্যা নেই চল, 'গুরুর কাছে'।

গুরু মানে তার সেই গড ফাদার! প্রচুর চ্যালা-চামুন্ডা পরিবেষ্ঠিত একহাতে ভদকার গ্লাস আর অন্যহাতে প্রজ্জলিত গঞ্জিকা দন্ড নিয়ে তিনি আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। ভদ্রলোক দারুন অমায়িক! আমাকে দেখেই তিনি বেশ আন্তরিকতার সাথে জানতে চাইলেন, কি সমস্যা? আমার হয়ে বড় ভাই বললেন... সব শুনে তিনি মুচকি হেসে বললেন, এ্যম্বাসীতে আসলেই ঝামেলা যাচ্ছে। ওদের এখন অনুরোধ করে লাভ নেই। তার থেকে চল কাল যাই অন্যখানে- দেখি তোমার একটা প্রমানপত্র যোগাড় করে দিতে পারি কিনা? হাত তুলে তিনি আশ্বাস করলেন, হয়ে যাবে তুমি টেনশন কোর না। তার এই আশ্বাসে আমার কাছে মনে হল তখন গঞ্জিকার ধোঁয়ার আড়ালে ঝাকড়া চুলের একজন দেবদূত বসে আছেন।

পরদিন তিনি আমাকে 'পাদ মস্কোভা' বা মস্কোর শহরতলীর এক অখ্যাত ইনিস্টিটিউটে নিয়ে গেলেন। প্রায় নির্জনে অতি মলিন আর জীর্ণ এক ভবন। কড়িডোর ধরে হেটে যাবার সময় আশেপাশে কোন আশেপাশে কোন ছাত্র নজরে আসল না। তিনি সরাসরি গিয়ে ঢুকলেন অধ্যক্ষ্'র রুমে। অধ্যক্ষ মহোদয় তাকে দেখে বেশ পুলকিত হলেন বলে মনে হল! প্রথমে কুশল বিনিময় তারপরে টুকটাক খেজুরে আলাপ শেষে আসলেন কাজের কথায়; আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন নিজের ভাই বলে।

গুরু শুদ্ধ রুশ ভাষায় কিছুটা সত্য মিথ্যার মিশেল করে বেশ বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপন করলেন আমার সমস্যাটা। আমি নাকি উঁনাদের ইনিস্টিটিউটে ভর্তি হবার জন্যই তাম্বুভ ছেড়ে মস্কোতে এসেছি। এসেই পাসপোর্ট হারালাম! এখন একটা প্রমান পত্র পেলেই নতুন পাসপোর্ট নিয়ে তাদের এখানে ভর্তি হতাম! তিনি কিছুটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে খানিক্ষন সময় ব্যায় করলেন। অবশেষে তিনি বললেন, প্রমানপত্র তিনি দিতে পারেন তবে তার বদলে আমার এখানে ভর্তি হবার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে? আমার কিছু বলার আগেই গুরু তাকে আশ্বাস দিয়ে নিশ্চিত করে বললেন, অবশ্যই-সে আপনার এখানেই ভর্তি হবে। তার এই প্রতিশ্রুতির পরিপেক্ষিতে অবশেষে আমার পাসপোর্টের ছাড়পত্র মিলল।

ফেরার পথে তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি যে প্রতিশ্রুতি দিলেন? আমিতো পরাশুনা না করলেও এই ফালতু ইনিস্টিটিউটে ভর্তি হবনা। পরে কি হবে? উঁনি হেসে বললেন ওদের চলে আমাদের দিয়ে। দেড়-দুইশ ডলার দিয়ে ওদের কাছ থেকে আদমদের স্টুডেন্ট ভিসা নিই। পুরা টাকাটা ফাউ কামাই। তোমার ব্যাপারে বেশী ক্যাচ ক্যাচ করলে বলব, সে নতুন পাসপোর্ট নিয়ে সোজা দেশে চলে গেছে-রাশিয়ায় সে থাকবেনা আর।

এমুহুর্তে আড়াই হাজার ডলারের মত হাতে আছে। অবশ্য ঠিক হাতে নয় কিন্তু ডলারগুলো এমন একজনের কাছে গচ্ছিত আছে যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়! পুরো রাশিয়ার মুদ্রা বাজার এখন দারুন অস্থিতিশীল। ডলারের বিপরীতে প্রায় প্রতিদিনই রুবলের মুল্যমান পড়ে যাচ্ছে তাছাড়া দেশের অর্থনীতিতে চলছে চরম মন্দাভাব। ব্যাংকে টাকা রাখা নেয়ায়েৎ বোকামী। এর আগে একবার চরম ধরা খেয়েছি।

চড়া সুদের হার দেখে শ’তিনেক ডলার ভাঙ্গিয়ে এক ব্যাংকে জমা রেখে ছিলাম। ভয়াবহ মুদ্রাস্ফিতির কারনে দুমাস পরে সেই তিনশো ডলারের বিপরীতে পঁচিশ ডলার সমমানের রুবল পেয়েছিলাম(রুস্কাইয়া ব্লুদা'তে এর উল্লেখ আছে)। সেই থেকে নাকে খৎ দিয়েছি। বাকি জীবনে রুশ ব্যাংকে টাকা রাখবনা। বড় ধরনের কোন খরচের ফেরে না পড়লে নতুন ভার্সিটির টিউশন ফি থেকে শুরু করে বছর দু'য়েক থাকা খাওয়ার খরচ এই দিয়ে চলে যাবে সাচ্ছন্দে! এখন আমি নতুন পাসপোর্ট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিন্তে কটা দিন ঘুমিয়ে আর আড্ডা দিয়ে কাটাতে পারব বেশ।

পাসপোর্ট হাতে পাওয়ার আগেই ঘটল আরেক অঘটন... ...এই পর্ব এখানেই শেষ করা উত্তম মনে হয়! আগের পর্বের জন্য; Click This Link প্রথম পর্বের জন্য; Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।