আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কাগদা তো-ভ রাশিয়া-৮

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল! ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে উপরে টেলিফোন করে বন্ধুদের নীচে আসতে বললাম। ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দিব- তা আর হল কই? পরক্ষনেই অতি পুরাতন লিফটে চড়ে চার পাঁচজন হাজির! কই ‘হাই দোস্ত’ হ্যালো দোস্ত’ বলে গলায় জড়িয়ে ধরবে তা না তার বদলে শুরু হল জেরা। কোথায় হারাল?’ ক্যামনে হারাল?’ আমি এমন অপদার্থ কিংবা বেকুবের মত কাজ কি করে করলাম? ’ আমি নিজেই জানিনা অঘটনটা কি করে ঘটল? এদের এত প্রশ্নের উত্তর দেই কেমনে? কথাচ্ছলে মনে পড়ল গত রাতের ঘটনা; ইমিগ্রেশন অফিসারক গভীর রাতে পাসপোর্ট দেখিয়েছিলাম। তারপর ....ওয়েস্ট ব্যাগখানা কি ট্রাভেল ব্যাগে না রেখে ঘুমের ঘোরে অন্য কোথাও? ওদের বলতেই ওরা বলল,এখুনি ফের স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের সেই বগি খুজতে? কথা মাটিতে পরার আগেই একজন দৌড়ে গেল ট্যাক্সি ডাকতে। কি আর করার খড় কুটো আকড়ে ধরার মত ফিরে চললাম স্টেশন অভিমুখে সাথে হোটেলের বোর্ডার দুই বন্ধু।

রাত তখন দেড়টার মত বাজে। কিয়েভেস্কি বোখজাল-যারা দেখেননি তাদের ভাবতে কষ্ট হবে কি বিশাল এই রেল স্টেশনখানা!১৯১৮ সালে স্থাপিত এই রেল স্টেশনে সাকুল্যে এগারখানা প্লাটফর্ম আর বারোটা রেল ট্রাক আছে। কিষিনেভ আর কিয়েভ ছাড়াও এ রেল স্টেশন থেকে প্রতিদিন বহুসংখ্যক ট্রেন বুখারেষ্ট, প্রাগ, ভিয়েনা, ভেনিস সহ ইউরোপের বিখ্যাত সব শহরগুলোর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আমি তখন উম্মাদ পাগল দিশেহারা!বিশাল রেল স্টেশনের এমাথা ওমাথা কোথাও খুঁজে ট্রেনখানা পেলাম না। অগত্যা অফিস রুমে গিয়ে রেল ওয়ের এক বড়কর্তাকে পেড়ে ধরলাম।

সব খুলে বলে তাকে সেই ট্রেনের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি গভীর দুঃখের সাথে জানালেন ‘সে ট্রেনখানা মাত্র ঘন্টা খানেক আগে ফের কিষিনেভের অভিমুখে রওনা দিয়েছে। ওটা ফিরে আসতে দিন পাঁচেক সময় লাগবে। তদ্দিনে সেই ওয়েস্ট ব্যাগের কোন হদিস না থাকারই কথা। ’ তবুও কেউ যদি খুঁজে পেয়ে দয়াপরবশত; হয়ে সেটা তার প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দিতে চায় সেজন্য নাম ঠিকানা রেখে দিলেন । দু’দুটো দিন জার্নির ধকল প্রচন্ড শীতের কামড় আর পাসপোর্ট হারানোর টেনশনে আমি তখন বিধ্বস্ত।

চিন্তুা শক্তি স্থবির হয়ে গেছে- কাল কি হবে এই নিয়ে ভাববার মত মানসিক শক্তি তখন হারিয়ে ফেলেছি। সব কিছু ছাপিয়ে এখন আমার মুল চিন্তুা আজকের রাতটা কিভাবে কাটাব? কেননা পাসপোর্টছাড়া এই বেওয়ারিশকে কোন হোটেলেই এত রাতে থাকতে দিবে না। আমরা বরাবর যে হোটেলে থাকি সেখানটায় আগে এমনতর কড়াকড়ি ছিল না। কিন্তু ইদানিং অভৈধ অভিবাসীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাছাড়া আদম ব্যাবসায়ীদের ইউরোপে আদম পাচারের মুল রুট হিসেবে মস্কোকে বেছে নেয়ায় পুলিশের উৎপাত বেড়েছে। সাধারন বাসা বাড়িতো বটেই প্রায়শই তারা বিদশী ছাত্রদের মুল আবাস স্থল এসব মাঝারি মানের হোটেল রেড দিচ্ছে।

সে কারনে ইচ্ছে থাকলেও আইনের যাতাকলে পিষ্ঠ হবার ভয়ে ওরা থাকতে দিতে চায়না । বন্ধু দুজন পরামর্শ দিল রাতটা কোনমতে স্টেশনে কাটিয়ে দিয়ে কাল সকালে ম্যানেজার চেঞ্জ হলে তখন অথিতি হিসেবে অন্য কারো রুমে গিয়ে আশ্রয় নিতে। ব্যাগটা না হয় আপাতত হোটেলে রেখে আসা সেই বন্ধুর তত্বাবধানে থাকবে। তাদের সেই পরামর্শ তেমন মনপুতঃ নাহলেও মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। অনুভুতি শক্তি হয়তো সে মুহুর্তে কিছুটা ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল কেননা সেই মুহুর্তে উপলদ্ধি করতে পারিনি ওদের সহানুভুতি বন্ধুর প্রতি বন্ধুর অকৃত্তিম ভালবাসা ওরা দুজনও সদোপ্রনিত হয়ে এমন নির্মম শীতের রাতে নিজেদের গরম ঘর ছেড়ে আমার সাথে স্টেশনের এই উৎকট গন্ধে ভরা আধা উষ্ণ বিশ্রামাগারের চেয়ারে বসে রাত কাটাবে বলে মনস্থির করল।

এমন বন্ধু পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার! ব্যাপারটা সে সেইভাবে অনুধাবন করতে পারবে না যে ডিসেম্বরে মস্কোর শীত দেখেনি। রাতে স্টেশনের ক্যাফেতে কালোরুটি কালভাসা (সালামি) আর কালো কফি খেয়ে বিশ্রামাগারের সেই চেয়ারে গুঁটিসুটি মেরে বসে রইলাম। ভোর হতেই ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে ছুটলাম সেই হোটেলের উদ্দেশ্যে। আমার ভাগ্যের বিপর্যয় শুরু হয়েছিল হয়তো সে রাত থেকেই যে রাতে পাসপোর্ট হারালাম ! কেননা একটা দিন কোনমতে কাটাতেই পরদিন ভোরে পড়লাম পুলিশের খপ্পরে! কাঁক ডাকা ভোরে পুরো মস্কো যখন আড়মোর ভাঙ্গেনি- আর আমরা যারা লেট রাইজার তাদের ঘুম ভাঙ্গার তো প্রশ্নই ওঠেনা। ঠিক তখুনি পুলিশ পুরো হোটেল ঘেরাও করে অনুসন্ধান শুরু করল।

অত ভোরে দরজা নক হতেই রুমমেট বন্ধু রাগী গলায় লেপের নিচ থেকেই শুধাল ‘কে ? প্রতিউত্তর এল গুরুগম্ভীর রুশ ভাষায় ‘ মিলিশিয়া দরজা খোল। ’ আ‘…দুজনের কন্ঠ চিড়ে একসঙ্গে বেরিয়ে এল চাপা আর্তনাদ!হুড়মুড় করে বিছানা থেকে উঠে সে প্রায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। ‘ শুভ সকাল । ...ক্ষমা কোর তোমাদের ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য । তাড়াতাড়ি কাগজপত্র গুলো বের কর?’ বিশাল দেহী দুই পুলিশ অফিসারের পিছনে সেদিনের সেই ম্যানেজার মহিলা।

আমাকে দেখে বড় বড় চোখ করে কিছুক্ষন চেয়ে রইল! পরক্ষনেই আমার দিকে ইঙ্গিত করে পুলিশ অফিসার দ্বয়কে বলল ‘ওআমাদের বোর্ডার নয় মনে হয় এর গেস্ট। ’ অফিসার অমায়িক হেসে আমার মুখোমুখি দাড়িয়ে মিস্টি স্বরে শুধোল ‘বাছা তোমার পাসপোর্ট খানা দেখাও দিকিনি?’ ভীষন ভাবে কেঁপে উঠে আমি আমতা আমতা করে বললাম ‘পা -পাসপোর্ট ? নেই। হারিয়ে ফেলেছি। ’ ‘কিভাবে?’ ‘ট্রেনে। মলদোভিয়া থেকে আসার পথে।

’ ‘তাই। চল আমাদের সাথে… ’ ‘কোথায়?’ ‘থানায়। ’ অতিরিক্ত আর কোন বাক্য ব্যায় না করে সে আমার ডান হাত খানা পিছন দিকে মুড়ে লম্বা প্যাসেজ দিয়ে সদর্পে এগিয়ে নিয়ে গেল লিফটের দিকে। অপরাধী মুখে মাথা নিচু করে নিজেকে নিজের আড়াল করে শতজোরা চক্ষুর সামনে দিয়ে দ্বীধাভরা পদক্ষেপে আমি তাদের সাথে চললাম। পুলিশ ভ্যানে এর আগে বেশ ক'বার চড়েছি তবে প্রতিবারই সন্মানিত বিদেশী হিসেবে লিফট পেয়ে।

এই প্রথম অপরাধী সেজে। পুলিশ ভ্যানের গন্তব্য যথারীতি গেটে। পাসপোট হারিয়ে ফেলা কত বড়ই না অপরাধ! সেই কুকর্মের জন্য অদৃষ্টে কি আছে কে জানে? অবশেষে থানায় নিয়ে পুলিশদ্বয় আরো ক’জন বাঙ্গালী আজারবাইজানীদের সাথে অপরিসর এক হাজত ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, এখানে আরাম করে ঘুমাও… -দ্বীতিয় খন্ড তৃতিয় পর্ব শেষ আগের পর্বের জন্য; Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।